করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





শিল্পী নাজিব তারেকের স্টুডিওতে
আল ইমরান
যে কোন মানুষ প্রাকৃতিক ভাবেই যুগপৎ সাধারণ ও অসাধারণ দুটি সত্তা নিজের ভেতর ধারণ করে। সাধারণ সত্তাটি পৃথিবীর সমগ্র মানুষের মত জীবনচক্রের অমোঘ নিয়মে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে অসাধারণ সত্তাটি আমৃত্যু আত্মানুসন্ধানে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আত্মানুসন্ধানের যাতনা থেকেই মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে। এমনই একজন শিল্পী নাজিব তারেক।
তাঁর নানবিধ পরিচয়। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র হয়েছিলেন। এখানে শিক্ষাকাল কাটিয়েছেন প্রিন্টমেকিং বিভাগের ছাত্র হিসেবে। তিনি শুধু ছবিই আঁকেন না। তিনি পদ্য লিখেছেন, লিখছেনও। বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ থেকে শুরু করে সাহিত্য সাময়িকীর সচিত্রকরণ, হাল ফ্যাশনের ট্রেন্ডি টি-শার্ট থেকে বহুজাতিক কোম্পানীর ব্র্যান্ড মার্কেটিং সব জায়গায় তিনি তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য পদচারণা করেছেন। প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনকে তিনি একটি শিল্পমাধ্যমে পরিণত করার প্রয়াস চালিয়ে এসেছেন। যার ধারায় তাঁর প্রতিটি ইলাস্ট্রেশন হয়ে উঠেছে এক একটি শিল্পকর্ম। ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে , স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই, জয়নুল জন্মোৎসব, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূলের লড়াই, পহেলা বৈশাখ Ñ এমন আরো উদ্যোগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় তিনি। বিশ শতকের আশির দশক থেকে শিল্পের দিনপঞ্জি ঘাটলে দেখা যায় এমন কোন তারুণ্যের উদ্যোগ নেই যেখানে তিনি উদ্যম হিসেবে নেই। হোক সেটা সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বইমেলা, রাজনীতি কিংবা কবিতা উৎসব। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের অনলাইন গ্যালারির উদ্যোক্তা। দেশের প্রথম শৈল্পিক ট্রেন্ডি টি-শার্ট ব্যবহার আন্দোলনের অগ্রদূত তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মুখোমুখি যেখানেই হোক, তিনি নিজের মতামত, বিশ্বাস দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেন অকপটে। শিল্পী নাজিব তারেক বিশ্বাস করেন শিল্পে কখনও কোন প্রতিযোগিতা হয় না। তাই নিজেকে স্বেচ্ছায় আড়াল করে রেখেছিলেন ১৯৯৬ থেকে সকল  প্রকার প্রতিযোগিতামূলক শিল্প প্রদর্শনী থেকে। এর মধ্যে অবশ্য তাঁর আঁকাআঁকি বা শিল্পকর্ম প্রস্তুতিতে কোন বিরাম ঘটেনি। ঠিক তেমনভাবেই বিরতিহীনভাবে একে গেছেন যেমনটি তিনি আঁকতেন চারুকলার শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় অনুশীলনের জন্যে। পরবর্তীকালে তাঁর এই নীরবতা ভেঙেছেন ২০০৯ সালে একান্ত বাধ্য হয়েই। তারই নিজের হাতে গড়া দেশের প্রথম অনলাইন গ্যালারীর ৩য় প্রদর্শনীতে। সেই ১৯৯৪ সালেই করেছিলেন নিজের দুটি একক প্রদর্শনী। এর পর বন্ধুদের অনুরোধে একটি রঙ কোম্পানির পসার বাড়াতে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু সেটাও ১৯৯৮ পর্যন্ত। প্রদর্শনী বা বিক্রয়শালা কোথাও উপস্থিত না থাকলেও তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল তাঁর নিজের স্টুডিওতে। একজন শিল্পীর শিল্পকর্মের সূতিকাগারই হল তাঁর প্রিয় স্টুডিও। যেখানে তিনি জন্ম দেন কালোত্তীর্ণ সব শিল্পকর্মের। শিল্পী নাজিব তারেক বর্তমানেও একে যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় স্টুডিওতে।
কয়েকদিন আগে কথা হয়েছিল তাঁর নিজ স্টুডিওতে, নানা বিষয়ে। কথায় কথায় জানা হল, তাঁর স্টুডিও শুরুর দিকের অনেক খুটিনাটি বিষয়। চারুকলায় পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিবাহউত্তর সময়ে এক কক্ষের ছোট সংসারের তাঁর ব্যবহৃত টেবিলই ছিল তাঁর স্টুডিও। সময়ের পরিক্রমায় সংসারের কক্ষের সাথে সাথে তাঁর স্টুডিওর পরিসরও বাড়তে থাকলো। বর্তমানে নিজ বাসস্থানের দুটি কক্ষ নিয়েই গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষগুলো বরাররই সময়ের সম্মুখে থাকেন কিন্তু একটু আড়ালে। শিল্পী নাজিব তারেক তাদেরই একজন। তো তাঁর স্টুডিও আর সব শিল্পীদের মত সাধারন হলে কি চলে! তাই ২০১২ সালে দেশের সর্বপ্রথম শিল্পী হিসেবে স্টুডিও প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। অবশ্য সেটা ছিল ভাড়া বাসা। নিজস্ব জমিতে নিজের চাওয়ার মত করেই একটা স্টুডিও চাই। তাই পরবর্তীকালে পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া জমির উপরেই গড়ে তুললেন বর্তমান স্টুডিও। তিনতলা বাড়ির নিচতলা স্ত্রীর বুটিক স্টুডিও ,২য় তলা আবাসস্থল এবং ৩য় তলায় শিল্পী ঘাটি বেঁধেছেন স্টুডিও ৬/৬ নামে। এটি শুধুমাত্র তাঁর কর্মক্ষেত্রই নয় রীতিমত আড্ডার জায়গাও! নিয়মিত বিরতিতে এখানে জমে শিল্পীদের শিল্প আড্ডা, কবিতার আসর, কিংবা বন্ধুদের বই প্রকাশনা আড্ডা। আড্ডাগুলি কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে আগায় না। এখানেই আলোচ্য বিষয় তৈরি হয়। অবশ্য সাজানো, গোছানো আড্ডাগুলিও আরো মজাদার।
“স্টুডিও ৬/৬-এর শিল্প আড্ডা” নামের এই আড্ডাগুলি আছে শিল্পপ্রাণ মানুষের জন্যে ইউটিউবে। শিল্পীর স্টুডিওতে আড্ডা দিতে চাইলে যে কেউই তাঁর স্টুডিওতে চলে আসতে পারেন, চা-মুড়ি আর চিত্রকর্ম দর্শন ফ্রি। আমাদের দেশে এমন সুযোগ কমই আছে। সেটা তিনি কী অবলীলায়ই না করে ফেললেন শিল্পপ্রাণ মানুষের জন্যে। চার দেয়ালের স্টুডিওর মাঝে শিল্পী বরাবরই স্বাধীন সম্রাট। তাঁর স্টুডিও ঘুরে দেখা গেল এক এক টেবিলে এক এক ধরনের কাজ। বিমূর্ত কিংবা ফিগারেটিভ, কোলাজ অথবা জলরং , কালি কিংবা বলপেন সকল মাধ্যমেই তাঁর সমান মুন্সিয়ানা চলছে। তবে তাঁর কাজের মধ্যে রেখার উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। এব্যাপারে তাঁর মতামত হল, “আমি আমার ফর্মের কারণে রেখাতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করি। আমি দেখেছি আমার ফর্মে রেখাই আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন সুবিধাজনক করে তোলে।”
এক্রেলিক, তেলরং বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙ কিংবা কাপের অবশিষ্ট চা কোন কিছুই তাঁর স্টুডিওতে অচ্ছ্যুত নয়। সব মাধ্যমেই সমান দখল দেখিয়ে তিনি এঁকে চলেছেন। বর্তমানে পেন্সিল, কালি তুলি, প্রচলিত মাধ্যমেই শিল্পী কোনভাবেই সীমাবদ্ধ নন। কম্পিউটার, স্মার্টফোনও তাঁর স্টুডিওরই অংশ। তাঁর শিল্প যাত্রায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তাঁর হাতের কাছে যা আসছে তাই পড়ে ফেলছেন, কোন রুটিন নেই। তাঁর পড়া নিয়েও আঁকছেন। শিল্পী ব্যক্তিজীবনে এবং সমানভাবে অনলাইনেও তাঁর শিল্পসত্ত্বা নিয়ে প্রভাবশালী। ফেসবুক আর্ট  প্রজেক্টে  তাঁর  “দেখা না দেখার বয়ান, ও ঈঙগগঙঘডঊঅখঞঐ ঝখঅঠঊ’’ এ্যালবামগুলি তাঁর প্রতিদিনের শিল্পচর্চার অংশবিশেষ। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে বাংলাদেশি অগ্রজ শিল্পীদের কাজের প্রতিলিপি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ১৯৯৭ সালে ইয়াহু পিকচারে শুরু করেছিলেন এখনও তা করছেন বিরামহীনভাবে।
সাম্প্রতিক কাজের প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, নিজের পছন্দমত কাজ করছেন তিনি। গত ডিসেম্বরে বিশজন বুদ্ধিজীবির প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এবং লিখেছেন একইসাথে। আর এখন অপেক্ষা করছেন সেটার বই আকারে প্রকাশের অপেক্ষায়। আর সবকিছুই করছেন তিনি নতুন পুরাতনের সমন্বয়ে। এই সময়ে এসেও তিনি অভ্যাসবশত এসকল কাজ করে চলেছেন নতুন উদ্যমে যা আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে সত্যিই বিরল। জানতে চেয়েছিলাম আপাতত স্টুডিও নিয়ে তিনি কি ভাবছেন বা কি পরিবর্তন চান। এ প্রসঙ্গে তিনি ভাবছেন, ছাপচিত্র বিভাগের একজন ছাত্রের স্টুডিওতে ছাপাই মেশিন নাই, এটা তাঁর জন্যে একটু মন খারাপ করা ব্যাপার। তবে আশা করছেন সেটা খুব দ্রুতই হয়ে যাবে এবং শিল্প পিপাসুদের জন্যে তখন ছাপাই ছবির স্বল্পমূল্যের সুযোগটিও সকলের জন্যে অবারিত করতে পারবেন।
তরুণ এবং শিল্পীদের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি একবাক্যে প্রসঙ্গ শেষ করতে চাইলেন। তিনি ফরাসি সাহিত্যিক শার্ল বদলেয়ারের একটা উক্তির সাথে একমত পোষণ করে জানালেন,’’আধুনিক শিল্পী রচনা করেন অজানা বাজারের জন্যে।” বাক্যটি শোনার পর যে কারোরই কথাটির মর্মার্থ উদ্ধারের কিছুক্ষণ সময় ভেবে দেখা বাধ্যতামূলক। সত্যি বলতে প্রত্যেক শিল্পীরই স্বপ্ন ধরার জাল বুনতে হয় নিজের মত করেই, তারপর বসে থাকা বিশ্বের চলাচলের পথের ধারে নিজের আসন নিজে বিছিয়ে, চুপটি করে নয় সজাগ হয়ে। শিল্পী নাজিব তারেকের শিল্পের আখড়া হল ৬/৬। এখানেই তিনি শিল্পের জাল বুনেন, পড়ে থাকেন নিমগ্ন শিল্প সাধনে। তিনি বিশ্বাস করেন “শিল্পই আমাদের মানুষ করে।”  শিল্প সাধনা, স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী, শিল্প সচেতন প্রতিটি মানুষই শিল্পীর এই উক্তির যথার্থতা অনুভব করতে পারেন।