করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





বন্ধন
ডাব্লিউ. ডাব্লিউ. জেকবস
অনুবাদ: তানিয়া হাসান
নেথন ক্লার্ক আর মিসেস ব্রাউন এইমাত্র তাঁদের দাবার তিন নম্বর খেলাটা শেষ করলেন। বিধবা মিসেস ব্রাউনের খেলায় মনঃসংযোগ একেবারেই নেই। এমন মানুষের সাথে খেলা টিকিয়ে রাখা বড় কঠিন কাজ, তবুও মিঃ নেথন ক্লার্ক এমন অসাধ্য কাজটাই করবার চেষ্টা করেছিলেন, যাতে খানিকক্ষণের জন্য হলেও বিধবা মিসেস ব্রাউনের মনটা উৎফুল্ল থাকে।

নেথন ক্লার্ক বললেন, “এবারের দানটা কিন্তু তুমিই জিতলে শেষ পর্যন্ত, আমিলিয়া”।

আমিলিয়া ম্লান হাসলেন, “তোমাকে একটা কথা বলার ছিল নেথন, তুমি তো জানো, তোমার কাছে থেকে আমি কোনো কথাই লুকাই না। চার্লি ট্র্যাকারের কথা মনে আছে তোমার, প্রথম যৌবনে যে লোকটি আমার জন্য পাগল ছিল?”

একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে, ব্যাজার মুখে নেথন বলেন, “মনে থাকবে না আবার, কতোবার শুনিয়েছো তাঁর কথা তুমি”।

“গতকাল একটা চিঠি পেয়েছি চার্লির কাছ থেকে, আশ্চর্য এতদিন পরও ও আমাকে মনে রেখেছে। আসলে কার কাছে যেন আমার স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েছে, চার্লি লিখেছে, “ বলতে বলতে আনমনা হয়ে ওঠে আমিলিয়া।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, নেথন জানতে চান, “আমার বিষয়ে কিছু লেখেনি?”

“তোমার ব্যাপারে কি লিখবে, ও তো তোমার কথা জানেই না?”

“না জানলে জানিয়ে দাও যে, আর দেড়মাস পরেই আমারা বিয়ে করবো। তখন তুমি আর বিধবা মিসেস ব্রাউন থাকবে না, তুমি হবে মিসেস ক্লার্ক। আমাদের বিয়ের খবর শুনলে হয়তো আর তোমাকে চিঠি লিখবে না, লোকটা।”

আমিলিয়া ব্রাউন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম এতদিনে হয়তো লোকটা মরেই গেছে, কিবা বিয়েসাদি করে স্থিতু হয়ে গেছে সংসারে, কিন্তু চিঠিতে লিখেছে আমার কথা ভেবে ভেবে আজ অব্দি লোকটা একাই  রয়ে গেছে।”

“ভালোই তো, এতো বছর একা থেকে থেকে, একা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে লোকটার।’’

“মিঃ চার্লি ট্র্যাকার লিখেছে ও আমার সংগে দেখা করতে আসছে, আজ বিকেলে,” ধীরে ধীরে বলেন বিধবা আমিলিয়া ব্রাউন।

“তোমার সংগে দেখা করতে আসছে? কেন শুনি?” কঠিন শোনায় নেথনের আওয়াজ।

“তাতো জানি না। আমি শুনেছিলাম আমি যখন ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।  চার্লির তখন নাকি নিজের প্রতি এমন বৈরাগ্য জন্মে গিয়েছিলো যে, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। ভবঘুরের মতো ঘুরে ঘুরে চার্লি তার সৌম্যকান্তি চেহারার বেহাল করে ফেলেছিল, তারপর একসময় দেশ ছেড়েই চলে গেছিলো। এতোগুলো বছরে চার্লির সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগই ছিলো না”।

আমিলিয়া ব্রাউনের পুরানো প্রণয়ীর কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো নেথন ক্লার্কের, নিজের রাগ সামলাতে নীরবে দাঁতে দাঁত ঘষলেন তিনি, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আমিলিয়ার কাজের লোক এসে সশব্দে দরজা খুলে ধরল, ঘরে এসে ঢুকলেন আলিমিয়ার পূর্বপ্রণয়ী, মিঃ চার্লি ট্র্যাকার। লম্বা চওড়া আগন্তুকটির আকর্ষণীয় চেহারা আর কেতাদুরস্ত পোশাক আশাক তার রুচির পরিচয় বহন করে, দামী কালো রঙের কোটের পকেট থেকে উঁকি মারছে সিল্কের রুমাল, কোটের বাটন হোলে শোভা পাচ্ছে টুকটুকে লাল রঙের একটা তাজা গোলাপকুঁড়ি!  

“মিঃ ট্র্যাকার, কেমন আছেন আপনি,” বলতে গিয়ে লালচে হয়ে ওঠে আলিমিয়া ব্রাউনের গাল।

“অবিকল সেই আগের মতোই কমনীয় আছো তুমি, একচুলও বদলায়নি কোনোকিছু, আশ্চর্য মনেই হয় না এতোগুলো বছর কেটে গেছে,” নিচু হয়ে ঝুঁকে আমিলিয়ার ডান হাতখানি তুলে নিয়ে সম্মানের সাথে চুমু খেলেন, মিঃ চার্লি ট্র্যাকার।

“সত্যিই বড় তাজ্জব হয়েছি আপনাকে এখানে দেখে মিঃ ট্র্যাকার,” চার্লির ধরা হাতাটা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিলেন, আমিলিয়া লজ্জায় তাঁর গাল দুটো রক্তিম হয়ে উঠেছে।

“মিঃ ট্র্যাকার নয়, চার্লি! মনে নেই তুমি আমাকে বরাবর চার্লি বলেই ডাকতে,” আবেগমাখা গলায় বলেন, আগন্তুক।

আমিলিয়ার লজ্জা পেয়ে চোখের কোনে একনজর ক্লার্কের দিকে দেখে নিয়ে চার্লির সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক দুজন অনিচ্ছুকভাবে হাত মেলালেন।

চার্লি বললেন, “আমিলিয়া, তোমার সব বন্ধুরা আমারও বন্ধু। আপনি কেমন আছেন মিঃ নেথন ক্লার্ক?”

উত্তরে নেথন জানালেন, তিনি বেশ ভালো আছেন এবং আশা করেন চার্লিও নিশ্চয় ভালোই আছে। তারপর ঘরের কোনে রাখা চেয়ারটা সশব্দে টেনে নিয়ে বসে পড়লেন, নিজের মোটা গোঁফে তা দিতে দিতে আমিলিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

“এতোগুলো বছর পরে তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে চার্লি, তুমি আমাকে খুঁজে পেলে কি করে বলতো?” লজ্জা লজ্জা গলায় বলেন, আমিলিয়া।

“সে, এক লম্বা কাহিনী, অন্য একসময় বলা যাবে, কিন্তু আমি সবসময়ই জানতাম তোমার সাথে আমার একদিন না একদিন দেখা হবেই। দুনিয়ার যে প্রান্তেই যাইনা কেন, তোমার ছবি আমার সবসময় মানিব্যাগে রাখা থাকতো। অ্যামেরিকা থেকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার গহীন জঙ্গলে তোমার ছবিই ছিল আমার একমাত্র সান্ত্বনা, আমার পথপ্রদর্শক তারা। যখনই কোনো ভুলপথে পা বাড়াতে গেছি, তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে নিজেকে শুধরে নিয়েছি।”

“মনে হচ্ছে আমিলিয়ার ছবির দিকে তাকিয়েই আপনার দিন কেটে যেতো, মিঃ চার্লি,” খানিকটা ঠেশ দিয়ে বলেন নেথন।

“আসলেই তাই, প্রতিদিন আমি, আমিলিয়ার ছবি দেখতাম। একবার শিকার করতে গিয়ে আমি, আহত হই। পাঁচদিন কোনো রকম খাবার আর পানি ছাড়া থাকতে হয়েছিলো, তখন আমিলিয়ার ছবিই আমাকে বেঁচে থাকবার শক্তি যুগিয়েছে।”

মিসেস ব্রাউনের চোখের দিকে তাকিয়ে চার্লি আবার বলে, “আর একবার এমন এক পরিস্থিতিতে পরেছিলাম যে প্রতিদিন শুধু পানির মতো ট্যালটেলে বিস্বাদ জাউ আর এক কাপ করে দুধ ছাড়া কিছুই জোটেনি। একনাগাড়ে দশদিন এই খেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পথ চলতি একদল উপজাতীয় আমাকে আশ্রয় দেয় সে সময়, সেবা শুশ্রƒষা করে আমাকে বাঁচিয়ে তোলে। অজ্ঞান অবস্থায় আমি নাকি সারাক্ষণ শুধু ‘আমিলিয়ার’ নাম ছাড়া আর কিছু উচ্চারণ করিনি। জ্ঞান ফেরার পর ওরা ঠাট্টা করে আমাকেই ‘আমিলিয়া’ বলে ডাকা শুরু করে দেয়।”

নেথন ক্লার্কের আর চার্লির এতো আমিলিয়া প্রীতি সহ্য হচ্ছিলো না, তিনি কঠিন ভাষায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, গোঁফে তা দিতে দিতে, কিন্তু আমিলিয়া তাকে চোখের ইশারায় নিষেধ করেন।

“কিন্তু, তুমি আমাকে কি করে খুঁজে পেলে তাতো বল্লেনা, চার্লি?’’ আবার জেরা করেন আমিলিয়া।

“ভবঘুরের মতো, এখানে দুদিন সেখানে কিছুদিন করে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোথাও স্থিতু হয়ে বসতে পারিনি। দুনিয়ার এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে, আমি দু’বসর আগে নর্থটাউনে এসে বসতি গেড়েছি। মাত্র তিনদিন আগে ট্রামে যেতে যেতে লোকের মুখে তোমার নাম উচ্চারিত হতে শুনি, তোমার স্বামী মরে গিয়ে তুমি এখন মুক্ত মানুষ তাও জানতে পেরেছি। যে মহিলা তোমার প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন তার সাথে আলাপ জমিয়ে তোমার ঠিকানা যোগাড় করেছি। তারপর চৌদ্দঘণ্টা জার্নি করে আজ এখন তোমার সামনে উপস্থিত হয়েছি।’’

“কি আশ্চর্য ঘটনা, কতো কাণ্ড করে কোন মহিলার কাছ থেকে আমার ঠিকানা যোগাড় করেছো। আচ্ছা, তুমি কি তার নাম জানতে চেয়েছিলে?’’

মিঃ ট্র্যাকার মাথা নাড়লেন যে জানেন না, তবে মহিলাটির চেহারা আর কাপড় চোপড়ের একটা ভাসা ভাসা বর্ণনা দিলেন। “তখন আর কোনো দিকে আমার মনোযোগ দেবার কথা মনেও ছিলো না, হঠাৎ তোমার খোঁজ পেয়ে আমি নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিলো আমি যেন দিবাস্বপ্ন দেখছি।”

“আমি অনুমান করতে পারছি তোমার অবস্থা,” বলেন বিধবা আমিলিয়া।

“আগে যা ঘটে গেছে, সেসব এখন চুকেবুকে গেছে, এখন সবচেয়ে বড় সত্যি হলো আজ আমরা আবার দুজনে মুখোমুখি বসে আছি, আমাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে সুন্দর অজানা ভবিষ্যৎ।”

নেথনের আর সইছিলো না, গলা খাঁকড়ি দিয়ে কথা বলবার জন্য তৈরি হতেই আমিলিয়া ব্রাউন তাকে চুপ থাকার জন্য চোখের ইশারা করলেন।

চার্লির দিকে তাকিয়ে হেসে বল্লেন আমিলিয়া, “আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো মরেই গেছো, এতদিনে।”

উত্তরে চার্লি বল্লেন, “সত্যিই ভাবিনি এ জীবনে আর কক্ষনো তোমার সাথে দেখা হবে।”

“কেউই এমনটা ভাবেনি, তা আপনি ফিরে যাবেন কবে?’’ অধৈর্য হয়ে জানতে চায় নেথন ক্লার্ক।

“ফিরে যাবো, কোথায়?”

“কোথায় আবার, অস্ট্রেলিয়ায়,” আমিলিয়ার দিকে চোরা চাউনিতে হেনে বলে নেথন, “আপনি নিশ্চয় এ’দুটো বসর অনেক মিস করেছেন অস্ট্রেলিয়াকে।’’

নেথন ক্লার্কের দিকে একবার উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আমিলিয়ার দিকে ঝুঁকে চার্লি বল্লেন, “তুমি কি চাও আমি ফিরে যাই?”

আমিলিয়া উত্তর দেবার আগেই ক্লার্ক তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, “আপনি থাকুন বা যান, তাতে আমাদের কিছুই এসে যায় না।”

“আমাদের? আমাদের বলতে কি বোঝায়, বুঝলাম না,” আমিলিয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় চার্লি ট্র্যাকার।

“দেড়মাস পরে আমি আর আমিলিয়া বিয়ে করতে যাচ্ছি,” বলে ক্লার্ক।

চার্লি ট্র্যাকার একবার আমিলিয়ার দিকে আর একবার নেথনের দিকে ভালো করে জরীপ করে দেখলেন, তারপর মাথা নিচু করে নিজের হাতের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। বিধবা আমিলিয়া, কোলের উপর হাত দুটি জড়ো করে, চার্লির মুখের দিকে আশংকামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকালেন।

“আমার মনে হলো, আপনাকে বিষয়টা জানানো দরকার, তাই বললাম,” বলে ক্লার্ক।

চার্লি টান টান হয়ে বসলেন তারপর নেথনের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, “আভিনন্দন, আপনাদের সুখী জীবন কামনা করি,” তবে তার গলার আওয়াজ শোনাচ্ছিলো আবেগশূন্য।

“ধন্যবাদ, নিশ্চয় আমরা অনেক সুখী হবো,” বলে আমিলিয়ার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন নেথন ক্লার্ক। উত্তরে আমিলিয়া কিছুই বললেন না, আবারও তিনি একবার নেথন ক্লার্কের দিকে আবার চার্লি ট্র্যাকারের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

মিঃ ট্র্যাকার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন, আমিলিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমি তাহলে এখন যাই আমিলিয়া”।

“সেকি এখনই যাবে কেন?” বলেন আমিলিয়া।

“নাহ, যাই,” চাপা গলায় বলে চার্লি।

“দূরের পথ তাড়াতাড়ি রওনা হওয়াই ভালো, তা নাহলে ট্রেন মিস হয়ে যেতে পারে,” বলেন, নেথন।

“আমাকে নিয়ে চিন্তা করবার কোনো কারণ নেই মিঃ নেথন, আমি জর্জ হোটেলে এক সপ্তাহের জন্য একটা রুম বুক করেছি । কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভালো।”

“ না, না বাড়ি ফিরে যাবে কেন? থাকো না কিছুদিন, মাঝে মাঝে এসে আমার সাথে দেখা করে যেও। দুজনে মিলে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করা যাবে। আমার ধারণা মিঃ ক্লার্কও খুশী হবেন তুমি থাকলে। কি বলো ক্লার্ক?”

“হ্যাঁ, আপনি থাকলে আমি মহাখুশী হবো,” মুখখানা বাঁকা করে জবাব দেয় ক্লার্ক ।

মিঃ চার্লি ট্র্যাকার দুজনকেই অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে উভয়ের সাথে হাত মেলালেন, তারপর আমিলিয়ার দিকে ফিরে ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। ক্লার্ক আবার দাবার বোর্ডটাকে সাজাতে লাগলেন।

পরেরদিন মিঃ চার্লি ট্র্যাকার বিকেল তিনটার সময় এসে হাজির, তারপরের দিন দুপুর দুটায়। তৃতীয় দিন সকাল সকাল এসে আমিলিয়া ব্রাউন নিয়ে হাঁটতে বের হলেন চার্লি, পথে মিঃ নেথনের সাথে দেখ হতে বললেন, তার সাথেই নাকি দেখা করতে যাচ্ছিলেন দুজন। তারও পরেরদিন নেথন দেখলেন, সাত সকালে আমিলিয়া আর ক্লার্ক প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরে আসছেন।

“দেখেছো নেথন, আমি এরকম লম্বা সময় ধরে হেঁটে বেড়াতেই বেশী ভালোবাসি, কিন্তু তুমি তো হাঁটতেই পছন্দ করো না,” বলেন আমিলিয়া।

“কই এর আগে তো তুমি এই নিয়ে কোনো অভিযোগ করনি এতদিন, আমিলিয়া। তুমিই না তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবার জন্য তাড়া লাগাতে,” অবাক হয়ে বলেন ক্লার্ক।  

“আসলে হাঁটতে হাঁটতে যদি মজার মজার গল্প করা যায় তাহলে আর আমিলিয়ার ক্লান্তি লাগেনা,” তড়িঘড়ি উত্তর দেয় চার্লি।  

নেথন কড়া দৃষ্টিতে চার্লির দিকে একবার তাকিয়ে, চুপচাপ ওদের সাথে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন। নেথন আর আমিলিয়ার এক প্রতিবেশী ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি পুরো ঘটনাটাই দেখলেন। কিছুদূর পর্যন্ত তিনি ওদের সাথে হেঁটে এলেন, কিন্তু চেষ্টা করেও আমিলিয়া বা নেথনের সাথে আজ আর আলাপ জমে উঠলোনা। তার মনে হলো আজ কোনো বিশেষ কারনে নেথনের যেন কথা বলবার আগ্রহ নেই, অথচ নেথন খুব বন্ধুবাৎসল্য মানুষ, খানিকটা সময় ওদের সাথে হেঁটে ক্ষুব্ধ মনে তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন।

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো, তবুও চার্লি ট্র্যাকারের যাবার নাম নেই, হোটেলের মালিক জানালো চার্লি নাকি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার যাওয়া পিছিয়ে দিয়েছেন, শুনে পিত্তি জ্বলে যায় নেথনের। একটা হেস্থনেস্থ করবার উদ্দেশ্যে নেথন ঝড়ের বেগে এসে আমিলিয়ার বসার ঘরে ঢোকেন, ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। চার্লি যে তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। আমিলিয়ার দিকে ফিরে বললেন, “ঠিক ভেবেছি, তোমাকে এখনেই পাওয়া যাবে।”

“আমি তো সবসময় এখানেই থাকি, তাইনা?” বলেন আমিলিয়া। তারপর যোগ করেন, “এই শহরে চার্লির আমি একমাত্র বন্ধু, তাই তাকেও যে এখানেই পাওয়া যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।”

“তুমি কি জানো,  তোমাদের নিয়ে শহরের মানুষ নানা রকমের কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে,” বিড়বিড় করে বলেন ক্লার্ক।

“কানাঘুষা? কি নিয়ে কানাঘুষা হচ্ছে শুনি,” বিধবা আমিলিয়ার গলা রীতিমতো তেতে ওঠে।

“আমাদের বিয়ে নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে,” কথা বলতে গিয়ে তোতলান মিঃ ক্লার্ক।

মিঃ চার্লি ট্র্যাকার আর বিধবা আমিলিয়ার মাঝে দৃষ্টি বিনিময় হয়। হাতে ধরা সিগারটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে মারে চার্লি।

“বিয়ে নিয়ে কথা বলবার জন্য ঢের সময় পাওয়া যাবে, এতো তাড়াহুড়া করবার কি আছে এতে,” একটুখানি চুপ থেকে বলেন আমিলিয়া।

“সময় বয়ে যাচ্ছে, আর তুমিই তো চেয়েছিলে বিয়েটা যেন আগামী মাস দেড়েকের মধ্যেই হয়,” বলেন ক্লার্ক।

“তাড়াহুড়া করবার মতো কিছু ঘটেনি,” দৃঢ় উত্তর আমিলিয়ার।

জবাব শুনে মিঃ ক্লার্ক উঠে দাঁড়ালেন, আমিলিয়ার চোখে চোখ রেখে কথা বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমিলিয়া কার্পেটের উপর থেকে নিজের নজর সরালেন না।

“বুঝতে পেরেছি, আমি তো আর অন্ধ নই,” অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলেন ক্লার্ক।

“আমার কি দোষ বলো, নিজের মনের উপর তো আর নিয়ন্ত্রণ নেই কারো?” পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে কার্পেটের উপর নকশা আঁকতে আঁকতে আনমনা হয়ে জবাব দেয় আমিলিয়া।

জবাব শুনে কঠিন সুরে হাহা করে হেসে ওঠেন মিঃ ক্লার্ক, “আর আমার মন, তার কি কোনো মূল্য নেই? আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলে কেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তোমার মতো একজন মানুষের পক্ষে এমন করা সম্ভব।”

“সত্যিই আমি খুব দুঃখিত নেথন। এমনটা যে হবে কক্ষনো ভাবিনি, আসলে চার্লির সাথে যে আমার আবার দেখা হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি, এতো আকস্মিক ভাবে সব কিছু ঘটে গেলো যে আমি কি করবো কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারছিলাম না। তোমার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম তাহলে শান্তি পেতাম, আশাকরি আমরা আজীবন বন্ধু থাকবো,” কোনো রকমে জড়ানো স্বরে বলেন আমিলিয়া।

“বন্ধু! এই মানুষটির সাথে বন্ধুত্ব? তুমি কি আমাকে ব্যাঙ্গ করছো আমিলিয়া,” ক্ষেপে ওঠেন মিঃ ক্লার্ক।

“এই শহরের মানুষদের কাছে তুমি আমাকে হাস্যস্পদ জীবে পরিণত করেছো। আমার হৃদয়কে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছো, মেয়েলোক সম্পর্কে আমার বিশ্বাসকে একেবারে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছো। আজকের এই আমি আর কক্ষনো পুরনো আমি হতে পারবো না। আশা করি তুমি যেন কোনোদিনও না জানতে পাও, কতোখানি ভুল তুমি করলে,” ভগ্ন কণ্ঠে বলেন ক্লার্ক।

বিধবা আমিলিয়া ব্রাউন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন, মিঃ ক্লার্কের কান্না ভেজা গলার আওয়াজও লুকানো থাকে না।

“তোমার দেয়া সব উপহার কাল আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাবো, আমিলিয়া,” ঘর ছেড়ে যেতে যেতে ক্লার্ক বলেন, “চির দিনের জন্য বিদায়, আমিলিয়া।”

দরজা ঠেলে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন মিঃ ক্লার্ক, কিন্তু আমিলিয়া ব্রাউন চোখ তুলে সেদিকে তাকালেন না, ক্লার্কের পায়ের আওয়াজ তাড়াতাড়িই মিলিয়ে গেলো।

খানিকক্ষণ পরে, মিঃ চার্লি একটা চেয়ার টেনে এনে আমিলিয়ার কাছ ঘেঁষে বসলেন। কয়েকবারের চেষ্টায় ওর হাতটা ধরতে পেলেন।

আমিলিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, “সব আমার দোষ, ভয় হচ্ছে ক্লার্ক আবার যেন কোনো অঘটন না ঘটিয়ে বসে।”

“না না, এমন কিচ্ছুটি হবে না আমিলিয়া, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো,” সান্ত্বনার সুরে বলেন মিঃ চার্লি।

“ক্লার্কের এমন রূপ আগে কক্ষনো দেখিনি, ও যদি কিছু একটা করে বসে তাহলে নিজেকে আমি কখন মাফ করতে পারবোনা,” কাঁদতে কাঁদতে বলে আমিলিয়া, “আমি ওর জীবনটা একেবারে তছনছ করে দিলাম।”

মিঃ চার্লি ট্র্যাকার, অনেকক্ষণ ধরে আমিলিয়া ব্রাউনকে নানাভাবে বোঝালেন, সান্ত্বনা দিলেন। নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে নরম গলায় বললেন, “হতাশা আমার জীবনকেও গ্রাস করে ফেলেছিলো, দেখো আমি কেমন ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠেছি। মিঃ ক্লার্ককে নিয়ে তুমি বেশী ভেবোনা, দেখবে উনি ঠিকই সবকিছু সামলে নেবেন।”

আমিলিয়া ব্রাউন, ফ্যাঁকাসেভাবে একটু হাসলেন, চার্লির কথায় একটু সান্ত্বনা অনুভব করলেন। রাতের খাবারের পর দুজন মিলে তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করলেন। এই শহরে আর বেশী দিন থাকবেন না তারা, স্থির করলেন মিঃ চার্লির সাথে আমিলিয়া ইংল্যান্ডে পাড়ি দেবেন, যেখানে তার ব্যবসা আর ঘরদোর রয়েছে। প্রয়োজনে সাগরের তীরবর্তী কোনো শহরে ওরা ডেরা গাড়বেন। মিঃ চার্লি পকেট হাতড়ে ওনার নোটবুক বের করলেন, ওটা থেকে একটা পুরানো চিঠির খাম বেঁছে নিয়ে ওর উল্টা পিঠের উপর নূতন বাড়ির নকশা আঁকতে লাগলেন।

আমিলিয়া খুব উৎসাহ পাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিলো তিনি যেন কুড়ি বসরের এক তরুণী, সদ্য নূতন সংসার জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। বড় ভালো লাগছিলো ওনার! চার্লির নোট বুকটা নাড়াচাড়া করতে করতে, আমিলিয়া তার প্রশংসায় মেতে ওঠেন। চার্লির, ঘরদোরের নকশা আঁকার দক্ষতা তাকে মুগ্ধ করে। নোটবুকটা থেকে একটি দুটি চিঠি ঝরে পরে, আমিলিয়া সেগুলোকে সযতেœ নোটবুকের ভেতরে গুঁজে দেন, তারপর টুপ করে ঝরে পড়ে একটা নিউজ পেপারের কাটিং, সেদিকে তাকিয়ে আমিলিয়ার চক্ষুস্থির হয়ে যায়!  

চার্লি, নকশা আঁকতে আঁকতে আপনমনে বকবকিয়ে, চলে, “এই যে ছোট্ট বারান্দাটার রেলিং বেয়ে লতিয়ে উঠবে বুনো গোলাপের ঝাড়, কি সুন্দরই না সুবাস ছড়াবে চারিদিকে,” ঘষ ঘষ করে পেন্সিলের আঁক চলতে থাকে কাগজের বুকে, “আর থাকবে কয়েক জোড়া———————‘’ বলতে বলতে থমকে যায় চার্লি। দেখতে পায় আমিলিয়ার কেমন শক্ত হয়ে বসে আছে চেয়ারে, তার রক্তশূন্য বিবর্ণ মুখ কেমন যেন ঝুলে আছে, বড় বড় চোখে ফুটে আছে বিস্ময় আর আতংক।

“কি হয়েছে আমিলিয়া, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?” জানতে চায় চার্লি।

আমিলিয়া কিছু বলবার জন্য মুখ খোলেন, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ ফোটেনা, প্রচণ্ড ভাবে তাঁর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে!

“কি হয়েছে আমিলিয়া, তোমার কি শীত করছে, রুম হিটারটা কি ঠিক মতো কাজ করছে না,” উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে চার্লির আওয়াজে।

আমিলিয়া ব্রাউন আবারও শিহরণমিশ্রিত শ্বাস ফেলেন, কিন্তু কিছুতেই তার গলায় কথা ফোটে না, কাঁপা কাঁপা হতে খবরের কাগজের টুকরাটা তুলে ধরেন, চার্লির দিকে খরচোখে তাকিয়ে থাকেন, তারপর আবার মনোযোগ দিয়ে কাটিংটা পড়েন।

“ট্র্যাকার, আমিলিয়া ব্রাউনের কুড়ি বসর আগের প্রণয়ী, রয়েল হোটেলের লবিতে বসে একদিন এন. সি. এর সাথে খোশগল্প করছিলো। এন. সি. নেথন ক্লার্ক, গত মাসেই ও রয়েল হোটেলে গিয়েছিলো, সেখানেই তুমি ওর কাছে শোনো আমার বিধবা হবার কথা, তার সাথে আমার বিয়ে হবার কথা————চার্লি। আমি যে কি বোকা চার্লি————ঘুণাক্ষরেও আমি বুঝতে পারিনি তোমার চাল। তোমার মন গলানো মিষ্টি কথায় কি করে বিশ্বাস করলাম—————কেন এমন বোকাহাবার মতো কাজ করলাম!”

চার্লি অপ্রভিতের মতো হেসে বিষয়টাকে হাল্কা করবার চেষ্টা করছিলেন, গলাটা খাঁকড়ি দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, “আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা,” খুব নার্ভাস শোনায় তার আওয়াজ।

“হ্যাঁ, ভুলে যে গেছিলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই,” হতাশ স্বরে বলেন, আমিলিয়া।

“তোমাকে পরে দেখাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু মনে ছিলো না। বিশ্বাস করো তোমার কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন করা আমার উদ্দেশ্য নয়, প্রিয়জনের সাথে কোনো ব্যপারে লুকোচুরি খেলা আমার একেবারেই স্বভাব বিরুদ্ধ,” আমতা আমতা করে বলেন চার্লি।

আমিলিয়া বড় করুণ হাসি হাসেন, “এমনই হয় পুরুষ মানুষের প্রতারণা। আর তুমি কিনা আমাকেই লেকচার শোনাতে মেয়েমানুষের সতীত্ব নিয়ে, কেমন হওয়া উচিৎ আমার আচার আচরণ তা নিয়ে। আর ক্লার্ক—————ইনিয়ে বিনিয়ে শুনিয়ে দিয়ে গেলো, কি করে আমি তার মন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছি।”

অস্থির পায়ে ঘরের এমাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পায়চারী করতে থাকে আমিলিয়া, “ কি বলে গেলো ক্লার্ক, এই শহরের লোকের কাছে আমার জন্য তাকে হাস্যস্পদ হতে হয়েছে। এর চাইতেই অনেক বেশী বেইজ্জত হওয়া উচিৎ লোকটির,  ধূর্ততা আর শঠতার জন্য লোকটার কঠিন শাস্তি প্রাপ্য!’’

মিনমিন করে চার্লি বলেন, “আমারও তাই মনে হয়েছিলো,  আমিও তাকে তা বলেও ছিলাম।”

এবারে আমিলিয়া অগ্নিমূর্তি ধারণ করে, “তুমি আবার ক্লার্কের চাইতে কোন অংশে ভালো শুনি? তোমরা দুজনে মিলে আমাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়েছো, আজ আর আমার কোনো সন্দেহ নেই যে গোপনে গোপনে তোমরা রোজ রাতে মিলিত হতে ————আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে, আর কি করে আমার মন নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় সেই যুক্তিবুদ্ধি করতে। আমি হাবাগঙ্গারাম তোমাদের বিশ্বাস করেছি, আর তোমরা আমার মান সম্মান নিয়ে খেলা করেছো।”

চার্লি খোঁড়াযুক্তি দেখবার চেষ্টা করে, “বিশ্বাস করো,এসব করেছি শুধুই তোমাকে পাবার আশায়।”

“ওসব বলে তুমি আর মিছে কথায় চিঁড়ে ভেজাবার চেষ্টা করোনা চার্লি! যদি নিজের ভালো চাও তাহলে গোড়া থেকে আমাকে সব কথা খুলে বলো, কিচ্ছুটি লুকাবার চেষ্টা করোনা, তানইলে তোমার কপালে অশেষ দুর্ভোগ রয়েছে বলে দিলাম,” রীতিমতো ধমকি দিয়ে বলেন, আমিলিয়া।

“যখন আমি স্থানীয় কাগজে দেখতে পেলাম যে, মিঃ ক্লার্ক বিধবা আমিলিয়াকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, আমার মনে তোমার সংগে কাটানো পুরনো দিনের সব স্মৃতি ভেসে উঠলো। আমার মনে হচ্ছিলো, যেন এখনও সব কিছুই আগের মতোই রয়ে গেছে। কল্পনায় দেখতে পেলাম সেই আগের দিনের মতো আমি তোমার হাত ধরে, ফার্মহাউসের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তোমার কোকিলকণ্ঠ আমার কানে শুধা ঢালছে—————!”

“ভ্যানা প্যাঁচাল থামাও চার্লি, ঠিক করে বলো ক্লার্কের সাথে দেখা হবার পর তুমি কি করলে?” ধমকে থামায় আমিলিয়া।

“ক্লার্ক আসলে তোমার কাছ থেকে মুক্তি পাবার রাস্তা খুঁজছিলেন, তাই তোমার সাথে আমার প্রণয়ের কাহিনী আদ্যোপান্ত শুনলেন। দুটি পুরোদিন ধরে আমার সাথে ক্লার্ক আলাপ আলোচনা করলেন, কি করে তোমাকে তার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়। আর আমিও সেই সুযোগ লুফে নিলাম, এমন লোকের খাপ্পর থেকে তোমাকে বাঁচাবার জন্য তার সাথে বন্ধুত্বের ভান করতে লাগলাম।”

“ক্লার্কের কাছে যদি এতোই বোঝা হয়ে গিয়ে থাকি, তাহলে কেন সে নিজের মুখে তা বললে না আমাকে?” জেরা করে আমিলিয়া।

“আমিও তাই ভেবে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ক্লার্ক বললে, তুমি একেবারে জোঁকের মতো লেপটে আছো ওকে। আদতে লোকটা তোমার কোনোদিক দিয়েই যোগ্য নয় আমিলিয়া। ও একটা নিতান্ত কামুক প্রকৃতির মানুষ, ওর নজর এখন অন্য মেয়েলোকের দিকে।”

“এসব কি বলছো তুমি?” প্রায় চিৎকার করে ওঠেন আমিলিয়া।

“আজকাল ক্লার্ক মিস হ্যাঁকবেথের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ভেবে অবাক হই, কি দেখলো ক্লার্ক ওই মহিলার মধ্যে?” বলেন চার্লি।

“মিস হ্যাঁকবেথ—————মিস হ্যাঁকবেথ, তা কি করে সম্ভব?” ঘরের ভেতর জোরে জোরে পায়চারী করতে থাকে আমিলিয়া।

“মনে হয় ক্লার্ক, অন্ধ হয়ে গেছে মেয়েটির প্রেমে,’’শ্লেষ মিশিয়ে বলেন চার্লি।

বিধবা আমিলিয়া হঠাৎ করেই চার্লির একেবারে সামনে গিয়ে থামলেন, ওর দিকে ভয়ানক অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন একেবারে ভস্ম করে ফেলবেন, ভেতরে ভেতরে চার্লি ছটফটিয়ে উঠলেন! একটু পরে তার দিকে থেকে নজর সরিয়ে ঘড়ি দেখলেন আমিলিয়া, চার্লি হালে পানি পেলেন।

“এবার বিদায় হও তুমি,” বললেন আমিলিয়া।

চার্লি এরপরেও অজুহাত খাড়া করবার চেষ্টা করছিলেন নিজের স্বপক্ষে, আমিলিয়া জোরালো কণ্ঠে বাঁধা দিয়ে বললেন,  “আজ আর কোনো কথা শুনবার মতো মানসিকতা নেই আমার, আমি ভীষণ রকমের পরিশ্রান্ত। শুভ রাত্রি।’’

আমিলিয়ার হাত ধরে মৃদু চাপ দিয়ে চার্লি বললেন, “শুভ রাত্রি আমিলিয়া। ঈশ তোমার উপর দিয়ে কি ঝড়টাই না বয়ে গেলো আজ। কাল কি আমি আসবো, রোজ যে সময়ে আসি?”

“হ্যাঁ, এসো,” ক্লান্তস্বরে বললে বিধবা মেয়েটি।

চার্লি ট্র্যাকার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রয়েল হোটেলে ফিরে গেলেন। অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় বসে চুরুট পোড়াতে পোড়াতে নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে রইলেন। সে রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে, মিস হ্যাঁকবেথের সাথে তার ধূমধাম করে বিয়ে হচ্ছে আর মিঃ ক্লার্ক কন্যাসম্প্রদান করছেন। ঘুম ভাংতেই গতকাল রাতের কথা চার্লি বেমালুম ভুলে গেলেন, ঝকমকে সোনালী রোঁদের আভায় চাঙ্গা হয়ে উঠলো তাঁর মন, অনেকক্ষণ ধরে পোশাকের সাথে ম্যাচ করে একটা সুন্দর টাই বাছলেন।

সুস্বাদু নাশতা খেতে খেতে চার্লি মনে মনে রিহারসেল দিয়ে নিলেন, আমিলিয়ার মন গলাবার জন্য কি কি অজুহাত দেয়া যায়। আমিলিয়ার বাড়ির পথ ধরে যেতে যেতে মহড়া চললো। আমিলিয়ার বাড়ির পথ ধরে যেতে যেতেও চার্লি মনে মনে ভেঁজে নিচ্ছিলেন, কি ভাবে কথা শুরু করবেন, কি ভাবে আমিলিয়াকে নিজের সাধুতার সাফাই দেবেন। প্রশান্ত মনে আমিলিয়ার বাড়ির সামনে পৌঁছালেন চার্লি ট্র্যাকার, প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে কল্পনা করতে পরেননি কি বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, পরিতৃপ্ত চেহারার মিঃ ক্লার্ক আর তাঁর বাহুলগ্না হাস্যময়ী আমিলিয়া!

“আলো ঝলমলে প্রভাতের শুভেচ্ছা, চার্লি,” মিষ্টি হেসে বলেন, আমিলিয়া।

প্রাণপণে মুখে হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করতে করতে চার্লি বলেন, “সুপ্রভাত!”

“আজ আমি ভোরসকালেই ক্লার্ককে ডেকে পাঠিয়েছি,। দেখেছো তোমাকে কেমন চমক দিলাম?” মদির হাসি হাসে আমিলিয়া।

গলায় কথা আটকে যায় চার্লির, কোনোরকমে শুধু বলেন, “আসলেই তুমি আমাকে চমকে দিয়েছো, আমিলিয়া।’’

“আমি আর মিঃ নেথন ক্লার্ক গতকাল রাতের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। নেথন বলছেন তিনি সত্যিই খুব দুঃখিত তার আচরণের জন্য, ওনাকে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিতে অনুরোধ করছেন বারবার। আমার মনটাও আবার খুবই নরম, নেথনের এমন করুণদশা আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন। বড্ড মায়া হলো আমার, কি করি বলো নেথনকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে আগে কক্ষনো দেখিনি কিনা?” বলে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসে আমিলিয়া।

“তবে নেথনকে নিয়ে তুমি বেশী ভেবোনা চার্লি, কিছুদিনের ভেতরেই ধাক্কা সামলে উঠবে। আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছি যে!” উৎফুল্ল গলায় বলেন, আমিলিয়া। নেথন ট্র্যাকারও মাথা নেড়ে আমিলিয়ার কথার সমর্থন জানালেন।

তিক্ত মুখে মিঃ ক্লার্ক আর চার্লি ট্র্যাকার পরস্পরের সাথে হ্যান্ডসেক করেন, উভয়ের চোখ থেকে ঝরে পড়ছিলো তীব্র ঘৃণা!  

“গুড-বাই, মিঃ চার্লি ট্র্যাকার,” ক্লার্কের হাতের ভেতরে নিজের হাতখানা জড়িয়ে নিয়ে, বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেন বিধবা আমিলিয়া ব্রাউন। “নেথন হয়তো আমাদের বিয়েতে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাবে, কিন্তু আমি বলি কি নিমন্ত্রণ পেলেই যেন আবার ছুটে এসো না, লোকে আবার তা নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে। আর, আমার মোটেও ইচ্ছে নেই যে তুমি আমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকো কাবাবের মাঝে হাড্ডির মতো,” বলে, নেথন ক্লার্কের হাতখানা সজোরে আঁকড়ে ধরে উল্টাদিকে হাঁটতে শুরু করেন আমিলিয়া।

হতভম্বের মতো সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, মিঃ চার্লি ট্র্যাকার। তারপর পরাজিত অপমানিত চার্লি মাথানিচু করে, দ্রুত হোটেলের দিকে হেঁটে চললেন। তার এই হটকারিতার খবর অন্যের কানে পৌঁছাবার আগেই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে তার চলে যাওয়া উচিৎ।       

ইংরেজ লেখক জেকব (১৮৬৩-১৯৪৩) ছিলেন একাধারে ছোট গল্পের রচয়িতা, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন হাস্যরস রচয়িতা হিসাবে, তবে তিনি বেশ কিছু ভৌতিক কাহিনীও লিখেছেন।
জেকবের জন্ম ইস্ট লন্ডনের সাউথ দেভেন অঞ্চলে, তার পিতা ছিলেন জাহাজ বন্দরের ম্যানেজার। তাই জন্ম থেকেই তিনি বন্দরের মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে নিরীক্ষণ করবার সুযোগ পান। তার গল্পের সময়কাল ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জাহাজের লোকদের বৈচিত্রময় চরিত্র, সমুদ্রগামী জেলে ও তাদের রোমাঞ্চকর সামুদ্রিক অভিযান, সমুদ্রে যাবার সুযোগ বঞ্চিত মানুষ ও তাদের অসাধু জীবন জীবিকা এবং অন্যদিকে তার গ্রামের লোকদের ভূতপ্রেত ওঝা তুকতাকে বিশ্বাস- এসবও তাকে প্রচুর লেখার খোরাক জুগিয়েছে।   
তার গল্প অবলম্বনে অনেকগুলো বক্স অফিস সফল চলচিত্র তৈরি হয়েছে।