করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





এখন গভীর কবিতার অভাব যেমন রয়েছে, গভীর পাঠকের অভাবও তেমনি আছে
মুহম্মদ নূরুল হুদা
জাতিসত্তার কবি হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ, লোকসংস্কৃতি, নন্দনতত্ত্ব ও অনুবাদ সাহিত্যেও রয়েছে বিচরণ। ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার পোকখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থায় ‘অধোরেখ’ সংকলন সম্পাদনা করেছেন। তার গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে জন্মজাতি, মৈনপাহাড়, দেখা হলে একা হয়ে যাই, রাজার পোশাক, রবীন্দ্র প্রকৃতি ও অন্যান্য, তুমি যদি জলদাস আমি জলদাসী, শুক্লা শকুন্তলা, আমরা তামাটে জাতি ইত্যাদি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে: চরু হক

সমুদ্রপাড়ে আপনার জন্ম। আপনার প্রথম কাব্যের নাম শোণিতে সমুদ্রপাত। বইটি অগ্রজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের আলোচনার সারকথা কি ছিল?
এতদিন পরে তো আর ঠিক মনে পড়ে না। তবে তিনি আমার এই গ্রন্থটির সঙ্গে আমাদের একজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কবি পঞ্চাশ দশকের শহীদ কাদরীর কবিতার সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, আমরা দুইজন দুই দশকের কবি হলেও দুইজনের কবিতার মধ্যে আধুনিকতার এক ধরনের ছাপ আছে। পার্থক্য হচ্ছে এই যে, শহীদ কাদরীর কবিতার চেয়ে আমার কবিতা তরুণতর এবং আমার কবিতায় ক্লাসিক সংহতি আছে। আমার কবিতায় অর্থাৎ শোনিতে সমুদ্রপাত-য়ে সমসাময়িকতার সঙ্গে মিথ অর্থাৎ পুরাণের এক ধরনের সম্মিলন আছে। এর শব্দ চয়ন ও ছন্দের জন্য তিনি বেশ প্রশংসা করেছিলেন। আর ‘দুই কবি’ নামে একটা লেখা বেরিয়েছিল।

সমকালীন বিশ্বকাব্যসাহিত্য বিষয়ে আপনার যে পাঠ অভিজ্ঞতা তার ভিত্তিতে বর্তমান বাংলা কবিতা সম্মন্ধে আপনার মূল্যায়ণ জানতে চাইছি।
বর্তমান বাংলা কবিতা বলতে বাংলাদেশের কবিতা আর পশ্চিমবঙ্গে লিখিত বাংলা কবিতা এবং বাংলা কবিতার ছোট ছোট ভুবন। ধরা যাক এখন লন্ডনে যারা বাংলায় লেখেন তাদেরও কবিতা। কেউ লন্ডনে, কানাডায়, আমেরিকায় এবং অন্যান্য জায়গায় যারা কবিতা চর্চা করে বাংলায়, তাদের কবিতা। এখন সারা পৃথিবীর কবিতা আগের চেয়ে বেশি সহজে পাঠ করা যায়। বিশেষ করে অনলাইনের কারণে। এর ফলে সমকালীন বিশ্ব কবিতার যে ধরনের বিষয় এবং প্রবণতা সাম্প্রতিক কবিতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, মোটামুটিভাবে যারা সচেতন কবি, তাদের আয়ত্তে আছে, জানা আছে। তবে বাংলা কবিতা বিষয় এবং প্রবণতায় বিশ্ব কবিতার সঙ্গে এখন একই সমতলে আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে দেশের যে কোন জায়গায় শ্রেষ্ঠ কবিতা এইটা যে শুধুমাত্র সম্প্রতি এমন নয় বরং চিরকালীন, বিশেষত শিল্পের সংহতি ও শিল্পের নির্মিতির কারণে। এজন্য পাঠ সচেতনতার প্রয়োজন অপরিসীম। সমকালীন বাঙালি কবিদের বিশেষ করে নতুন কবিদের এর অভাব আছে বলে মনে হয়। কারণ, পড়ার আগেই কবিতা লেখার কৌশল জানা উচিত। কবিতার একটা কৌশল আছে, শুধু কবিতা লিখলেই হবে না- এখন যেটা স্বভাব কবির নেই। এই জন্য আমি বলবো এই বিষয় এবং প্রবণতা বলা যেতে পারে সারা পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে তার সবটার সম্পর্কে আমরা জানি।

এটা সত্য যে এখন আর আগের মতো কবিতার বই বিক্রি হয় না। তবে কি কবিতার পাঠক কমে গেছে? পাঠক কি কবিতাবিমুখ হয়ে পড়েছেন?
কবিতার পাঠক কমেছে তা মনে হয় না। ফেইসবুকে দেখলে এখনও দেখি যে ফেইসবুকে কবিতার একশত, দুইশত, পাঁচশত, এক হাজার লাইক পড়ে। এতে বোঝা যায় পাঠক কবিতা পড়ে। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে কবিতার, অর্থাৎ এখন গভীর কবিতার অভাব যেমন আছে, কবিতার গভীর পাঠকেরও অভাব তেমনি আছে। আর এখন মানুষ ফেসবুকের কল্যাণেই খুব সহজে কবিতা লেখে এবং কবিতার বই বের করে। তবে যত গভীর পাঠক আছে তার চেয়ে তাৎক্ষণিক কবি অনেক বেশি আছে। এজন্য মনে হয় যে কবিতার ক্রেতা কমে গেছে কিন্তু আমি যতদূর জানি, আমার পাঠ অভিজ্ঞতা এবং ক্রয় বিক্রয় অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, ভালো কবিতা এখনও প্রচুর বিক্রি হয়। কিন্তু, যেমন তেমন বই বিক্রি হয় কিনা আমি জানি না।

পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন আবৃত্তি সংগঠন বেশি, প্রচুর আবৃত্তিকার। নতুন সম্বোধন হয়েছে- বাচিকশিল্পী। কবিতার প্রচার ও সঠিক প্রসারে এসব সংগঠনের ভূমিকা কতটুকু?
হ্যাঁ বাচিক শিল্পীদের কথা এখন বলা হয়ে থাকে, বাচিক কবিও। অনেক কবি আছে যারা ভালো আবৃত্তি করে। আর অনেক আবৃত্তিকার আছে যারা ভালো কবিতা লিখতে জানে। যেমন: জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় আমাদের দীর্ঘদিন ধরে ভালো কবিতা উপহার দিচ্ছেন। আমাদের জন্য একজন শ্রেষ্ঠ বাচিকশিল্পী। তিনিও চার পাঁচটা গ্রন্থ লিখেছিলেন এবং সেগুলো বেশ ভালো কবিতা। অর্থাৎ এ থেকে বোঝা যায় যিনি যত বেশি কবিতা পড়বেন এবং আবৃত্তি করবেন কবিতা তার কাছে তত বেশি ধরা পড়বে। তো বাচিকশিল্প বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই সত্তর শতকের শুরু থেকেই টিএসসি কেন্দ্রিক আবৃত্তিশিল্প। সেটা কিন্তু এখন সারা বাংলাদেশ ছেয়েছে। এছাড়া কবিতার জনপ্রিয়তা ঠিক আছে। কবিতার বই আমরা কিনি না বটে কিন্তু, কবিতা পাঠ করি, পড়ি-শুনি। এটা একটা বড় বিষয়। এর ফলে সারা বাংলাদেশে সংস্কৃতির একটা জোয়ার এসেছে এবং মৌলবাদকে যদি আমরা পরাভূত করতে চাই তাহলে কবিতা আবৃত্তির আরও জাগরণ দরকার। সারা বাংলাদেশের মানুষ, যারা কবিতা আবৃত্তি করেন, তারা কিন্তু বাংলা ভাষা বা যতদুর সম্ভব শুদ্ধভাবে আবৃত্তি করার চেষ্টা করেন। আঞ্চলিক ভাষার কবি না হলে আবৃত্তির প্রথম শর্তই হচ্ছে শুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করা। এই সব কারণে আমি বলবো আবৃত্তি কবিতার নতুন যাত্রা এবং কবিতা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বেশ ফলপ্রসূ।

আমরা দেখেছি আপনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। একজন কবির জন্য সংগঠন করা কি জরুরি? এতে কবিতাচর্চায় কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
সংগঠন আর কবিতা- বিরোধীও নয় আবার সংগঠন অপ্রয়োজনীয়ও বলা যাবে না। বিশেষত এ যাবৎ কালের সব কবিতা থেকে আরম্ভ করে সৃষ্টিশীলতার একটা একাডেমিক দিক আছে। ফলে কবিতা লিখতে গেলে সাংগঠনিক চর্চার একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কিছু কবি মিলে একটা সংগঠন যদি করে, তারা যদি কোন ধরনের নীরিক্ষা করতে চায় সে নীরিক্ষা হয় এবং সে নীরিক্ষার জন্য তারা একটা লিটলম্যাগ করে সংগঠনের মাধ্যমে। এর ফলে কবিতার বহুমাত্রিকতা অনেক বেড়ে যায়। আর যদি কেউ মনে করে আমি সংগঠন করবো না, কবিতা নিজের মত করে নি:সঙ্গভাবে লিখবো তাহলে সেটাও করতে পারেন। এই ধরনের যদি কেউ করেন সাধারণত যারা অতি নান্দনিক কবি, যারা সমাজের কি এলো গেলো এটার চিন্তা করেন না তারা এই দিকে থাকেন। তারাও অবশ্যই প্রাধান্য পাবার যোগ্য। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের ইতিহাস আর কবিতার ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ কবিতার শুরু থেকেই বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে, জাতিরাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। ফলে কবিতা এবং সাংগঠনিকতা বাংলাদেশের একটা বরাবর সমান্তরাল স্রােত হিসাবে গেছে। তো আমি বলবো কবি যে কোন একটা দিক বেছে নিতে পারেন। আমি নিঃসঙ্গ একজন ঋষির মত কবিতা চর্চা করবো এবং যখন কেউ এই কাজ করে তার কবিতা কে পড়লো আর কে পড়লো না, কে শুনলো আর কে শুনলো না তার বিচার করে না। যেমন বলা যায় লালনের কথা। আরেক ধরনের কবি আছে যারা কবিতা লিখে সে কবিতাকে তাৎক্ষণিকভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের ক্ষেত্রেও আমি বলবো কবিতার ক্ষেত্রে কাঠামোগত সঙ্গযাত্রার সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রয়োজন। আমি সব সময় জীবনের শুরু থেকেই লিটলম্যাগ করি এবং কবিতা শুধু নিজে না লিখে আমার সময়ে যারা আছে তাদেরকে, আমার পরবর্তী যারা আছে তাদেরকে কবিতা কলাকৌশলের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছি। আমিতো বলা যেতে পারে জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং এরূপ আরও অন্যান্য সংগঠনের সাথে সবসময় যুক্ত থাকতে চেষ্টা করেছি। এবং অন্য কিছুর পাশাপাশি কবিতা লেখার কলাকৌশল নিয়ে ভেবেছি। এভাবে আমি আমার নিজেরই কবিতার একটা কৌশল গড়ে তুলি। ফলে এটা আমার নিজের প্রবণতা। একইসাথে নীরবে কবিতা লেখা আর এই কবিতাটি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া।

পঞ্চাশ বছরেরও ওপর আপনি কাব্যচর্চায় নিয়োজিত। আপনার কাব্য ভাবনায় কি কখনো পরিবর্তন এসেছে? এসে থাকলে কী সেই পরিবর্তন?
তা বহু ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়। আমি সহজে বলবো যে, এটা এত সহজে বলা যাবে না। আগে মনে হত ছন্দ আর শব্দ হলেই কবিতা হয়। মোটামুটিভাবে মিল দিতে পারলেই কবিতা হয়। এখন তা মনে হয় না। কবিতার ভেতরের তল বলে একটা কথা আছে। কবিতার একটা বিমূর্ত অবয়ব বলে কথা আছে। তো এটা ঠিক রেখে কবিতা লিখতে হয়। এজন্য কখনও কম কথায় কবিতা সাজাতে হয়, আবার কখনও দীর্ঘ কবিতা লিখেও কবিতা তৈরী করা যায় না। ফলে কবিতা সম্পর্কে সচেতনতার প্রাধান্য দিতে হবে। এটাই আমি বার বার চেষ্টা করেছি এবং কবিতায় আমার আরেকটা প্রবণতা আছে। এক বই থেকে আরেক বইতে যাওয়ার আগে আমি কবিতার বিষয় এবং কবিতার যে নির্মাণ কৌশল, সেটাকে কিছুটা আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করেছি। লক্ষ্য করা যাবে, আমি অনেক সময় দীর্ঘ কবিতা লিখেছি কিন্তু দীর্ঘ কবিতা একেবারে দীর্ঘ নয়। প্রতিটি দীর্ঘ কবিতার ভিতর কোনোটায় পঞ্চাশটি, কোনটায় ত্রিশটি কবিতা আছে। এই একই সঙ্গে এটা আবার একটা নিজস্ব প্রবণতা, কৌশল এবং নীরিক্ষা যে, কখনও কখনও এক লাইনে একটি কবিতা লিখছি আবার তার সঙ্গে কখনও অজ¯্র পঙ্ক্তি যুক্ত করে গীতিকবিতাকে একটি মহাকাব্যিক আবহে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এটাই বলা যায়।

অডিও-ভিজুয়াল এবং অন্তর্জাল মাধ্যম ব্যক্তিজীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এটি কবিতার জন্য কি ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে?
না, না। আমার কখনও মনে হয় না। কবিতার দিকটি বহুরকম, বহু ধরনের। কাজেই কবিতা কাউকে শুধু মাত্র কাগজে লিখতে হবে এমন কোন কথা নেই। কবিতা নানাভাবে লেখা যায়, নানা ধরনের কবিতা। মহাকাব্য যেমন কবিতা, তেমনি একটি পঙ্ক্তি, একটি গীতিকবিতাও কবিতা। ফলে মূল কথা হচ্ছে কবিতা লিখতে গেলে কবিতার যে নির্মাণটা, সে নির্মাণ বিষয়ে সচেতন হতে হয়। কবিতা সচেতনভাবে তৈরী করে তুলতে হয়। আবার কখনও কখনও কবি নিজেই এই কাজটি করতে পারেন, যে একেবারে উপন্যাস লেখার মত করে, গল্প লেখার মত করে, আগে থেকেই তৈরী করে একটা ছক এঁেকও কবিতা তৈরী করতে পারেন। এটা হলো ধ্রুপদি কৌশল। আর রোমান্টিক কৌশল হচ্ছে কোন কিছু চিন্তা না করে সৃজন করা। তো আমার মনে হয় পৃথিবীর কোন নতুন কৌশল যেমন অন্তর্জাল, এটা ক্ষতিকর হতে পারে না। কারণ অন্তর্জাল প্রথম দিকেই আমার কাছে অভিনব বলে মনে হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে অন্তর্জাল আমাদের বড় একটা অভাবকে পূরণ করে দিয়েছে। সেটি হচ্ছে এই অন্তর্জাল সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে পৃথিবীতে এক জায়গা থেকে সমস্ত বিশ্বের মানুষের সাথে যুক্ত হতে পারা যায়। এটা আমাদের বৈজ্ঞানিক যে আবিষ্কার, সেই আবিষ্কারেরই একটি ফল। আমরা দেখেছি পৃথিবীতে সব সময় নতুন আবিষ্কার এসে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। অনেক রকম সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে কিন্তু, অন্তর্জালে যা হচ্ছে তাতে সীমাবদ্ধতার চেয়ে প্রসারতা অনেক বেশী বেড়ে গেছে বলে আমার মনে হয়। অন্তর্জালের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এখন হাইব্রিড পদ্ধতিতে পৃথিবীর সব কিছুই করি। হাতে লিখি অথবা তা বই হিসেবেও প্রকাশ করি আবার তা অন্তর্জালে দিয়ে দেই এটা হলো কবিতার ক্ষেত্রে। কোনো উৎসবের ক্ষেত্রে আমরা একটা নির্দিষ্ট স্থানে বসে সেই বিষয়গুলোর অনুষ্ঠান উপভোগ করছি এবং অন্তর্জালের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমি কবিতা লিখছি, লিখে নিজে নিজে পাঠ করছি তা অন্তর্জালে পাঠ করছি। এর ফলে কবিতা একটি করণিক প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ পারফর্মিং আর্ট হিসেবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কাজেই অন্তর্জাল আমাদেরকে নতুন একটা আঙ্গিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এতে নতুন সম্ভাবনা এসেছে। একে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে আমাদের গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

আপনার বন্ধুদের অনেকেই প্রয়াত। সময়টাও বন্ধুর, করোনাকাল কিছুতেই কাটছে না। আগামী দিনগুলোর জন্যে আপনি কি বিশেষ কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন যা আরাধ্য রয়ে গেছে?
না, প্রথমত আমার যেসব বন্ধুরা চিরজীবন লাভ করেছেন, তাদের সম্পর্কে মারা গেছেন এটা বলি না। এই আমাদের এই জীবনটা খ- জীবন। চিরজীবন প্রত্যেকেই পাবেন। সৈয়দ শামসুল হক যখন মারা গেলেন তখন আমি বলেছিলাম চিরজীবনের কথা। তখন থেকে এই কথাটাই প্রচলিত, চিরজীবিত। তো আমরা যাকে মৃত্যু বলি তা প্রকৃত অর্থে মৃত্যু নয়। মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা সেই চিরজীবনেরই তল্লাশি করি। কেউ করোনায় যায়। এর আগেও পৃথিবীতে অনেক মহামারী অতিমারী হয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও হতে পারে। মানুষ কোনো না কোনো ভাবে যখন তার শরীরের ইমিউনিটি কমে যায় অর্থাৎ জীবনীশক্তিটা যখন কমে যায়, তখন যে কোন রোগেই মানুষ মারা যেতে পারে। তাছাড়া করোনাকে বড় কিছু হিসাবে ভাবছি না, শুধু এইটুকু বলছি করোনা একটা অতিমারী। যারা চলে গেছেন যেরূপ কারণেই চলে যান, গিয়ে থাকেন, আমার বন্ধুবান্ধবদের জন্য, তাদের জন্য আমি শোক জ্ঞাপন যেমন করি। পাশাপাশি শুধু এইটুকু বলি তাদের কর্মেরই জন্য তারা যেন জীবিত থাকেন এবং এটাই বড় কথা। করোনার সময় আমি আমার মত করে লড়াই করে চলেছি। আমি আমার জানা নিরাময় বিদ্যা হোমিওপ্যাথি সেটা দিয়ে লড়াই করেছি এবং তার চেয়ে বড় কথা হলো জীবনযাপন করার জন্য সদাচার জীবনযাপন করা। এই দুইটা যদি করা যায়, তাহলে পৃথিবীতে যেকোন এপিডেমিক বা অতিমারির সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় বলে আমি মনে করি। এই সময় মানুষ অন্তত এইটুকু বুঝতে পেরেছে, সঙ্গবদ্ধতার মাধ্যমেই সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে এক সঙ্গে এক দিকে যাওয়া যায়। বিশ্বের এক প্রান্তে মানুষ মরছে আরেক প্রান্তে বেশ ভালো আছে। এই দূরত্বটাকে ঘুচিয়ে দিতে হবে। দিতে হলে কি করতে হবে একটা বৈশ্বিক ইউনিটি অর্থাৎ একটা বৈশ্বিক সঙ্গ যাত্রার প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি। সেভাবেই আমি একটি সঙ্গ যাত্রার ভিতরে আছি। আমি শুধু নিজের মধ্যে থাকি না। আবার যারা বয়স্ক লেখক তারা পরিকল্পনা করে কিছু করে এমন নয়। তারা যেটা করে, চলমান যে সময় সে সময়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে যখন যা বলার তা বলে। এই সময় যে অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতাই কাজে লাগবে ভবিষ্যতে, এই ধরনের যে পরিস্থিতি যোগ হতে পারে সেগুলোকে আমরা কিভাবে মোকাবেলা করবো এটা ঠিক কবিতার ব্যাপার নয়, এটা মানুষ হিসেবে নিজেকে এবং সারা পৃথিবীকে বিপন্নতা থেকে কোন ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করার একটা চিন্তা থেকে আমার মনে উদ্ভূত হয়েছে এবং আমি আমার লেখালেখির মধ্যে এটার প্রয়োগ করেছি। আমি বার বার বলি মুহূর্র্তবাদই অনন্ত, অনন্তবাদই মুহূর্ত। আপনার প্রতিটি মুহূর্তকে আপনার কর্মময় করতে হবে, ইতিবাচক করতে হবে এবং সময়ের কোন বিভেদ নেই। এই যে আমরা সকাল, বিকাল, দুপুর বলি এগুলো সব একই। কি বলবো, একটা সময় ছিল অষ্টপ্রহরের কথা বলা হতো। এই যে আমি শুভসময় বলি, শুভ প্রভাত না বলে, শুভ সকাল না বলে, শুভ রাত্রিও আমি বলি না। শুভ রাত্রি বললে তো সময় শেষ হয়ে গেল। অর্থাৎ কথা হচ্ছে, আসুন আমরা আমাদের সময়টাকে ভালো করি এবং ভবিষ্যতের যে সময় আসছে তাতে নিরাপদ থাকি।

কবি আবুল হাসানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। মোশতাক আহমদের কলমে তাঁকে নিয়ে ডকু ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সেটি পড়ে থাকলে তার প্রেক্ষিতে কিছু বলুন। সেইসঙ্গে আপনার কাছে বিশেষ অনুরোধ করছি একটু সবিস্তারে কবি আবুল হাসানের স্মৃতিচারণ করবার জন্যে।
আবুল হাসান আমার শুরুর সময়ের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ের বন্ধু। তবে আমরা সহপাঠী ছিলাম না, সহ কবি ছিলাম। আবুল হাসান আমার এক বছর কি দুই বছর আগে যুক্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিয়মিত লেখাপড়া করেননি। যাই হোক, আমরা দীর্ঘদিন মহসীন হলের  ২৬৫ নম্বর রুমে ছিলাম। একই হলে আমরা একই সঙ্গে থাকতাম। আসলে এটা আমাদের রুম ছিল। একটা নিজস্ব রুম, তাতে অনেক কবি এসে রাতে থাকতেন। ঐ সময় আবুল হাসানই সব চেয়ে বেশি থাকতেন, কারণ বোহেমিয়ান কবি তো, থাকার তেমন একটা জায়গা ছিল না। তার কবিতা আমি শুরু থেকে পছন্দ করতাম। আমি তার অনেকগুলো কবিতা লেখার স্বাক্ষী। বাবাকে নিয়ে যে কবিতা লিখেছেন তিনি সে কবিতাটি, ‘চামেলি হাতে নিম্ন মানের মানুষ’। এমন অনেক কবিতা। কবিতা লেখার সময় আমি মনে করি ভালো কবিতা পাঠ করা প্রয়োজন। এটা আমি বিশেষভাবে দেখেছি আবুল হাসানের মধ্যে। তখন ‘পোয়েট্রি’ নামের একটা কবিতা পত্রিকা বের হত আমেরিকা থেকে। এখনও বের হয় বোধহয়। সারা পৃথিবীর এর বিশেষ প্রভাব ছিল। নতুন ধরনের কবিতা, নতুন আঙ্গিকের কবিতা আমরা দেখতাম। যেমন একটি কবিতা বলি, নাইট। নাইট বলে এক কবি কবিতা লিখতেন। তিন চার পৃষ্ঠা শুধু নাইট নাইট নাইট নাইট ছিল। তখন আমি বুঝতে পারিনি কি হলো। পরে যখন উচ্চারণ করলাম তখন দেখলাম যে, নাইট নাইট নাইট নাইট নাইট অনেকটা যিকিরের মত। অনেকটা যারা মুসলমানরা যিকির করে আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু। এই রিপিটেশনটা কি করে, মানে, ব্যক্তি যা উচ্চারণ করে তার সম্পর্কে একটা প্রবল বিচিত্র সব ধারণা তৈরী করে। তো নাইট বলেও পৃথিবীতে কত বিচিত্র ধরনের নাইট আছে সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আবুল হাসান আর আমি খুবই মজা পেতাম। কিন্তু আমরা সেই ধরনের কবিতা আর লিখিনি। আবুল হাসানের একটা প্রবণতা ছিল অনেক লিখবে, লিখে ছিঁড়বে। ওর তিনটি গ্রন্থ বেরিয়েছিল, ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ কর’, ‘পৃথক পালঙ্ক’। এরপরেও তার যেমন আরো কবিতা আমরা দেখেছি, যে কবিতাগুলো অভ্রান্তিকর ছিল, সেগুলোর প্রশংসাও আমি করেছিলাম। আমি সম্পাদক ছিলাম, আমার সঙ্গে ফকরুল ইসলামসহ আরো অনেক পরিণত কবিও ছিল। এসব হয়েছে কিন্তু, আমি বলবো যে আবুল হাসান যা লিখেছে তার দশ গুণ বেশি নিজে লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন যদিও তার নতুন নতুন কবিতার দর্শন আবিষ্কৃত হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা যতখানি তাৎক্ষণিক, তার চেয়ে অনেক বেশি অধ্যাবসায়ের কথা সেটা। যে জন্য আবুল হাসানের কবিতার শব্দ যদি আমরা পড়ি, দেখতে পাব প্রতিটি শব্দের অনিবার্যতা। এ কারণে এখন পর্যন্ত আমি যদি বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতম কবিদের কথা বলি, যেমন জীবনানন্দের কথা বলা হয়, ঠিক তেমনিভাবে একজন শুদ্ধতম কবির নাম আবুল হাসান। তার কোন কবিতা পাঠ করলে মনে হয় যে, এটাই তো হবে, আর কি হবে। অর্থাৎ কবিতার শুধু বিষয়গত দিক নেই, বাণীময়তার মাধ্যমে কবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। প্রকৃত কবিতার মধ্যে থাকে একটা অন্তর্গত মধুময়তা, যেটাকে আমরা বলি নান্দনিকতা। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার এবং আমার সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ নান্দনিক কবি আবুল হাসান। আমার সৌভাগ্য আমি তার বন্ধু ছিলাম। যখন তার অকাল মৃত্যু হলো তখন আমি বলেছিলাম আমি একজন ব্যক্তিবন্ধুকে হারালাম, আমি একজন কবি শত্রুকে হারালাম। কবি শত্রু ভালোবেসে বলেছিলাম। এমন কবিকে ভালোবেসে আসলে প্রতিযোগিতা করা যায়। তাহলে নিজের কবিতাও বেড়ে যায় এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলে গাছগুলো বড় বড় হয়। এই জন্য বড় হয় যে, ঘন বনে পাশাপাশি বৃক্ষরাজি আছে। এক বৃক্ষ যখন আকাশের দিকে উঠে যায়, পাশের বৃক্ষটি পাল্লা দিয়ে যায়। আর যেখানে শুধু ঘাস আর ঘাস,  কোন বৃক্ষ নেই সেখানে বড় বৃক্ষ গজায় না। তো আমি বলবো যে কোন সময়, যে কোন সমাজে, যে কোন দেশে আবুল হাসানের মতো শতভাগ কবি-হৃদয় ও নান্দনিক পরিশীলন সম্পন্ন কবি প্রয়োজন। তাহলে ঐ কবিতার আবহটি পরিপূর্ণ কবিময় হয়ে উঠবে। আমি আমার কবি বন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আবুল হাসান।
=-=-=-=-=-=-