করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





কবি শামসুর রাহমান স্মরণ
উজ্জ্বল কথার মিছিল
মারুফ রায়হান
কবির প্রয়াণের প্রায় এক দশক পেরিয়ে আজ আমরা স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারি, আমাদের সমাজে তাঁর অনুপস্থিতির অভাব। শামসুর রাহমানের সমতুল্য ভাবমূর্তি, কবি-ব্যক্তিত্ব কিংবা সামাজিক প্রগতিশীল আইকন যেটাই বলি, আর কোনো কবির পক্ষে অর্জন এখন অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। কবি-অভিধাটির ওপর অপরাজনীতি ও কালের অবক্ষয় নেতিবাচক আস্তর ফেলে চললেও আমরা জেনে গেছি, কবিরও এক ধরনের সামাজিক অনিবার্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা থাকে। গজদন্তমিনারবাসী আখ্যা দিয়ে অর্বাচীনেরা কবিদের যতোই দূরবর্তী করে তোলার কসরৎ করুক না কেন, একজন সার্থক কবি পান অতিসাধারণ মানুষেরও ভালোবাসা ও সমীহ। কবিতার মর্মার্থ না-বোঝা গড়পড়তা সাধারণ লোকের হৃদয়েও কবির জন্য থাকে এক পরম আসন। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি, জীবনযাপনে হিপোক্র্যাসি এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠিমনস্কতা কবিকে না দেয় কবিখ্যাতি, না পান তিনি মানুষের সত্যিকারের শ্রদ্ধা। ধ্যানী অচঞ্চল স্রষ্টা ও দ্রষ্টার মতো কবি একাগ্র থাকেন তাঁর নিজস্ব ভুবনে; কাব্যসৃজনই তাঁর আরাধ্য। আজ কবি শামসুর রাহমানের বিদায় নেয়ার দিনটিতে সার্বিকভাবে ‘কবি’ ধারণাটির চারদিকে আলো ফেলে বুঝে নিতে চাইছি আমাদের সমাজে কবিজীবন বেছে নেয়া কোনো ব্যক্তির নীতি ও নিয়তি। যাহোক, কবি শামসুর রাহমানের কবিজীবনের সূচনাপর্বের দিকে আমাদের ফিরে তাকানো জরুরি।
যে কোনো কবিপ্রতিভাকে বুঝতে তাঁর আবির্ভাবের সময়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ষাট দশকের প্রত্যূষকালে ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্য প্রায় নিঃশব্দে অথচ ঋজু ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের কবিতায় বাঁকবদল অত্যাসন্ন। কথা বা শব্দ দিয়েই গড়া হয় কবিতা, আকাশ থেকে বর্ষিত হয় না তা, সেই শব্দ যোগান দেয় কবির গহীন সত্তা এবং বাস্তব পারিপাশর্^। উন্মেষপর্বে ‘রূপালী স্নান’ কবিতায় ‘মিছিল’ শব্দটি এসেছে এভাবে- ‘উজ্জ্বল কথার মিছিল’। কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করা যাক:
    কোনো একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি
হয়তো হিস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল
    সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল
আমরা এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে দেখব শামসুর রাহমান কেবলই গড়ে চলেছেন ‘উজ্জ্বল কথার মিছিল’। সমকাল বৈরী, পরিস্থিতি টালমাটাল, শহর অস্থির, স্বদেশ উত্তাল; কিন্তু কবির কাজ সেই উজ্জ্বল কথার মিছিল গড়ার ব্রতটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন তিনি। ছন্দে গাঁথা সেসব কথা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সমাজের অগ্রসর, শিক্ষিত, রুচিবান ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকেরই হৃদয়ের উচ্চারণ। ওই যে রূপালি স্নান থেকে আমরা কয়েকটি পঙ্ক্তি আউড়ালাম, সাধারণের চোখে তাতে ধরাই পড়বে না যে, কথাগুলো ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে একটানা (বা প্রবহমান) লিখে যাওয়া। সেইসঙ্গে কবিতাটিতে অন্ত্যমিলও রয়েছে। একই ভঙ্গিতে (আঙ্গিকে) লেখা সেই সুবিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটিও। যদিও সেটিতে অন্ত্যমিল ব্যবহার করেননি কবি। তবে তাতে প্রতিটি বাক্যবন্ধের শুরুতে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কথাটি স্থাপনের ফলে একটা ঘোর লাগা ভাব চলে এসেছে। যেমনটা হয় গানের বেলায়, ঘুরেফিরে একটি চরণ বারবার গীত হয়। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটিতেও শিরোনামটিই পুনপুনঃ উচ্চারিত। বলা প্রয়োজন, শামসুর রাহমানের প্রায় সকল কবিতাই ছন্দে রচিত উজ্জ্বল কথার মিছিল। এই মিছিলের অভিষ্ঠ শেষাবধি শিল্পার্জন বা নান্দনিকতা এবং বিশেষ বোধের উৎসারণ ও উপস্থাপন।

বাংলাদেশের কবিতায় কবি শামসুর রাহমানের মৌলিক অবদান নিয়ে এখানে খুব সংক্ষিপ্তভাবে কিছু কথা তুলে ধরার সুযোগ নিচ্ছি। কবিতায় শামসুর রাহমানের সামগ্রিক অর্জনের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে যে তিনি এই অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রাচীনত্বগন্ধী রিক্ত কাব্যভাষাকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুমার্জিত, আধুনিক, মুখের ভাষার কাছাকাছি নাগরিক কবিতার ভাষা। এই তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তাঁর আগেও দু’তিনজন কবি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিলেন, তবে সফল পদরেখা প্রোথিত করেন তিনিই প্রথম। পরবর্তীকালে অনুগামী পান অনেক, অনুসারী সুপ্রচুর। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ স্পষ্টতই বদলে দেয় বাংলা কবিতাবিশ্বকে। ভাষা, চেতনা, বোধ, আবেগ, বৈশিষ্ট্য- সর্ববিচারে বাংলা কবিতার ঘটে পালাবদল। এখানে যে পাঁচটি উপাদানের কথা বলা হলো তার প্রতিটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্যে প্রয়োজন পৃথক পাঁচটি প্রবন্ধ-পরিসরের। আধুনিকতা, নান্দনিকতা, বিশ্বনাগরিকতা, মননশীলতা এবং বাস্তব ও কল্পনার সাংগীতিক সমন্বয়- প্রতিটি ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের অবদান এক কথায় অসাধারণ।
তবে পরবর্তীকালে আমরা বিশাল শব্দভা-ার গড়ে তোলা নতুন এক শামসুর রাহমানকে আবিষ্কার করি। এই শামসুর রাহমানের বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি এমনই অবিকল্প হয়ে উঠেছিল যে তা স্বচ্ছন্দভাবে কবিতায় ধারণে সক্ষম ছিল বাংলার আধুনিক মানুষের যে কোনো বিষয় বা বক্তব্য। কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল দিনানুদৈনিক ঘটনা, অনুভূতি কিংবা অনুষঙ্গের সহযাত্রী। ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’- কবিতার শিরোনামই বলে দেয় এর ভেতরকার বক্তব্য। সেই যে শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের মুখচ্ছবি ফুটে ওঠার শুরু, তাতে আর ছেদ পড়েনি। বরং বিকশিত হয়েছে সর্ববিধ ও সর্বোচ্চ রূপ নিয়ে। স্বদেশের প্রতিটি বড়ো কম্পনে, ক্রন্দনে; অর্জনে, বিসর্জনে, আঁধারে ও আলোকছটায় সৃজিত ও স্পন্দিত হয়েছে তাঁর শব্দেরা। দেশ, দেশের মানুষ, চলমান সময়, কবিসত্তা- সব বেজে উঠেছে এক তানে, একাকার হয়ে গেছে সব। এভাবেই তো পাওয়া একাত্তরে ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’; পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার প্রেক্ষাপটে ‘ইলেকট্রার গান’; পুনরায় জলপাই রঙে দেশ ঢেকে গেলে ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ এবং এরশাদের স্বৈরশাসনকালে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘একজন শহীদের মা বলছেন’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’; ২০০০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘সুধাংশু যাবে না’সহ অনেকানেক কবিতা।
কবিতার কাছে মানুষ কী চায়? একটু সান্ত¡না আর আশ্রয়ই তো! জীবনের কষ্টগুলোকে খানিকটা সরিয়ে রাখার সামান্য একটু শক্তি এবং নতুন কোনো উপলব্ধি। মানুষের রচিত উজ্জ্বল কথার মিছিল মানুষের ম্লান মুখে অনির্বচনীয় আনন্দ-ছটা এনে দিতে সক্ষম। সেই ষাটের দশক থেকে শুরু। বাংলার মানুষ নতুন স্বপ্ন বুনছে- স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ওই দেখা যায়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা তো অর্জিত হলো, তারপর? স্বপ্নভঙ্গের পালা শুরু, স্বপ্নভস্মেরও পালা বটে। দশকের পর দশক দেশের মানুষের সংবেদনশীল শিক্ষিত অংশ কথিত সেই সান্ত¡না, প্রেরণা আর মনোজগতের আশ্রয়ভূমির সন্ধান পেয়েছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়। শুধু কি তাঁরই কবিতায়? না, তাঁর জীবদ্দশায় আরো অনেকেরই কবিতায়। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিন? সেই কবিতার দিন? কোথায় হারালো ব্যক্তিকবির সেই মর্যাদাপূর্ণ আসন! সেই ভালোবাসা, প্রেম পরমনির্ভর!