করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





অলীক উড্ডয়ন
সাদিয়া সুলতানা
আমি ভেবেছিলাম, আমি অনেক বড় হবো। অনেক বড়। বাবার মতো বড়। ঠিক যতটা বড় হলে ঘরে ঢুকেই মায়ের শিশুসুলভ ভুলভ্রান্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করতে করতে পুনরায় কর্তাসুলভ উদারতায় সেসব ভুলভ্রান্তি মাফ করা যায়, ঠিক ততটা বড়। এত বড় যে, মাসের শুরুতে বেতন এনে পয়সার সাথে খাওয়ার হিসেব কষতে ছাড়বো না। সেই সাথে দিনশেষে স্ত্রী-সন্তানসহ বাড়িতে আশ্রিত সকলকে মনে করিয়ে দিবো, কতগুলো পেট চালাই, দেখ, দেখ বড় দয়ার শরীর আমার!
বাবা যেদিন বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে খসখসে গালে ঘষে ঘষে শেভিং ফোম লাগাতে লাগাতে শেভ করতেন আর তার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে মুখে ফেনা তোলার চেষ্টা করতেন সেসময় অসতর্কতায় সোর্ড ব্লেড সোর্ডের মতো বাবার গাল চিরে দিতো। আমি পাশের ঘর থেকে শুনতে পেতাম এর পরপরই মায়ের জন্য কথার ফর্দটা আরো বড় হয়ে যেতো। মা যখন চোখের জল গোপন করতে করতে দস্তরখানায় সকালের খাবার সাজাতেন তখন আমি ভাবতাম, আমি বাবার মতো বড় হয়ে প্রথমপাতে রুটি ডিমের সাথে বাটিতে রাখা একমাত্র মিষ্টিটা তুলে নিবো।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমার বাবার মতো বড় হবার ইচ্ছেটা ছিল। মোবাইল কেনার টাকাটা চাইতে বাবা যেদিন হাজার বাক্য ব্যয়ে না করে দিলো সেদিন থেকে অবশ্য আমি আমার ইচ্ছেটা পাল্টে ফেললাম। আমি সেদিন প্রথমবারের মতো বুঝে গেলাম, বাবা ঠিক কতটুকু বড় হতে পেরেছে। আমি বুঝে গেলাম এতটুকু বড় হওয়ায় কোনো ছোটখাট জিনিসও কপালে জুটবে না আমার।
আমি সেদিন ঠিক করলাম আমি পাশের বাড়ির ইসমাইল ভাইয়ের মতো বড় হবো। বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই তার মতো বড় রাস্তার বুকে ধূলা উড়িয়ে বড় গাড়ি করে বাড়ির সামনে নামবো। আর সেসময় আমার এক হাতে থাকবে ব্রিফকেস আরেক হাতে থাকবে একটা জাদুর থলে। যে থলের ভেতর থেকে এক একদিন এক এক জিনিস বের হবে। কোনোদিন লাল আপেল বা চেরি। কোনোদিন সবুজ আঙুর বা ব্লাক ফরেস্ট কেকের বাক্স। আবার কফির সুদৃশ্য কাচের বৈয়ামের সাথে মচমচে বিদেশি বিস্কুটের মনোহর প্যাকেট। নতুবা শিক কাবাব আর নান রুটি।
আবার হয়তো খাবারের বদলে কোনোদিন থলে থেকে বের হবে ভাঁজ করা নতুন শার্ট, নতুন প্যান্ট। ইসমাইল ভাই বড় হবার সাথে সাথে কল্পনায় তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে আমিও বড় হতাম। কিন্তু একদিন ভাই এতই বড় হলো যে শহরের শ্যাওলা ধরা পুরানো ধাঁচের বাড়িতে বাবা-মাকে ফেলে রেখে বউ-বাচ্চা সাথে করে ঢাকা শহরে ফ্লাট কিনে আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি আর ইসমাইল ভাইয়ের বড় হওয়া দেখতে পেলাম না।
তারপর অবশ্য আমি হাল ছাড়িনি। বরং আমার বড় হবার বাসনা নতুন দিকে মোড় নিলো। বাসায় ততদিনে ডিশ লাইনের সংযোগ এসেছে। বাবার প্রিয় রিয়েলিটি শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ দেখতে দেখতে আমি নিজেকে ক্রোড়পতি বানাবার স্বপ্ন দেখতাম। রাজু, শিশির, পিয়াল, নেওয়াজ যখন ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার জন্য সাধারণ জ্ঞান বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেল তখন আমি ভর্তি গাইড কেনার টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কিনতে শুরু করলাম। আমি ঠিক করেছিলাম, আমি সত্যিই অনেক বড় হবো।
আমার মতো আরেকজন মানুষও আমার বড় হবার স্বপ্ন দেখতো। সে হলো আমার মা। মায়ের খুব শখ ছিল আমি অনেক বড় হবো। কিন্তু সে শখের কোনো মাথা মুন্ডু নেই। কেমন যেন আকাশ ফুঁড়ে বড় হওয়ার মতোন অলীক সব শখ ছিল মায়ের। আমি যখন রাত জেগে সহস্র ডিজিট চোখের সামনে ভাসতে দেখতাম, মা তখন চুপি চুপি আমার ঘরে ঢুকে আয়াতুল কুরসি পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিতে দিতে বলতেন, আমার আব্বা বড় হ। আকাশের মতো বড় হ। মানুষ হ। আকাশের মতো বড় মানুষ।
আকাশের মতো বড় আবার মানুষ হয় নাকি? নাকি আকাশ হলে মানুষ হওয়া যায়? আর আমি কি মানুষ না, তবে কি বনমানুষ? মায়ের যত ফালতু কথা। মায়ের এলোমেলো কথা শুনতে শুনতে আমার জিদ চেপে যেত, আমি এতই বড় হবো যে মায়ের শখ মিটে যাবে। মা অবশ্য আমার বড় হওয়া দেখতে পেল না। অতদূর দেখে যাবার মতো শরীর মার ছিল না। বছর বছর অসুখে ভুগতে ভুগতে মা একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলেই গেল। ভালই হয়েছে। কারণ পেটের মধ্যকার অপ্রয়োজনীয় অঙ্গগুলো কাটতে বার বার অপারেশন টেবিলে শুতে হতো বলে বাবাও মায়ের উপরে খুব বিরক্ত হয়ে পড়েছিল।
আমার মনে আছে এখনো, আমি আর টিনা সেদিন মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জেনারেল ওয়ার্ডের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। টিনার ফোঁপানিতে আমি ভাল করে সব কথা শুনতে পাইনি যদিও, তবু ঠিক শুনেছি বাবা বেশ রাগী  রাগী গলায় বলছিলেন, জরায়ু, ওভারি অত বার বার ফেলার কি আছে? প্রডাকশন যখন বন্ধ একবারে সব ফেলে দিলেই হয়! কয়দিন পর পর কাজকাম ফেলে হাসপাতালে দৌড়াও আর গুচ্ছের টাকা খরচ কর। টিনার ফোঁপানি শুনতে শুনতে তখন আমার ইচ্ছে করছিল ওকে কষে একটা চড় লাগাই। তারপর আমার মনে হলো বড় হয়ে ডাক্তার হলে মন্দ হতো না, শরীরের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ কাটার ডাক্তার। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হইনি ঠিকই তবে মানুষের শরীর কাটার জন্য বেশ দক্ষ হাতের অধিকারী হয়েছি।
আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎ ছেদ পড়ে। রুমের ভেতর কেমন কটু গন্ধ লাগছে। আহা রুম বলছি কেন? এত গারদ। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার থানাহাজত। আমার ধারণা ছিল, আমি এতোই বড় হয়েছি যে, আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু এই ব্যাটা দারোগা মিজান কি কৌশলে যে আমাকে ধরে ফেললো! নাহ্, আমার আসলে জিনিস ছাড়া বের হওয়া ঠিক হয়নি। আর ধরা পড়ার পর আমিও বেশি বাড়াবাড়ি করিনি। একটা ছুতো করে মেরে দিয়ে ক্রসফায়ার বলে চালাতে হারামজাদাদের আর কতক্ষণ! আবার সেই গন্ধ। এইবার আমার রাগ হয়। আমার মতো নামী আসামী যাকে র‌্যাব দুর্ধর্ষ অপারেশন চালানোর পরও ধরতে পারেনি আজ তাকে কিনা একটা হেরোইনচির সাথে একই গারদে রাখা হয়েছে!
এবার আমার বদ ছেলেটাকে কষে চড় লাগাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হারামজাদা হেরোইনচি বমিতে নাক মুখ যেভাবে ভাসিয়েছে তাতে নিজের হাত নষ্ট করার মানে হয় না। হলদে, থকথকে বমির উৎকট গন্ধে আমার বমি পাচ্ছে। বমি আটকে রাখার চেষ্টা করতেই হারামজাদা আবার কল চাপার মতো হড়হড় করে বমি করে দিলো। এত কী খাইছিল শালা? বিরিয়ানি, পোলাও? তিনবারেও গোডাউন খালি হয় না? আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। অবশ্য আমার পেটের ভেতর পানি আর ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নেই। এবার খানিকটা আরাম লাগছে।
আমাকে জিপে তোলা হয়েছে। এটা স্পেশাল জিপ। ছোট গারদখানার মতো। আরো কিছু আসামী দেখা যাচ্ছে। সেই হেরোইনচি ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে। আজ কোর্টে তুলবে আমাকে। আমার জামিনের জন্য কেউ আসবে বলে মনে হচ্ছে না। চব্বিশ ঘন্টা হতে চলেছে, কেউ আমার খবর নেয়নি। পুলিশের গাড়ি শহরে ঢোকার জন্য এত সময় নিচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি নিজেকে একা আবিষ্কার করলাম। আমার সামনে দৃশ্যমান মুখগুলো অদ্ভুতরকমের শান্ত আর স্থির। আমি আরো স্থির চোখেমুখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই সময়ে কি সবারই মায়ের কথা মনে পড়ে? কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত! আমি সামনে মায়ের কাতর মুখটি দেখতে পাচ্ছি!
হঠাৎ গুলির শব্দ নীরবতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। অতি পরিচিত শব্দের মাঝে নিজেকে আবিষ্কারের নেশায় বুদ হয়ে খুশি আর উত্তেজনায় আমি দু’হাত মেলে দিলাম। কী আশ্চর্য এক অনুভূতি! অস্পর্শী রোদের আলো আমার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দূরে সরে যাচ্ছে আর আমি ভেসে বেড়াবো বলে দু’হাত মেলে দিয়েছি!
আহা! আজ আমি কত্ত বড় হয়েছি! এতই বড়, যেন মায়ের ইচ্ছেপূরণের জন্য আকাশজোড়া মেঘের সাথে অলীক উড্ডয়নে সামিল হয়েছি।  



সৃজন
আবু নাসের

আছিয়া আর এলিজার বয়স কাছাকাছি হলেও তাদের ভেতর বিস্তর ব্যবধান আছে। বিশেষ করে তাদের খেলনাগুলো দেখলে এটা আরো বেশি বোঝা যায়। আছিয়া অবশ্য খেলনা শব্দটাই আগে শোনেনি। সে যা দিয়ে খেলে, তাকেই যে খেলনা বলেÑ এটা বোঝার অবস্থা তার হয়নি। সে খেলে কাদামাটি দিয়ে। কাদামাটিকে কেউ খেলনা বলে না। তবে কাদামাটি টেপাটিপি করেও আকৃতি দেয়া যায়। সেটা দেখতে আর সেটা দিয়ে খেলতে আছিয়ার মজা লাগে।
আছিয়ার মা অবশ্য এগুলো পছন্দ করে না। সারাক্ষণ হাতে মাটি লেগে থাকলে কার মায়ের ভালো লাগবে! কিন্তু আছিয়ার ওসব ভাবনা নেই। সেদিন সে টিপেটুপে একটা হাঁস বানিয়েছিলো। সেটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। এখন কী করে সেই হাঁসটাকে ফিরিয়ে আনা যাবে সেটাই তার একমাত্র চিন্তা।
মাকে সে প্রশ্ন করে, ‘বৃষ্টির পানি কোথায় যায় মা?’
‘কোথায় আর যাবে! নদীতে যায়।’ মা বলে।
‘নদীর পানি কোথায় যায় মা?’
‘কী জানি বাপু। আমি কি দেখতে গিয়েছি কোনোদিন?’ মা বলতে পারে না।
আছিয়া ঠিক করে একদিন সে ঠিক ঠিক নদীর সাথে চলে যাবে। অনেকদূরেÑ যতোদূরে গেলে হাঁসটাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।
আছিয়া এমন করে প্রায়ই কাদামাটি দিয়ে অনেক কিছু বানায়। সেদিন একটা সাপ বানিয়েছিলো। সেটা দেখে তার মা সত্যিকারের সাপ মনে করে দিয়েছে ঝাঁটার বাড়ি। সাপটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। দুঃখে আছিয়ার চোখে জল এসে গেছে। সে যা দিয়ে খেলে, কষ্ট করে যা বানায় তার জন্য কেমন একটা মায়া পড়ে যায়। মা সেটা বোঝে না।
তবে আজকে সে একটা দারুণ জিনিস বানিয়েছে। একটা পুতুল। দেখতে অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেটার মতো হয়েছে। সেটার জন্য সে কাপড় কেটে সুঁই সূতা দিয়ে সেলাই করেছে। একটা ছোট জামা আর লুঙ্গি। ছেলেটার একটা নামও দিয়েছে সে। দুবলা। সে যখন আদর করে ডাকে ‘এই দুবলা!’, শুনে দুবলা হাসে। সকালে আর দুপুরে সে তাকে জোর করে ভাত খাইয়েছে। যদিও খেতেই চায় না একদম। সন্ধ্যায় পড়তে বসিয়েছে। সে যতোটুকু অ আ শিখেছে সেগুলোই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। কী মায়ায় ভরা মুখ দুবলার! আছিয়া তাকে হাঁসের গল্প বলেছে। সাপের গল্প বলেছে। সে ঠিক করেছে হাঁসটাকে খুঁজে আনতে যখন সে যাবে, দুবলাকে সাথে নিয়ে যাবে। শুনে দুবলাও খুব খুশি!
আছিয়ার বাড়ি থেকে একশ ফুট দূরে এলিজাদের বাড়ি। ধবধবে সাদা দালানে ওরা থাকে। সেখানে কোনো কাদামাটি নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর-বাড়ি। আসলে আছিয়ার মা এই এলিজাদের বাড়িতেই কাজ করে।
এলিজার খেলনার অভাব নেই। ট্রেন আছে, মটরগাড়ি আছে। বাঘ-ভালুক-হরিণ সবই আছে। এগুলোর বেশিরভাগই তার গত জন্মদিনে উপহার পাওয়া। তাছাড়া বাসায় মেহমান আসলে এলিজার জন্য কিছু না কিছু থাকেই। এলিজার বাঘ-ভালুক-হরিণেরা নিজেরা চলতে পারে না। তবে তার মটরগাড়িগুলো ব্যাটারি দিলে চলতে শুরু করে। আর একটা গাড়ি আছে রিমোট কন্ট্রোলড। সেটা এলিজার সব থেকে প্রিয়। সারা ঘরে সেটা সে চালিয়ে বেড়ায়। তার বাবা বলেছে সামনের মাসে তাকে একটা হেলিকপ্টার কিনে দেবে। সেটা নাকি ঘরের ভেতর উড়ে বেড়াবে। শুনে তো এলিজা খুশিতে আত্মহারা!
ও হ্যাঁ! আছিয়ার মতো এলিজারও একটা খেলনা পুতুল আছে। ওর নাম টমি। নামটা পুতুলের গায়েই লেখা ছিল তাই এলিজার আর আলাদা করে দিতে হয়নি। এই পুতুলটা হাঁটতে চলতে পারে। সুইচ টিপে দিলে প্রথমে খিক খিক করে হাসে। একবার ডানে তাকায়, একবার বামে। তারপর টুকটুক করে হাঁটতে শূরু করে। এলিজা আগে ওটার সাথেই থাকতো বেশি। কিন্তু রিমোট কন্ট্রোলড গাড়িটা আসার পর থেকে পুতুলের যতœ কমে গেছে। এতো খেলনা তার, কোনোটাতেই বেশিদিন মন টেকে না। তার উপর আজ মাথার ভেতর হেলিকপ্টারের ব্যাপারটাও ঢুকে গেছে।
বাবা কি সত্যি সত্যি হেলিকপ্টারটা কিনে দেবে? কী মজা হবে তখন! এলিজা হেলিকপ্টারের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় রাতে। স্বপ্নে একটা লাল টুকটুকে হেলিকপ্টার উড়ে আসে। তাকে নিয়ে উড়ে যায়, অনেক উপরে, অনেক অনেক উপরে!
বিশ বছর পর।
এলিজা আর আছিয়া এখন অনেক বড়। তাদের দু’জনের ছেলেই এখন কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়ে। সন্ধ্যাবেলায় ছেলেটাকে পড়ানো এখন এলিজার কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কেবল সে অক্ষরগুলো শিখছে, তাও মনে রাখতে পারে না। গত চারদিন হলো এলিজা এক তালব্য শ এর পেছনে লেগেছে। কিছুতেই সেটা সে ঠিকমতো লেখাতে পারছে না। আবার ওদিকে অংক খাতায় এক দুই তিন চারÑ যাও লিখতে পারে, পাঁচ লিখতে গেলেই সেটা কেমন আলুর মতো হয়ে যায়। এভাবে কতোক্ষণ আর ধৈর্য্য ধরে রাখা যায়! এলিজা তার ছেলেটাকে নিয়ে আর পারে না।
তবে আছিয়ার ছেলেটারও প্রথম প্রথম অক্ষর লিখাতে সমস্যা ছিল। এখন মা সব শিখিয়ে দিয়েছে। ওসব তালব্য শ, চার-পাঁচ, তার কাছে কোনো ব্যাপারই না! তালগাছ আঁকতে গেলে সেটা কেমন করে যেন তালব্য শ হয়ে যায়। দু’টা মিষ্টি জোড়া দিয়ে রাখলে হয় চার, আর যদি আম আঁকতে চায় তাহলেই হয়ে যায় পাঁচ!
অক্ষর লেখার চেয়ে মজার কাজ আর কিছু কি হয় নাকি!