করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে কথোপকথন
জীবনকে ব্যবচ্ছেদ করাই আমার কাজ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মাসউদুল হক


শাহাদুজ্জামান বর্তমান বাংলা কথাসাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তবে শুধু কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ না বলে শিল্প-সাহিত্য জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক বলাই শ্রেয়। কেননা, কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি বিস্তৃত হলেও তিনি চলচ্চিত্র, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, নাটক, প্রবন্ধ, কলাম লেখা ইত্যাদি প্রায় সব ধারায় বিচরণ করেছেন। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় বিচরণের প্রভাবে তাঁর কথাসাহিত্য স্বতন্ত্র্য একটি ধারায় প্রসারিত হয়েছে। নিজের মধ্যে বিরাজমান অপরিসীম কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তিনি সমাজকে যেমন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সে-ই সাথে প্রতিনিয়ত জ্ঞান অন্বেষণে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। ফলে সময়ের সাথে সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে, ভাবনার দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে । এই পরিবর্তনের প্রভাব তার রচনায় খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা যায়। ১৯৯৬ সাল থেকে লেখক শাহাদুজ্জামানকে ব্যক্তিগতভাবে অনুসরণ করছি। শাহাদুজ্জামান নিজে যেমন লেখার মধ্যে দিয়ে কোন লেখককে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতেন, এ সাক্ষাৎকারটি সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি বলা যায়। শুধু সাক্ষাৎকার প্রদানকারি এবং সাক্ষাৎকার গ্রহনকারির স্থান পরিবর্তন ঘটেছে।

 
মাসউদুল হক : আপনার লোখালেখির শুরুর সময়টা কবে বলে মনে করেন?
শাহাদুজ্জামান : আমি লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করি ১৯৮৩/৮৪ দিকে। মূলত অনুবাদ, প্রবন্ধ এসব লিখেছি। পরে গল্প লেখা শুরু করি মুলত নব্বুই দশকের গোড়ার দিকে। আমার প্রথম গল্পের বই বের হলো  ১৯৯৬ তে। 
মাসউদুল হক :  আপনি যে সময় সাহিত্য রচনা শুরু করেন তখন সাহিত্যের বিষয় হিসেবে গ্রামীণ সমাজ ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছে।  নতুন যারা কাজ শুরু করেছেন তাদের সাহিত্য রচনায় মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে মধ্যবিত্ত সমাজ বা তার সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা Ñ এইসব নিয়ে কাজ করা শুরু হয়েছে। তেমন একটি প্রেক্ষাপটে আপনি কিন্তু একেবারে একটা ভিন্ন ধারায় লেখা শুরু করলেন। এটা কি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন নাকি আপনার কাছে মনে হয়েছে, নতুন কিছু লিখবো?
শাহাদুজ্জামান : সাহিত্যে গ্রামীণ সমাজের গুরুত্ব সেভাবে কখনই কিন্তু আসলে হারায়নি। তবে আমি কেন এই বিশেষ ধারার লেখা লিখতে শুরু করলাম সেটার উত্তর দিতে গেলে আমার লেখালেখির সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে। যেটা বললাম যে আমি লেখা শুরু করেছিলাম অনুবাদ দিয়ে। ইন্টেলেকচুয়াল সব বিষয় অনুবাদ করতাম তখন। মুলত মার্ক্সিষ্ট এসথেটিক্স নিয়ে। লেখক হবার জন্য এসব লেখা তখন অনুবাদ করিনি। আমি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। আমার তখন একাধারে রাজনীতি আর সাহিত্য উভয় ব্যাপারেই সমান আগ্রহ। এদুটার মধ্যে কি সম্পর্ক সেটা বোঝার জন্য নানারকম ইংরাজী লেখাপত্র পড়তাম। একসময় মনে হলো এগুলো অনুবাদ করে অন্যদের সাথে শেয়ার করা দরকার। এটা বিশেষভাবে মনে হলো কারণ আমি তখন বামপন্থী একদল তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর সাথে ঘোরাঘুরি করতাম। দেখতাম তাদের মিটিং মিছিলে যত আগ্রহ জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাপারে তত আগ্রহ নাই। কিন্তু তারা রাজনীতি শিল্প নিয়ে নানা কথাবার্তা বলতো। তাদের সাথে তর্ক বিতর্ক করতে গিয়েই আমি এইসব লেখাপত্র পড়তে শুরু করি এবং মনে হয় অনুবাদ করলে এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক কি সব চিন্তাভাবনা হচ্ছে সেটা হয়তো অনেকের জানার সুযোগ হবে। সুতরাং ঠিক লেখক হবার মোটিভেশন থেকে না , একেবারে ভিন্ন একটা মোটিভেশন থেকে লিখতে শুরু করা। অবশ্য একপর্যায়ে টের পেলাম সক্রিয় রাজনীতি  আমার কাজের জায়গা না। আমি শিল্প সাহিত্যের নানা মিডিয়ার ব্যাপারে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। আমি আশির দশকে ফিল্ম, নাটক, পেইন্টিং, মিউজিক এসব মিডিয়ার সাথে খুবই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। তো গল্প যখন লিখতে শুরু করেছি তাতে অন্যান্য সব শিল্প মাধ্যমের সাথে আমার যে যোগাযোগ, রাজনীতির সাথে যে যোগাযোগ তার একটা প্রভাব পড়েছে। নানা মিডিয়ায় এক্সিপেরিমেন্টাল যেসব কাজ হয়েছে সেগুলো আমাকে ইন্সপায়ার করেছে। আমার লেখার নিরীক্ষাধর্মিতার সাথে এইসব অভিজ্ঞতার একটা সম্পর্ক আছে।
মাসউদুল হক :   তাহলে কি আমরা ধরে নিব আপনার প্রস্তুতিপর্ব বা আত্ম-নির্মাণকাল গত-শতকের আশি’র দশক?
শাহাদুজ্জামান : আশির দশকের মাঝামাঝি আমি লিখতে শুরু করি কিন্তু প্রস্তুতিপর্ব ঠিক কখন শুরু হয় সেটা তো এমন সরাসরি বলা যাবে না। আর আমার ক্ষেত্রে তো বলেছি যে লেখক হব এটা ভেবে কোন সচেতন প্রস্তুতি ছিলো না। আমার পরিবারের ভেতর সাহিত্য, গান বাজনা ইত্যাদির চর্চা ছিলো। ফলে শুরুটা সেখান থেকে। আমি ক্যাডেট কলেজে পড়েছি, সেটা রেজিমেন্টেড লাইফ তুমি জানো, কিন্তু সেখানে দুএকজন শিক্ষক, বন্ধু এদের সুত্র ধরে সাহিত্যের আগ্রহটা জিইয়ে থেকেছে। তবে ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে মুক্ত জীবনে এসে বলা যায় প্রথম শিল্পসাহিত্য নিয়ে মশগুল হওয়ার সুযোগ আসলো। আমি মেডিকেলে পড়লেও দেখলাম আমার মন পড়ে থাকে গান বাজনা, সাহিত্য,  নাটক, ফিল্ম  এগুলোর দিকে। চিটগাংয়ে থাকতে কলেজের অনুষ্ঠানে গান বাজনা, আবৃত্তি ইত্যাদিতে নিয়মিত অংশ নিতাম। চিটাগাং রেডিওতে গান করতাম, চিটাগাং ফিল্ম সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারী ছিলাম, এছাড়া অঙ্গন গ্র“প থিয়েটারের সাথেও যুক্ত ছিলাম, যুক্ত ছিলাম ‘সময়’ পেইন্টার্স গ্র“পের সাথে। মোটকথা  শিল্পসাহিত্যের সবগুলো মিডিয়ার সাথে একটা সক্রিয় যোগাযোগ আমার ছিলো তখন। আর্ট, কালচারের জগতের একধরনের ঘোর তৈরী হয়েছে তখন বলতে পারো। নানারকম বইপত্র পড়তাম, প্রচুর ফিল্ম দেখতাম।  চিটাগাং আঁলিয়স ফ্রসেস তখন প্রতি সপ্তাহে ফিল্ম দেখাতো, চিটাগাংয়ে যখন থেকেছি আমি কোন সপ্তাহ মিস দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। তারপর তখন ভিসিআর এলো। কত রকম কসরত করে তখন ভারতীয় মাস্টারদের ছবি দেখতাম। আমি নাটকেরও নিয়মিত দর্শক ছিলাম। চিটাগাং থেকে গিয়ে ঢাকাতে নাটক দেখতাম। আশির দশকে এমন কোন প্রধান নাটক সম্ভবত নাই যেটা আমি দেখিনি। যাহোক আমি একসময় ফিল্ম মেকিংয়েও জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। ঢাকায় তখন ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স শুরু হলো, সেটা করলাম। তারেক মাসুদ একই ব্যাচে কোর্সটা করেছিলো, আমরা একসঙ্গে কিছু কাজও করেছিলাম শুরুতে।  যাহোক, সেসব অন্য কাহিনী। আরেকটা লেখায় আমি সেসময়টা নিয়ে লিখেছি। এসব কথা বলছি কারণ আমার প্রস্তুতিপর্র্বের কথা যদি বলো তাহলে আমার লেখালেখি শুরুর আগের এইসব কর্মকাণ্ডগুলোকে স্মরণ করতে হয়। আমি এসময় বিশেষ করে রাজনীতি আর শিল্পসাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। আগেই বলেছি এসব নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে শুরু করলাম। মূলত অনুবাদ। বলতে পারো বিখ্যাত সব লেখকদের লেখা অনুবাদ করে আসলে তাদের আড়ালে গিয়ে নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছি। এরপর ধরো শিল্প সাহিত্য যারা সৃষ্টি করে তাদের ক্রিয়েটিভ প্রসেসটার ব্যাপারে আমার আগ্রহ তৈরী হলো। সেই সুত্র ধরে কিছু ক্রিয়েটভ মানুষের ইন্টারভিউ করি। আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, এস এম সুলতান এদের ইন্টারভিউ করেছি। সেগুলো আমার কথা পরম্পরা বইটাতে আছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে অনুভব  করলাম আমার যে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো হচ্ছে, নিজে যে নানারকম দ্বন্দ্ব, সংশয়, প্রেম, দ্বিধা এই সব ঘটনার মধ্যে যাচ্ছি সেগুলোতে এই অনুবাদের ভিতর দিয়ে বা অন্যের সাক্ষাৎকারের ভেতরও প্রকাশ করা যাবে না। আমার নিজের কথাগুলো বলার একটা জায়গা তৈরির জন্য আমি প্রথম গল্প লিখি।  সে গল্পটার নাম, ‘অগল্প‘। তুমি পড়েছ নিশ্চয়ই। লক্ষ করেছ যে ওটা আসলে ঠিক প্রচলিত ন্যারেটিভের গল্প না। বরং বলা যায় এ্যান্টি ন্যারেটিভ গল্প। একটা গল্প বলে সেটাকে আবার ভেঙ্গে দেয়া। এ ব্যাপারে আসলে আমি প্রভাবিত হয়েছি নাটকের ব্রেখট দিয়ে, ফিল্মের গদার দিয়ে। এই গল্পটা যখন লিখছি তখন এদের কাজ খুব দেখছি। তাছাড়া শুরু থেকেই আমার এ্যাক্সিপেরিমেন্টাল শিল্পসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিলো। এমনকি গানের ক্ষেত্রেও আমি সেই আশির দশকের গোড়াতেই মহিনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তারা এখন আলোচিত হচ্ছে কিন্ত বাংলা গানে ঐ ধরনের এক্সপেরিমেন্টের তারাই পাইওনিয়ার। তো এভাবেই নানা মাধ্যমের এক্সপেরিমেন্টের প্রভাব আমার উপর পড়েছে যার ফলে আমার গল্পগুলো অমন হয়েছে। আমি এরকম গল্প লিখব এমন সচেতন কোন পরিকল্পনা ছিলো না। এই যে নানা শিল্প মাধ্যমের ভেতর চলাফেরা করেছি সেটা আমার আত্ম নির্মাণে ভুমিকা রেখেছে মনে করি।
মাসউদুল হক : সচেতনভাবে না হলেও অবচেতনভাবে এই প্রস্তুতিপর্ব আপনার লেখায় হয়তো প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে যে, আপনি যে ফরম্যাটে এ কথা বলতে চাইছেন সেটা আসলে শেষ পর্যন্ত পাঠকের কাছে পৌঁছুবে কি, সেটা কি আপনার ভাবনার বিষয় ছিল না?
শাহাদুজ্জামান : পাঠকপ্রিয় হওয়া, জনপ্রিয় হওয়া এসব আমার ভাবনার মধ্যে একেবারে কখনোই ছিলো না। বরং পাঠকপ্রিয় না কিন্তু মেধাবী, যারা আমার পাঠের অভ্যাসকে আঘাত করে এমন লেখকদের ব্যাপারে আমি আগ্রহ হয়েছি। যেমন কমলকুমার মজুমদার একসময় আমাকে আকর্ষণ করেছিলো। তিনি নিজের জন্য একধরনের সান্ধ্য ভাষা তৈরী করে নিয়েছিলেন। আমি নিজে কোনদিন এধরনের ভাষায় লিখব সেটা কোনদিন চিন্তা করিনি কিন্ত তার সাহসটাকে এনজয় করতাম। তিনি একবার বলেছেন ভাষাকে যে আঘাত করে সে ভাষাকে বাঁচায়। আসলে জনপ্রিয় হওয়া, পাঠকপ্রিয় হওয়া এসবের চাইতেও লেখার পুরো প্রক্রিয়াটা, জগতটা অনেক বড় ব্যাপার, ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার। আবার ‘আমি জনপ্রিয় ধারায় লিখি না’ সেটা প্রমাণ করতে জোর জবরদস্তি করে ভাষার ইঞ্জিনিয়ারিং করে লেখাকে দুর্বোধ্য করে এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়ালপনা করার প্রবণতাও আছে। আমি সেটার ব্যাপারেও সতর্ক থেকেছি। জনপ্রিয়তা কোন দোষের ব্যাপার না। একাধারে মেধাবী এবং জনপ্রিয় এমন লেখক পৃথিবীতে আছে। আসলে নিজের কথাটা সৎভাবে, সত্যিকার ভাবে বলতে যে ভাষা, যে আঙ্গিক দরকার সেটা ব্যবহার করলে সেটা পাঠকের কাছে কোন না কোনভাবে পৌঁছায় আমি সেটাই বিশ্বাস করি।  যখন লিখতে শুরু করেছি তখন এ লেখা কয়জন পড়বে সেটা ভাবিনি। মনে হয়েছে এটা লেখা দরকার তাই লিখেছি। আগেই বলেছি আমি বহুদিন শুধু লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছি। বড় পত্রিকায় লিখিনি। তখন তো পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদকের সাথে দেখা করা, নানা রকম সাহিত্যিক গোষ্ঠী করা এসব খুব ছিলো, এখনও আছে। সাহিত্য জগতে নানা গুরু শিষ্যের ব্যাপার থাকে, ওগুলোর মধ্যে আমি ছিলাম না কখনো।  লেখা ছিলো আমার একেবারে নিজের সঙ্গে নিজের মোকাবেলার একটা জায়গা। বড় পত্রিকায় আমি একসময় যখন লেখা পাঠাই সেটাও পাঠিয়েছি পোষ্ট করে। পত্রিকার কাউকেই চিনতাম না। আমার প্রথম দিকের গল্পগুলো ছাপা হয়েছে সংবাদে, ভোরের কাগজে, সাহিত্যপত্রে। এইসব পত্রিকার সম্পাদক কাউকে তখন চিনতাম না।  আমার লেখা ছাপানোর অনেক পরে তাদের সাথে পরিচয় হয়। যেটা বলতে চাচ্ছি যে লেখক হিসেবে বহু লোকের কাছে পরিচিত হওয়া, নাম ডাক হওয়া এসবের ইন্সপিরিশনে আসলে আমি লিখিনি। আমি স্কুল, কলেজের ম্যাগাজিন এসবে কখনো লিখিনি। আমার একেবারে প্রথম লেখা ছাপা হবার কথাটা বলি। আমি তখন চিটগাং মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, কিন্তু গান, নাটক, ফিল্ম এসব নিয়ে থাকি। সেখানে আমার এক সিনিয়ার বন্ধু আছেন মিলন চৌধুরী , নাটকের মানুষ। তার এক ধনবান ব্যাবসায়ী সাহিত্যপ্রেমিক বন্ধু ছিলেন, উনি তাকে বললেন একটা লিটল ম্যাগাজিন ফাইন্যান্স করতে। আর আমাকে বললেন, আপনি তো নানা বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করেন, এসব নিয়ে লেখেন। তো তার চাপাচাপিতেই আমি প্রথম অনুবাদ করতে শুরু করি। সেটা ছাপা হয় ‘চর্যা‘ নামের সেই লিটল ম্যাগাজিনে। বেশ কয়েকটা সংখ্যা বেরিয়েছিলো সেই পত্রিকাটার, সেখানে নিয়মিত লিখেছি। পরে ‘প্রসঙ্গ‘ নামে আমরা ক’জন মিলে নিজেরাই নতুন ধরেন মাল্টিডিসিপ্লিনারী একটা পত্রিকা করি। সেসময় এধরনের পত্রিকা ছিলো না যেখানে সাহিত্য, ফিল্ম, নাটক, পেইন্টিং এসবের একটা কমপারেটিভ আলোচনা হতো।  ‘প্রসঙ্গ‘ সেই দিক থেকে ছিলো ব্যাতিক্রমী একটা পত্রিকা। আমি অন্যের মুখাপেক্ষি হয়ে লিখিনি। নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছি। গৌতম বুদ্ধের সেই কথাটা যে ‘নিজে নিজের প্রদীপ হও’, আমার পছন্দের কথা। এটা আমার বিশ্বাস যে, কেউ যদি নিজের প্রতি সৎ থাকে তবে সেই সততা কোথাও না কোথাও গিয়ে  স্পর্শ করে। তুমি যে জানতে চাইলে লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছাবে কিনা সেটা আমার কাছে কোন চ্যালেঞ্জ ছিলো কিনা। না আমি এটা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলাম না। শুরু থেকেই আমার এমন একটা ভাবনা ছিলো যে পাঠকের রুচিকে শুধু ফলো করলে হবে না, গাইডও করতে হবে।
মাসউদুল হক : আপনার মধ্যে কিন্তু কবি-সত্তা প্রবল।  ’কাঁঠালপাতা ও একটি মাটির ঢেলার গল্প’ এই গল্পের লাইনগুলি যদি একটার পর একটা সাজানো যায় তবে ভাল একটা কবিতা পেয়ে যাই। আপনি কি কবিতা লিখতেন বা লিখেন?
শাহাদুজ্জামান :  না কবিতা আমি সেভাবে লিখিনি কখনো। হ্যাঁ, ক্লাস নাইন টেন থাকতে একটু চেষ্টা করেছিলাম, তারপর আর কখনো লিখিনি। কিন্তু কবিতার আমি একেবারে পেটুক পাঠক। বাংলা সাহিত্যের মোটামুটি সব ধারার কবিতা আমি পড়ার চেষ্টা করেছি। এখনও নিয়মিত কবিতা পড়ি। এই গল্পটা আসলে একটা কবিতা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েই লেখা।
মাসউদুল হক : এই জন্য আমি বলছি যে, আমি খুব ক্রিটিক্যালি আপনার লেখার যে পরিবর্তনগুলো তা নব্বুইয়ের দশকের প্রথম থেকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছি। আচ্ছা ইংরেজিতেও তো আপনার একটা বই বেরিয়েছে ইউপিএল থেকে।
শাহাদুজ্জামান: হ্যাঁ, সোনিয়া আমিন আমার কয়েকটা সিলেক্টেড গল্প অনুবাদ করছেন যেটা ইউপিএল থেকে বের হয়েছে,  ‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস অ্যান্ড আদার স্টোরিজ‘ নামে।
মাসউদুল হক : আমার একটা অবজারভেশন হচ্ছে, রোমান্টিকতা মানুষের জীবনে সবসময় এগজিস্ট করে। তরুণ বয়সে আরো বেশি এগজিস্ট করে। কিন্তু বর্তমানের কথা বাদ দিলাম, আপনি যৌবনে যে লেখাগুলো লিখছেন সেগুলোতেও সে-ই অর্থে রোমান্টিকতার এগজিস্টেন্স কম। আপনাকে তরুণ বয়স থেকেই চরম বাস্তববাদি  বা মেনটালি খুব ম্যাচিউরড  মনে হয়েছে।  সমবয়সীদের সাথে কি ছোট বেলা থেকে আপনার একধরনের কমিউনিকেশন গ্যাপ ছিল?
মাসউদুল হক : রোমান্টিকতা বলতে তুমি সম্ভবত প্রেমের ব্যাপার বোঝাচ্ছ। তথাকথিত প্রেমের গল্প আমি লিখিনি সেটা ঠিক। তবে আমার ‘আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা‘ কিম্বা ‘জোৎ¯œালোকে সংবাদ‘ এগুলো তো গভীর অর্থে প্রেমের গল্প, রোমান্টিক গল্প। তবে হ্যাঁ প্রেম বিষয়ে লেখালেখি করার ব্যাপারে একটু সতর্ক থেকেছি। সতর্ক না হলে এসব বিষয়ে লেখা খুব সেন্টিমেন্টাল ধাঁচের হয়ে উঠে। তাছাড়া তারুণ্যে দেখতাম, যারা নতুন লিখতে চাচ্ছে তাদের অধিকাংশের লেখার বিষয় প্রেম। এসব আমার কাছে খুব ছেলেমানুষী মনে হতো, ফলে খানিকটা সচেতনভাবেই ঐ প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে গেছি। এটা ঠিক যে এক বয়সে যখন আমার অনেক বন্ধুদের ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা হচ্ছে প্রেমে পড়া আমি তখন রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য এসব নিয়ে ব্যস্ত, ফলে সমসাময়িকদের সাথে আমার একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ ছিলো কথাটা সত্যি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। আমি চরম বাস্তববাদী তা ঠিক না, আমি খুবই আবেগপ্রবণ, আমি প্রেমও করেছি কিন্তু বলতে পারো আবেগের চাইতে মনন আমাকে গাইড করে বেশী।
মাসউদুল হক : আপনি যে কোন জিনিস যখন দেখেন তখন আসলে শুধু ঐ ঘটনাটাই দেখেন না একটা বড় পারসপেকটিভ নিয়ে দেখেন। ধরুন যে, কাঁঠালপাতা ও মাটির ঢেলা গল্পে আপনি কিন্তু রূপবান এর কাহিনীকে ব্যবহার করতে যেয়ে শুধু রূপবানকে দেখছেন না সাথে শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে এক শিশু কোলে নিয়ে পুরান কথার এক বালিকা যে একটা বনের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে- তার ভীত-সন্ত্রস্ত মুখচ্ছবিও অনুভব করছেন। এ ধরনের প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনি ফিল্ম  তৈরি করতে পারতেন।  কিন্তু সে জায়গায়ও পরে আর কাজ কনেননি।
শাহাদুজ্জামান : আমার ভাবনা, প্রস্তুতি এগুলোর ভেতর এতটা মাল্টিডিসিপ্লিনারী ব্যাপার আছে। আমার একটা বইয়ে আমি বলেছি যে  আলবেরুনীর একটা কথা আমার পছন্দ, উনি বলেছিলেন আমি দীর্ঘ জীবন চাই না, বিস্তৃত জীবন চাই। এই বিস্তৃত জীবনের লোভেই আমি নানা ডিসিপ্লিনে চলাচল করেছি, বিভিন্ন আর্ট মিডিয়া, দর্শন, রাজনীতি ইত্যাদি আমাকে আকর্ষণ করেছে। লোকসাহিত্য আমার ব্যাপক আগ্রহের বিষয়, ফলে যখন লিখি তখন এইসব নানা ডিসিপ্লিনের ভাবনাকে লিঙ্ক করার চেষ্টা করি। কাঁঠাল পাতার গল্পটা ছাড়াও আমার অনেক গল্পেও এমন নানা ভাবনার কানেকটিভি তুমি দেখতে পাবে। ফিল্মে কাজ করার ক্ষেত্রে এধরনের দৃষ্টিভঙ্গী একটা বাড়তি সুবিধা হয়তো হতো। তোমাকে আগেই বলেছি ফিল্মে কাজ করার ব্যাপারটাকে আমি একসময় খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। ফিল্ম আর্কাইভে কোর্স করেছিলাম, ১৬ মিলিমিটিারে একটা শর্ট ফিল্মের শুটিংও করেছিলাম, এমনকি একসময় মস্কো ফিল্ম ইন্সটিউটে ভর্তি হবার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। তবে ফিল্মে ক্যারিয়ার করার জন্য বাংলাদেশের যে ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হয় সেটা আমার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না টের পেয়েছি, ফলে ফিল্মি অভিযাত্রা বেশীদূর অগ্রসর হয়নি। তবে ফিল্ম নিয়ে বরবার লেখাপত্র করেছি, এনিয়ে আমার বইও আছে ‘চলচ্চিত্র, বায়োস্কোপ প্রভৃতি’ নামে।
মাসউদুল হক : আপনার বাবা উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আপনি ৭০ এর দশকে ক্যাডেট কলেজের মতো জায়গায় পড়াশোনা করেছেন। পরে পড়াশোনা করেছেন মেডিক্যাল কলেজ-এ। আপনি আজন্ম শহরে ছিলেন। গ্রামে হয়তো  গিয়েছেন তবে তা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। সে অর্থে কি আপনাকে আরবান লেখক বলা যায় না?
শাহাদুজ্জামান : ঠিক গ্রামে আমি বড় হয়নি কিন্তু সেই অর্থে বড় কোন শহরেও বড় হইনি। আমার বাবা ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তার বদলীর চাকরী ছিলো দেশের নানা পাওয়ার ষ্টেশনে। সেসব পাওয়ার ষ্টেশনগুলো  তো ছিলো বলতে গেলে প্রত্যন্ত এলাকায়। আমার শৈশব কৈশরের একটা বড় সময় কেটেছে সিলেটের শাহজীবাজার নামের একটা জায়গায় যেখানে একটা গ্যাস পাওয়ার ষ্টেশন আছে। ওটা তো রীতিমত জলা জঙ্গলার একটা জায়গা, ওখানে গ্যাস আবিষ্কার হওয়াতে সেখানে পাওয়ার ষ্টেশনটা হয়েছিলো। ওখানে ছিলো একটা প্রাচীন মাজার আর একটা ছোট গ্রাম। এই সময়ের স্মৃতি নিয়ে আমার একটা গল্প আছে ‘মাজার, টেবিল টেনিস, আসলি মোরগ’ নামে। এছাড়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, ঢাকার কাছে সিদ্ধিরগঞ্জ, খুলনার খালিশপুর এসব জায়গার পাওয়ার ষ্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আমার বাবা, সেসব জায়গায় থেকেছি আমি। তবে সেসব জায়গায় থাকলেও এইসব ছোট ছোট শহরের মূল জীবনযাত্রার সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিলো না। আমরা থাকতাম ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় সরকারী কোয়ার্টারে , নানা সরকারী সুযোগ সুবিধা ভেতর। ইঞ্জিনিয়ারদের নিজম্ব একটা জগত ছিলো যেটা স্থানীয় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, একটা এলিট জীবন বলা যায়। এরপর আমি তো ক্যাডেট কলেজে চলে গেলাম, সেটাও একটা নির্দিষ্ট গন্ডির জীবন।  ফলে আমি ঠিক শহরে বড় হইনি বরং বলা যায়  গ্রামে বা মফস্বলে থেকেও এক ধরনের আরবান লাইফ ষ্টাইলে বড় হয়েছি। তবে আমি সত্যিকার অর্থে গ্রামে যাই পড়াশোনা শেষে ব্রাকের স্বাস্থ্য প্রকল্পের ডাক্তার হিসেবে । আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে কাজের সূত্রে থেকেছি। এটা গ্রামে বেড়াতে যাওয়া না, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস থাকা। সেটা আমার জন্য ছিলো অসাধারণ অভিজ্ঞতা। গ্রামে থাকার সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে দেখার চোখ বদলে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত জীবনের গন্ডি, বইপত্র আর অক্ষরকেন্দ্রিক জীবনের গন্ডি পেরিয়ে একটা নতুন জগতের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। গ্রামের অভিজ্ঞতা আমার লেখার উপরও অনেক প্রভাব ফেলেছে। গ্রাম জীবনের সংগ্রাম আর ঐশ্বর্য খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমাদের গ্রামগুলো তো একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। তারপরও লোক সংস্কৃতির নানা মাত্রার সাথে সরাসরি পরিচয় হয়েছে আমার তখন। রাত জেগে পালা শুনেছি, যাত্রা দেখেছি। আমার খুব পছন্দের কাজ ছিলো হাটের দিনে নানা ঔষধের ক্যানভাসারদের বক্তৃতা শোনা। আমি তাদের গল্প বলার ক্ষমতায় মুগ্ধ থাকতাম। এসব অভিজ্ঞতা আমার লেখাকেও প্রভাবিত করেছে। ফলে আমাকে ঠিক আরবান লেখক কেন বলা হবে জানি না।
মাসউদুল হক : আপনি কি কোন ডায়েরী বা নোটবুক ব্যবহার করেন?
শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ। আমার নোটবুক থাকে যেখানে আমি নানা কথা , ভাবনা লিখে রাখি।
মাসউদুল হক : এটা কি স্বাভাবিক আগ্রহ বা অভ্যাস থেকে নাকি-কখনো গল্প লেখার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে ভেবে কোন গান, কবিতা বা বিখ্যাত কোন লোকের উদ্ধৃতি লিখে রাখেন?
শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ এগুলো আমার লেখায় কাজে লাগবে সেকথা ভেবেই নোট রাখি। কোথাও কোন একটা কথা শুনলাম বা ঘটনা দেখলাম সেটা সংক্ষেপে লিখে রাখি এবং পরে সেটাকে কোন গল্পে বা নিবন্ধে এক্সপান্ড করি। অনেক সময় অন্যের কোন লেখার চমৎকার কোন অংশ লিখে রাখি। আমার নিজের কোন লেখায় সেটা উল্লেখ করে ঐ লেখাটাকে আবার নতুন জীবন দেই। একটা ভালো সৃষ্টিকে সার্কুলেট করি।
মাসউদুল হক : আমি এখন লিডিং প্রশ্নে চলে আসি। অনুবাদ সাক্ষাৎকার এই কাজগুলো কি যখন আপনার রাইটার্স ব্লক কাজ করে তখন বেশি করেন?
শাহাদুজ্জামান : অনুবাদ, সাক্ষাৎকার যখন শুরু করেছিলাম তখন নিজের মৌলিক লেখার কোন তাগাদা ছিলো না। পরে যখন নিজের লেখার পরিমান বাড়তে লাগলো তখন সত্যি বলতে কি, নিজের লেখার গ্যাপে খানিকটা দম নিতে অনুবাদ ইত্যাদি করেছি।
মাসউদুল হক : ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন- গল্প সংকলন বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য একটি অনুবাদ গল্প সংকলন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেয়ার পেছনে কি আপনার মধ্যে রাইটার্স ব্লক কাজ করছিল?
শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ, বলতে পারো সে সময় এক ধরনের রাইটার্স ব্লক চলছিলো আমার। তার কিছু আগে ক্রাচের কর্নেলের মত গবেষণাধর্মী বড় একটা কাজ শেষ করেছি। নতুন কোন গল্প লেখাও হয়ে উঠছিলো না। কিন্তু কিছু লিখতে ইচ্ছা হচ্ছিল। তখন অনুবাদে হাত দেই। 
মাসউদুল হক :  আপনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গল্প ’মহাশূন্যে সাইকেল’।  ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন Ñ গ্রন্থটি অনুবাদের পর আপনার লেখার ধরনে পরিবর্তন এসেছে বলে আমার মনে হয়েছে। সম্ভবত ’মহাশূন্যে সাইকেল’ সেই পরিবর্তনের ইংগিত দেয়। ঐ গল্পগুলো নিয়ে পরে আপনার সাথে কথা বলবো। তবে পরিবর্তনটা কি এমন যে আপনি একটা সময় হয়ত নিজের সাথে নিজে বোঝাপড়া করলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। যেমন আমরা দেখি, আপনার প্রথম জীবনের গল্পগুলো দৈর্ঘ্য ছোট ছিল পরে দেখা যাচ্ছে যে, দৈর্ঘ্য বড় হচ্ছে। গল্পের দৈর্ঘ্যরে বিষয়ে পাঠকের একটি সমালোচনা ছিল। পাঠকের এই সমালোচনাকে রেসপন্স করছেন কি?
শাহাদুজ্জামান : এটা তোমার ভালো পর্যবেক্ষণ। আমি ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিনের গল্পগুলো অনুবাদ করেছি প্রবাসে বসে, সে বছর আমি ইউকেতে গেছি নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী নিয়ে। আমার জীবনযাপনে একটা পরিবর্তন এসেছে। মহাশূন্যে সাইকেল গল্পটাতে দূরত্বের বোধ প্রসঙ্গটা এসেছে ঘুরে ফিরে। বলতে পারো বিদেশে যাওয়ার পর নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার একটা নতুন মাত্রা তৈরী হয়েছে। এসবের একটা প্রভাব গল্পেও পড়েছে। সুতরাং তুমি ঠিকই বলেছ, ক্যাঙ্গারু দেখার বইটার পর আমার লেখায় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তবে গল্পের দৈর্ঘ্য যে পাঠকের সমালোচনার ভিত্তিতে বেড়েছে তা না। আমি কখনই এমন ভেবে গল্প লিখিনি যে এটা দু পৃষ্ঠা বা তিন পৃষ্ঠার গল্প হবে। আমার বলার কথাটা বলে ফেলবার জন্য যতটুকু পরিসর দরকার আমি ততটুকুই দিয়েছি। দু পৃষ্ঠায় আমার মুল কথাটা বলা হয়ে গেলে শুধু পৃষ্ঠা বাড়াবার জন্য সেটাকে আর দীর্ঘ করিনি। তবে তুমি যেমন বললে পরবর্তীকালে আমার বলার কথাগুলোর ধরন পাল্টেছে ফলে তার জন্য হয়তো গল্পগুলোও দীর্ঘ হয়ে গেছে।
মাসউদুল হক : অন্যান্য লেখকের সাথে আপনার পার্থক্য অনেক আছে। তবে দেখা যায়, আপনার লেখায় পরকীয়া প্রেম, যৌনতা Ñ এই বিষয়গুলো তেমন প্রকট না। এগুলোকে আপনি সচেতনভাবেই কি এড়িয়ে যান, না লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
শাহাদুজ্জামান : পরকীয়া প্রেম, যৌনতা এগুলো তো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগেই বলেছি এসব নিয়ে লিখতে সতর্ক থাকি। কারণ এসব বিষয়ের প্রচুর অপব্যবহার দেখেছি সাহিত্যে। বাজারমুখী হালকা আনন্দের বিষয় হতে দেখেছি। আমার লেখায় প্রকটভাবে এসব নিশ্চয়ই নাই কিন্তু সূক্ষ্মভাবে আছে। ‘ক্যালাইডোস্কোপ‘ গল্পটায়, ‘বিসর্গতে দুঃখ’তে পরোক্ষভাবে আছে। সেই যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটা লাইন আছে না, ‘ফুলকে সরিয়ে নাও, একে দিয়ে অনেক মিথ্যা বলানো হয়।’  আমার লেখায় এসব বিষয়কে একটু সরিয়ে জীবনের অন্য দিগন্তগুলোর উপর একটু বেশী জোর দিয়েছি বলতে পারো।
মাসউদুল হক :   ’সেল্ফ সেন্সরশীপ’ সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক হিসেবে আপনি কোন কোন বিষয়ে সেলফ সেন্সরশীপ’ আরোপ করেন?
শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ, সেল্ফ সেন্সরশীপ‘ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি কি নিয়ে লিখব সেটা যেমন ঠিক করা দরকার তেমনি কি নিয়ে লিখব না সেটার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। আমি তা করি। 
মাসউদুল হক : আপনার কি লেখার সময় মনে হয় না যে এটা আপনার ফ্যামিলি মেম্বার পড়বে?
শাহাদুজ্জামান : আমার ফ্যামিলি মেম্বাররা আমার লেখাপত্র পড়ে। আমার বাবা, মা সাহিত্য অনুরাগী, আমার ভাই বোনরাও, অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা আমার লেখা পড়ে। তাদের কথা ভেবে আমি মোটা দাগে কোন কিছু সেন্সর করি না। তবে এ কথা সত্য যে মনের গভীরতর সব কথা অকপটে এখনও বলে উঠতে পারি না, সেখানে সেল্ফ সেন্সরশীপ চলে আসে।  অনেক কথা হয়তো চেপে যাই কারণ তাতে হয়তো আমার একেবারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলো এফেক্টেড হবে। 
মাসউদুল হক :  আমার মনে হয় যৌবন চলে যাবার পর মানুষ অনেক প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।  যৌনতা, ধর্ম, পরকীয়া, অনাচার ইত্যাদি নিয়ে অনেক বেশি কথা বলতে পারে। যৌবন থাকাকালে সেল্ফসেন্সরশীপ বেশি মাত্রায় আরোপ হয়।
শাহাদুজ্জামান : একটু বয়স হলে যৌনতা, ধর্ম, পরকীয়া, অনাচার ইত্যাদি নিয়ে একটু থিতু হয়ে ভাবার সুযোগ হয়, সেটা ঠিক। অল্প বয়সে অনেক সময়ে উত্তেজনার বশে অনেক বেশী কথা বলা হয়ে যায়। আমার বয়সও বেড়েছে ফলে এসব ব্যাপার নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবার সুযোগ হচ্ছে।
মাসউদুল হক :  আপনার প্রায় সব গল্পেই নায়কের সাথে নায়িকার সরাসরি উপস্থিতি নেই। ধরেন যে, গল্প বা উপন্যাসের নারী চরিত্র- সে মূল চরিত্রের স্ত্রী অথবা গল্পের মূল চরিত্রের সাথে গাড়িতে পাশে বসে থাকা কোন এক যাত্রী। অথবা হয়তো মূল চরিত্রের সাথে নারীটির বাস ষ্টপেজে দেখা হচ্ছে। শুধু একটি গল্পে আমরা দেখি নিতি নামের একটি চরিত্রের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে কিন্তু এই কথাটি আপনি উল্লেখ করেছেন ব্র্যাকেটের মধ্যে।  এমনকি আমার খুব প্রিয় একটা গল্প ’জোৎ¯œালোকের সংবাদ’-এ রিজিয়া গল্পের প্রয়োজনে একটা সাবজেক্ট। গল্পের গতিপথ নির্ধারণে তার কোন গুরুত্ব নেই। গল্পের নারী চরিত্রের ব্যবহার খুবই কম। এটার পেছনে কি কোন সচেতন বা অসচেতন কার্যকারণ ক্রিয়াশীল?
শাহাদুজ্জামান : এটা একটা ইন্টারেষ্টিং কথা বলেছ তুমি। সত্যিই কি আমার নায়ক নায়িকার সরাসরি দেখা হয় না? আমি নিজেও তো সেটা খেয়াল করিনি। ব্যাপারটা তো আমাকেও ভেবে দেখতে হবে। তবে গল্পে গতিপথ নির্ধারণে নারী চরিত্রের ভুমিকা নাই সেটা বোধহয় ঠিক না। তুমি নিতিকে নিয়ে যে গল্পটার কথা উল্লেখ করেছ সম্ভবত চীনা অক্ষর.. গল্পটা,  সেখানে ছেলেটার সব কর্মকাণ্ড তো মূলত নিতি নামের মেয়েটাকে দিয়েই নির্ধারিত। কিম্বা আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা গল্পে সেই পাঠিকা তো গল্পের কেন্দ্রে আছে।
মাসউদুল হক :  এটা ব্যক্তিগত জীবন যাপনের বিষয় নিয়ে কথা বলি। আপনার কথাসাহিত্য আমাদের ধারণা দেয় যে আপনার একটা গড গিফটেড প্রবল ও গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি রয়েছে। বস্তুত এই প্রবল ও গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি, যেটা আসলে আপনাকে অন্যান্য সমকালীন লেখকদের চেয়ে আলাদা করে আলোচনার সুযোগ করে দেয়। এরকম একটা শক্তি নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কি বিব্রতকর মনে হয় না?
শাহাদুজ্জামান : ভালো প্রশ্ন করেছ। এটা ঠিক যে যতক্ষণ জেগে থাকি চারিদিকে জীবনটাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি অবিরাম। কথা সত্য যে খুব কাছের মানুষজনও যখন পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে উঠে তখন অনেক সময় ব্যাপারটা বিব্রতকর, অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ থেকে তো আমার নিস্তার নাই। যখন যা দেখছি, যার সাথে কথা বলছি সেসবকে নানা মাত্রায় পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা আমার একেবারে স্বভাবের ভেতর ঢুকে গেছে। তাছাড়া আমি এ্যানথ্রপলজি পড়েছি, এ্যানথ্রপলজির একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। কিভাবে সিসটেম্যাটিক অবজারভেশন করতে হয় তার ম্যাথডলজি আমি পড়েছি। ফলে এটা আমার পেশাগত কাজও বলতে পারো। এই পর্যবেক্ষণ প্রবণতা আমার লেখালেখি এবং নৃবিজ্ঞান গবেষণা দুক্ষেত্রেই কাজে লাগে।
মাসউদুল হক : কিন্তু আবার শেষ পর্যন্ত আপনি কিন্তু ভেরি মাচ অর্গানাইজড?
শাহাদুজ্জামানঃ আসলে আমি দুটো একেবারে প্যারালাল জীবন যাপন করি বলতে পারো। একটা আমার পেশাগত জীবন, যেটা শিক্ষকতা, গবেষণা আরেকটা আমার লেখক জীবন। দুটাই খুব ডিমান্ডিং। আমি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি, বিশ্বস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করি, এগুলো খুবই পরিশ্রম সাধ্য, সময় সাপেক্ষ কাজ। এরপর আমি যে ধরনের লেখা লিখি সেগুলো অনেক সময় দাবী করে। এর  বাইরে সংসার, স্ত্রী, পুত্র এদের নিয়েও তো নানা দায়িত্ব রয়েছে। ফলে আমাকে অর্গানাইজড হতে হয়, তা না হলে এতগুলো জীবন সামলানো অসম্ভব। আমি না লেখালেখি করলে হয়তো আরো ভালো স্বামী বা বাবা হতাম, আরো ভালো একাডেমিক হতাম। কিন্তু লেখার নেশা আমি ছাড়তে চাইনি ফলে ধীরে ধীরে এই অর্গানাইজড হওয়াটাকে রপ্ত করতে হয়েছে। আমি আমার লেখার কাজগুলো করি রাতে, প্রতি রাতেই লিখতে বসি।  প্রবাসে থাকলে একটা সুবিধা অবশ্য আছে যে, যেহেতু চেনা জানা মানুষ এখানে কম ফলে সোসালাইজেশনে বেশী সময় দিতে হয় না। 
মাসউদুল হক : তাহলে কি আমি বলতে পারি, আপনি বাজারে যান, মাছ কেনেন, বউয়ের রাগ ভাঙ্গান, সবই করেন কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোন উষ্ণতা থাকে না?
 শাহাদুজ্জামান : আমি বাজার ঘাট, মাছ কেনা সবই করি, বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতেও চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী পাপড়ীন নাহারের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। সে আমার প্রেমিকা ছিল। আমি তাকে আমার প্রথম বই উৎসর্গ করেছি। সে আমার গল্পের প্রথম পাঠক। তবে সংসারের বৈষয়িক ব্যাপারগুলো আমি খুব একটা সফলভাবে করতে পারি, তা না।  জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন যে ‘কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে।’  
মাসউদুল হক :  আচ্ছা গল্প তো গল্পই। কিন্তু আপনি একটা বই প্রকাশ করলেন যেখানে গল্পগুলোকে  তিনভাবে ভাগ করলেন ‘গল্প, অগল্প এবং না-গল্প‘ এইভাবে। এই তিন শ্রেণি বিভাজন আপনি কেন করতে গেলেন? আপনার কি নিজেরও সংশয় ছিল? কিছু কিছু গল্প কি আদৌ গল্প কি-না?
শাহাদুজ্জামান : বলতে পারো তাই।  আমি সেই বইয়ের ভূমিকায় সে কথা বলেছি। আমার অনেক গল্পকেই প্রচলিত ধারার গল্প হয়তো বলা যাবে না। আমি বলেছি যে সাহিত্যের নানা শাখার ভেতরকার দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে আমি পছন্দ করি। আমার গল্পের ভেতর প্রবন্ধ বা কবিতার উপাদা