করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





জন্মশতবর্ষে সমর সেন
মারুফ রায়হান
পাথর দিয়ে গড়া ভাস্কর্যের অবয়ব কি ধরে রাখে না সুরের লাবণ্য? পাহাড় ফেটে যখন ঝর্ণার উচ্ছ্রিত রূপালি রেখা অবনত হতে থাকে ভূমির শরীরে; তখন সেটিও কি কবিতা নয়! মানুষের আলাপ, সংলাপ-কথোপকথন কাব্য নয়; তবু তাতে উঁকি দিতে পারে কবিতাসুধা। আধুনিক বাংলা কবিতার দুর্মর এক প্রেমিকের নাম সমর সেন। দীর্ঘায়ু পেলেও তিরিশের দশকে যৌবনে কবিতায় সমর্পিত এই কবি লিখেছেন সাকুল্যে বারো বছর। তার পর সরে যান কবিতা থেকে। ওই বারো বছরকে যদি সমর-যুগ নাও বলি, তবু অসত্য হয়ে যাবে না তার যুগান্তকারী অবদান। গদ্যগন্ধী শব্দের ভেতর কবিতার লাবণ্য লতিয়ে দেওয়া এবং প্রকৃত গদ্য ছন্দে কবিতা রচনা- এ দুটো প্রায় বৈপ্লবিক কাজের জন্য সমর বাংলা কবিতার ইতিহাসে নিশ্চয় অমর হয়ে থাকবেন। তার জন্মশতবর্ষে আমাদের সমীহ মিশ্রিত শ্রদ্ধার্ঘ্য। আশা করছি, ক’দিন পর ১০ অক্টোবর তার জন্মদিনে তাকে দেশের কবি ও কবিতানুরাগীরা স্মরণ করবেন।
বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি, তিরিশের প্রবল পরাক্রমশালী পাঁচ মহৎ কবির পর বাংলা কবিতার যে বাঁকবদল এবং আবহমানতা- দুটোর মাঝখানে নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো সমর সেনের অবস্থান। তার অনুসারী তেমন পাননি, ঘরানাও গড়ে ওঠেনি। যদিও বাংলাদেশের কবি আবুল হোসেন তার আঙ্গিক ও বলার ধরনকে সমর্থন করেছিলেন, নিজেও ব্রতী হয়েছিলেন কবিতার নতুন পথ ধরে হাঁটতে। মৌলিকতা অর্জনকারী সব তাৎপর্যপূর্ণ কবির মতোই সমর সেনের কণ্ঠস্বর স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। অভিন্ন কবির মন ও মনন থেকে সেসব উৎসারিত- তাতে সন্দেহ নেই। বলতে চাইছি, পূর্ববর্তী কবিদের লক্ষ্যযোগ্য প্রভাব তার ওপর পড়েনি বরং তৎকালীন কবিতাসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গানের পঙ্ক্তি তিনি ব্যবহার করেছেন। বলা সঙ্গত, প্রয়োগ করেছেন রবীন্দ্রসুর ও ভাবের মহিমা মুছে আত্মস্বাক্ষর উৎকীর্ণ করার অভিপ্রায়ে। তার অগ্রজ পাঁচ সর্বাধুনিক কবির মানস ও বিকিরণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক তিনি। গজদন্তমিনারবাসী বলে অপবাদ জুটেছে চিরটাকাল কবিদের। কিন্তু সমর সেনকে সে দোষে দুষ্ট করা চলবে না। বিশ্ব সমর এবং তার অভিঘাতে বদলে যাওয়া ভূগোল, সংগ্রামী লোকসমাজের টানাপড়েন শুধু সমরের কবিতাই ধারণ করেনি, বরং কবিতার অপারগতার প্রপঞ্চকেও সামনে নিয়ে এসেছে। ‘একটি রাত্রের সুর’ কবিতায় তিনি লিখলেন- বাতাসে ফুলের গন্ধ, আর কিসের হাহাকার। এই যে জীবনের সুঘ্রাণের সঙ্গে বেঁচে থাকার দুঃসহ বেদনার ভার এক সুই-সুতোয় সেলাই করে দিলেন, তাতে মনে হলো এই কবিকণ্ঠ রোমান্টিতাকে স্বাগত জানিয়েও ভোলে না কী কঠিন নিরেট ভূমিতে তার দুই পা প্রোথিত। অন্ধকার হলো আলোহীনতা- এ সবাই জানে। সেই অন্ধকার যে হতে পারে সুন্দর এবং একই সঙ্গে ভারী- সেও কি আমরা জানি না? কিন্তু ঘনায়মান অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো একটি দ্রুতযান কবিকে যখন বিদ্ধ করে অপসৃত হয় তখন আমাদের শ্রুতি বধির করে দেয় সেই জীবনের গতির বাস্তবতা। সেই গতিময়তা যে অন্ধকার রাত্রির মতো সুন্দর আর ভারী- এই সত্য আমরা প্রথম জানলাম যেন সমর সেনের কাছ থেকে।
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা নিয়ে কবিদের মাতামাতি সর্বজনবিদিত। সেখানে সপ্রতিভতার বদলে আবেগের বাহুল্য বহুবিচিত্রভাবে প্রকাশিত। ‘শীতের আকাশে তীক্ষ্মতায় তারাগুলি আঁকা।’- শীতরাত্রির সনাতন ছবি আঁকতে গিয়েও সমর সেন তাতে সঞ্চার করে দেন আপন স্বাক্ষর। ‘নাগরিকা’ নামের এই কবিতায় ‘তীক্ষ্মতা শব্দের সমান্তরালে আমরা দেখব ‘হিংস্র হাহাকার’। হাহাকার যে হিংস্র হতে পারে, তার তুলনা বাংলা কবিতায় আর দ্বিতীয়টি নেই।
সমর সেনের শুরু অনেকটা শান্ত বিদ্যুতের মতো। প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের ঋজু প্রবহমানতার ওপরে হঠাৎ ঝলসে ওঠা আলোকরশ্মির মতো। তাতে হয়তো সনাতন দৃঢ়তার পাঁজরে কোনো ধাক্কা এসে লাগে না; শুধু এক অভিনব আশ্চর্য অস্তিত্ব এসে তার জাগরতা জানান দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এবং তার পরবর্তী পাঁচ আদিম দেবতার সদর্প প্রসারণের উপরিতলে ওই বিদ্যুচ্চমকের সহসা সংকেত অবশ্যই বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত সঞ্চালন এনে দিয়েছে।

সমর সেনের প্রথমদিকের কবিতায় বিষণœতার সৌন্দর্য আবিষ্কার করা যায়; তাতে সত্যের সৌন্দর্যও অপ্রকাশিত থাকে না। ওই হাহাকারময় বিভিন্ন সত্য প্রকাশের জন্য যে শব্দসম্ভার কবি নির্বাচন করেন তাতে কবিতাদেবীর রহস্যমদিরতা ছাপিয়ে রাজত্ব করতে থাকে শিক্ষিত নাগরিক আধুনিক মানুষের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত শব্দ ও প্রকাশভঙ্গি। তার প্রথমদিককার এক মুঠো কবিতার ভেতর উঠে আসতে থাকে ঘুরেফিরে কিছু শব্দ। শব্দ তো নয় যেন প্রতীক; যেন আস্ত এক পরিস্থিতি। অন্ধকার, স্তব্ধতা, নিঃসঙ্গতা, হাহাকার, গন্ধ, রাত্রি- এসব শব্দ ছবি আঁকতে থাকে বাস্তব জীবনের বিমূর্ত ইশারাগুলো একটু একটু করে মেলে ধরতে। প্রেমকামনাকে বিষাক্ত সাপের বিশেষ ক্ষুধার সঙ্গে অভিনব তুলনা সমর সেন প্রথম দিলেন। লালিত্য, পেলব কোমলতা, ভাবাবেগ-ভারাতুর হৃদয়োচ্ছ্বাস- প্রেমের কবিতার বাঙালিসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো মাত্র দুটি পঙ্ক্তির ধাক্কায় লজ্জিত হলো :বদলে গেল হাজার বছরের চর্চিত প্রসারিত প্রেক্ষাপট :

বিষাক্ত সাপের মতো আমার রক্তে

তোমাকে পাবার বাসনা।

(প্রেম)

উপমা উপস্থাপনের জন্য সর্প স্পর্শ করার অন্তত তিনটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। ‘একটি রাত্রের সুর’ কবিতায় অন্ধকারের ছবি আঁকার উল্লেখ আগেই করেছি। ‘অন্ধকার ধূসর’- এটি বাস্তবানুগ ছবি। কিন্তু ‘সাপের মতো মসৃণ’? বিভীষিকা ও শিরশির অনুভূতির রাত্রির অন্ধকার এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কেমন জান্তব ও যৌনতাজাগর হয়ে উঠেছে! এবার ‘ঝড়’ কবিতায় আকাশে জমে ওঠা মেঘকে বলছেন, ‘শীতের অজগরের মতো’। বাংলা কবিতায় মেঘ, আকাশ নিয়ে কতই না ছিঁচকাঁদুনে কাব্যিকতা, গলে-গলে পড়া আবেগ! সেই চিরন্তন চিরপ্রতিষ্ঠিত তুলনা-উপমা-চিত্রকল্পের বহুল একমাত্রিকতায় অকস্মাৎ সমর সেন এনে দিলেন অভূতপূর্ব অভাবিত অভব্য এক অভিঘাত। শীতে জবুথবু জরাগ্রস্ত কুণ্ডলী পাকানো বিশাল অজগরের স্থাণু হয়ে থাকার ছবি চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে খান খান ভেঙে দিলেন মেঘবিলাস মেঘমল্লার। ‘সাপ’-এ আপাত নিরীহ, অথচ ‘হিংস্র’ বিশেষণে বহুল প্রচারিত প্রাণীটি সর্বযুগেই কবি-চিত্রকরসহ নান্দনিক সৌন্দর্যপিয়াসী ব্যক্তির কাছে রহস্যময়। সমর সেন একদিকে এ জীবটিকে ‘বিষধর’ হিসেবে দেখেছেন, অন্যদিকে রূপময় সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবেও প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘নাগরিক’ তার প্রতিনিধিত্বশীল একটি কবিতা, যেখানে ‘পাথরের ওপর রোলারের শব্দের মতো রাতে’ প্রত্যাশার মুহূর্তগুলো ‘সোনালী সাপের মতো অতিক্রম করে যায়’।
উদ্যান উজাড় হওয়ার আগে একদা পত্রপল্লবশোভিত বৃক্ষকুল যখন জীবন্মৃত, সেই ঊষরউন্মুল প্রান্তরে প্রানস্পন্দনের মতো গুঞ্জরিত হয় ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি। সমরের কবিতা সেই মর্মর ধ্বনির মতো মর্মবিদ্ধ করে যায় নিস্পৃষ্ট, স্তব্ধ অথচ গভীর সংবেদী মানব-মননে। হৃদয় সান্ত্বনা পায়। স্তিমিত রক্তে এসে লাগে করুণ পুলক।

***
জন্মশতবর্ষে সমর সেনের (১০ অক্টোবর ১৯১৬- ২৩ আগস্ট ১৯৮৭) কবিতা আবার পঠিত হচ্ছে। সত্য হলেও এ কথার অন্য মানে দাঁড় করানো যায়। পাঠক বলবেন, জন্মশতবর্ষে কবিকে স্মরণ করতে গিয়েই কি তাঁর কবিতা পড়া হচ্ছে; আগে বুঝি পড়া হতো না! নিশ্চয়ই পড়া হতো বা হয়েছে। সকল কবির মতো গোটা জীবন কবিতা লেখেননি সমর সেন, লিখেছেন সাকুল্যে বারো বছর। তারপর ঘোষণা দিয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। এ মোটেই বাঙালীর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কবিতা হোক না হোক, ভাব ও চরণের পুনারাবৃত্তি যতোই চলুক, নতুন কিছু সৃজনের ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক- বাঙালী কবিরা কলম সচল রাখেন জীবনভর। এমনকি অকবিরাও কখনো লেখায় যতি টানেন না। সমস্ত জীবন কবিতার পেছনে ছুটেও তাঁরা বুঝতেই পারেন না বাংলা কবিতার ধারায় তাঁর পক্ষে একটি পঙ্ক্তিও সংযোজন করা সম্ভব হয়নি! এরকম একটি কবিমণ্ডলীভুক্ত সমাজে সমর সেন দারুণ ব্যতিক্রম। তিনি যখন লিখছিলেন তখন পাঠক, বলা ভালো কবিসমাজ তাকে সমীহ সাগ্রহে বরণ করে নেন।
জন্মশতবর্ষ যে কোনো কবির সৃষ্টি নিয়ে উৎসবের উপলক্ষ সামনে এনে উপস্থিত করে। সে-বিচারে সমর সেনের কবিতা আবার পড়া হবে। যারা তাঁর কবিতা পড়েছেন তাঁরাও নিশ্চয়ই আবার হাতে তুলে নেবেন তাঁর কাব্য, আর যাঁরা পড়েননি তাঁদের ভেতরেও কৌতূহল জেগে উঠবে। কবিতার পাঠক অনেক রকম, যেমন কবিতা অনেক রকম। বোদ্ধা পাঠক সমর সেনকে খুঁজে নেন তার অতৃপ্ত অমোচনীয় কবিতাতৃষ্ণা থেকে। আর সত্যিকারের কোনো কবির পক্ষে অসম্ভব সমর সেনের কবিতাকে উপেক্ষা করে যাওয়া। সমর সেনের চেয়ে কয়েক বছরের অনুজ কবি আবুল হোসেনকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক কবি। এই কবির প্রেরণা ও আদর্শ ছিলেন সমর সেন। কেন? তিনি জানাচ্ছেন: ‘আমি সমর সেনকে খুব পছন্দ করতাম। সমর সেনের কবিতা থেকেই আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি প্রকৃত গদ্য কবিতার পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথও গদ্য কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তা কাহিনিনির্ভর। সমর সেন সাম্যবাদী হলেও প্রকৃত রোমান্টিক গদ্য কবিতা লিখেছিলেন। আমি সমর সেনের কাছ থেকে এটুকু নিলাম যে- কবিতাকে গদ্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। আমিও চেয়েছিলাম কবিতার ভাষা মুখের ভাষার দিকে যাবে।’
কবিতার কলম যখন হাতে তুলে নেন সমর সেন সেই সময়টার দিকে ফিরে তাকানো যাক। কবিতাকাশে রবির বিপুল কিরণের বহুল বিস্তারের ভেতর পাঁচ সর্বাধুনিক কবির পদচ্ছাপ অঙ্কিত হয়ে গেছে। একটিমাত্র দশকে পাঁচ-পাঁচজন মহৎ আধুনিক কবির বিস্ময়কর আবির্ভাব ঘটেছে। জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে- এই পাঁচ কবি আবহমান বাংলা কবিতার ধারায় যুগান্তকারী বাঁকবদল ঘটান। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন মহাশক্তিমান। তাদের সম্মিলিত ব্যাপকগভীর প্রভাব পড়তে শুরু করে বাংলা কবিতাঙ্গনে। এই প্রভাব বলয় থেকে পৃথক হয়ে আধুনিক কবিতায় নতুন সুর আনা বিরল এক কবিপ্রতিভার পক্ষেই ছিল সম্ভবপর। সেসময় আঠেরো থেকে একুশ বছর বয়সের মধ্যে সমর সেন একমুঠো কবিতা লিখে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিলেন। ‘বাতাসে ফুলের গন্ধ,/ আর কিসের হাহাকার।’ কিংবা ‘হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,/ কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?’ অথবা ‘বিষাক্ত সাপের মতো আমার রক্তে/ তোমাকে পাবার বাসনা’- এজাতীয় পঙ্ক্তি আধুনিক কবিতায় এক ধরনের অভিনবত্ব নিয়ে আসে। তবে কবিতায় মিষ্টি ভাষাকে বিদায় করতে গিয়ে তিনি কিন্তু রোমান্টিকতাকে পুরোপুরি বিসর্জন দেননি। গদ্যেরও যে দোলা থাকে সেটা সমর সেনই প্রথম দেখালেন। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই কবি ওই পাঁচ ‘আদিম দেবতা’র চাইতে আলাদা এবং তাঁদের পরবর্তী কবিদের ভেতর বিশিষ্ট। হ্যাঁ, প্রকৃত আধুনিক গদ্য কবিতার পথিকৃৎ তাঁকেই বলতে হবে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সাম্রাজ্যে তাঁর কবিতা শোভন বিদ্রোহী। তাঁকে ছন্দছুট বলার কারণ নেই। তাঁর কবিতা থেকে ছেঁকে তোলা যাবে বটে অক্ষরবৃত্তের কিছু চরণাংশ, কিন্তু সেগুলো সর্বতোভাবে পয়ারে রচিত নয়। তাই বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি মাপা বিশুদ্ধ ছন্দের প্রতিষ্ঠিত প্রাঙ্গণে তাঁর গদ্যছন্দ এক ধরনের ছন্দোমুক্তি, যা বাংলা কবিতায় নতুন স্বাদ এনে দেয়। আধুনিক বাংলা কবিতায় এ কাজটির জন্য তাঁর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। অথচ আজও তাঁর যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি। সমর সেন ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর চাইতে আট বছরের ছোট। বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’-র কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেখিয়েছিলেন তিনি বুদ্ধদেবকে, তখন সমর আঠেরোর তোরণে দঁড়ানো। অনুবাদ পড়ে খুশি হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু এবং তরুণটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, তিনি কবিতা লেখেন কি না। কয়েক দিন পর নিজের কয়েকটি কবিতা তিনি দেখিয়েছিলেন বুদ্ধদেবকে। কবি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘নিয়মিত ছন্দের চেষ্টা ছেড়ে গদ্যছন্দে যেতে।’
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সমর সেনের পিতামহ দীনেশচন্দ্র সেনের ছিল গভীর হৃদ্যতা। বাবা অরুণচন্দ্র সেন ছিলেন আদি শান্তিনিকেতনের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ও পত্রালাপ ছিল। সমর সেনের আত্মজীবনী ‘বাবুবৃত্তান্ত’ অনেক অজানা ইতিহাসে পূর্ণ। সেখানে সমর সেন বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহাসমস্যার ব্যাপার।’ কারণ তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা তিরিশের দশকে ঘোরতর ভাবে তাঁর ভক্ত হচ্ছেন। এক দিকে ‘রাশিয়ার চিঠি’ ও পরে ‘সভ্যতার সঙ্কট’ বামপন্থীদের মধ্যে আলোড়ন তোলে। আধুনিকদের ‘শেষের কবিতা’ ও ‘চার অধ্যায়’ প্রবল ভাবে মাতায়। বাবুবৃত্তান্ত বইয়ে রবীন্দ্রবৃত্তান্ত পাঠকদের জন্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। লিখেছেন, ‘অনেকে হয়তো জানেন না যে তিরিশের দশকের শেষাশেষি রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার একটি সংকলন বের করেন (জোর গুজব সজনীকান্ত দাসের সহযোগিতায় ও পরামর্শে)। তিন জন ‘আধুনিক’ কবি বইটিতে স্থান পায়নি- বিষ্ণু দে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও আমি। শেষ পর্যন্ত সংকলনটির কী হয়? এ বিষয়ে বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ আলোকপাত করতে পারে। প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে অশোক মিত্র (পরে আইসিএস) একটি তীব্র তীক্ষè সমালোচনা করেন সংকলনটির; অন্য দু-একটি পত্রপত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য বেরোয়।’ যদিও সমর সেনের কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ছিল ইতিবাচক। ১৯৩৫-এ ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন, ‘সমর সেনের কবিতা কয়টিতে গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে তাঁর লেখা টেকসই হবে বলেই বোধ হচ্ছে।’ উল্লেখ্য ওই বছরই প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকা। তার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। আর সমর সেন ছিলেন তার সহকারী সম্পাদক।
সমর সেন ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কবিতা রচনা করেন। এই সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৩৭), ‘গ্রহণ’ (১৯৪০), ‘নানাকথা’ (১৯৪২), ‘খোলাচিঠি’(১৯৪৩) এবং ‘তিনপুরুষ’ (১৯৪৪)। পরে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘সমর সেনের কবিতা’। এই শেষোক্ত বইয়ে সংকলিত হয়েছে ঊনআশিটি কবিতা। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণ (১৯৬৯) আমার সংগ্রহে। আমরা যৌবনেই জেনেছিলাম সমরের যাদু সম্পর্কে। তাঁর জন্মশতবর্ষ স্মরণে বইটি আবার পড়তে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকত্তোর এই কবির মননে পাশ্চাত্যের সাহিত্য কতোটা তন্দ্রালস ছিল। আর সেইসঙ্গে রবীন্দ্রবাণীর চকিত উল্লেখ করে সম্পূর্ণ বিপরীত আবহে নিমজ্জন কতোখানি রসময় হতে পারে।  দান্তের ডিভাইন কমেডিতে যে-নরকচিত্র দেখি তার অনুরূপ নরকের দুঃস্বপ্নতাড়িত নাগরিক যেন চল্লিশের আধুনিক সংবেদনশীল কবিমানুষটি। দান্তের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু ‘রোমন্থন’ কবিতায় ব্যক্তিত্বস্পৃষ্ট উচ্চারণ আমাদের বিমূঢ় করে দেয়:
বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ,
তবু নিজেকে কতদিনের জীর্ণ বৃদ্ধ লাগে,
জিভে স্বাদ নেই, জানি না
কী পাপে সুস্থ শরীর ঘুণের আশ্রয়।
টি এস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড (পোড়ো জমি) সমর সেনের মানসে অভিঘাত তুলেছে নিশ্চয়ই। তাঁর ‘পোড়ো মাটি’ কবিতায় আমরা প্রত্যক্ষ করব বিষাদগ্রস্ত বৃন্তচ্যুত বিচ্ছিন্ন মানবসত্তাকে। আর ফসলহীন শকুনের মাঠে প্রাণ দেয়া অসংখ্য সহোদর ডাকছে সেই মানবসত্তাকে। কবিতাটি আরেকটি কারণে উল্লেখযোগ্য, সেটি হলো এটি সমিল গদ্য ছন্দে লেখা। শেষের দিকে সমর সেনের কাছ থেকে আমরা পাই সাম্যবাদী বক্তব্য। ‘আমি রোমান্টিক কবি নই, আমি মার্ক্সিস্ট’- এমন ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন। লেলিনের বাণী, জোসেফ স্টালিনের উল্লেখ তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়। সাম্যবাদী ঘরানার প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা ‘লোকের হাটে’। বর্ষা নিয়ে বাঙালির ভাবালুতা সুবিখ্যাত। কবিতাটি শুরুই হয়েছে ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ ব’লে, রবীন্দ্রনাথের গানের কথাই যেন মনে পড়িয়ে দিতে। আসলে চকিতে সেই মোহভঙ্গ ঘটিয়ে পাঠকের সামনে সম্পূর্ণ বিপরীত, অ-রোমান্টিক পরিস্থিতি উপস্থাপনই কবির আরাধ্য। দুলাইন তুলে দিলে বোঝা যাবে: ‘আবার এসেছে আষাঢ়; জলস্রোতে ঘোলাটে হলুদ রঙ./ রাশি রাশি আবর্জনা’। নিজেকে চেনাচ্ছেন যেন তিনি এমন উচ্চারণের ভেতর দিয়ে:
আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত, কূপের মণ্ডুক,
ছাপোষা মানুষ,
দিনের বিস্বাদ মুখে রাত্রি বাড়ি ফিরি।
সমর সেন যে সময়টায় (১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল) কবিতাচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন সে সময়ে তাঁর স্বদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। এরপর অবিভক্ত বাংলা পঞ্চাশের (১৯৪৩) মন্বন্তরের শিকার হয়। ছেচল্লিশে কবির শহর কলকাতায় সংঘটিত হয় স্মরণকালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সংগত কারণেই কবির তরুণ মানসে এসবের অভিঘাত পড়েছিল। কিন্তু শিল্পের শর্তের কথা তিনি বিস্মৃত হননি। ঊষর মহানগরে সাহিত্যসম্পৃক্ত তরুণ-যুবার মনোজগতে প্রেম, মানবিক প্রয়োজন ও বিবিধ বিষয়ের ভিন্নধর্মী উৎসারণ ঘটিয়ে চলে। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনটে উদাহরণ হাজির করছি।
ক.    উচ্ছিষ্ট নিয়ে ভিখিরী কুকুরে ঝগড়া ( বিরতি)
খ.    দুর্দিন রপ্তানী কিছুদিন বন্ধ কর
    এদেশে, হে দেব! ক্ষান্ত কর দাক্ষিণ্য দারুণ
    বিপুলা পৃথিবী! অন্য দেশে লেগেছে আগুন,
    কালসিটে কালো মেঘ, সূর্যাস্তের রঙ যেন মানুষের খুন! (২২শে জুন)
গ.    মৃত্যু হয়তো মিতালি আনে:
ভবলীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান-
বিহারের হিন্দু আর নোয়াখালির মুসলমান
নোয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান (জন্মদিনে)
শহীদ কাদরী এক সাক্ষাৎকারে সমর সেন সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা এড়াতে পারি না। তিনি বলছেন, ‘তাঁর কবিতায় পুঁজিবাদী সমাজের উন্মত্ততা (এলিয়েনেশন) আছে। অনেক সময় হয় কি একজন লেখক নতুন একটা ফর্ম আবিষ্কার করেন। এবং তিনি সেই আঙ্গিকে বন্দী হয়ে পড়েন (হি বিকামস প্রিজনার অব দ্যাট ফর্ম)। তিনি যখন তাঁর আবিষ্কৃত আঙ্গিকের বাইরে আর যেতে পারলেন না। তখন তিনি বুঝেছেন আর পুনরাবৃত্তির কোন মানে হয় না। তার যে বক্তব্য ছিল তাও তিনি ক্লান্তি নিয়ে (এক্সহস্টেডলি) বলেছেন। এরপর তাঁর নতুন কোন বক্তব্য জন্মায়নি। নতুন কোন দৃষ্টিভঙ্গি জন্মায়নি, এমন কি ভাষাও বদলায়নি। তাই তিনি আর নিজেকে পুনরাবৃত্তি (রিপিট) করেননি।’
ব্যঙ্গ, আত্মসমালোচনা, স্বশ্রেণীর প্রতি বিদ্রƒপ ইত্যাদি কারণেও সমর সেন বিশিষ্টতায় ভাস্বর। তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গই হয়ে উঠেছে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রজ্ঞা ও কল্পনাশক্তির মেলবন্ধন। আবেগকে তিনি সংহত সংযত রেখেছেন, সেখানে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। হৃদয়-মননের, জ্ঞান ও কল্পনার সমন্বয়ে কবিতায় তিনি যে সুর ও ভঙ্গি গড়েছেন, তাতে তাঁর স্বাতন্ত্র্য সুনির্দিষ্ট অবয়ব লাভ করেছে। এখানেই তাঁর গুরুত্ব। মহাকাল কীভাবে বিস্মৃত হতে পারে যে বাংলা কবিতায় তাঁর মৌলিক অবদান যুক্ত হয়েছে রহস্যময় বাºেবীর অমোঘ ইশারায়! জন্মশতবর্ষে এই ব্যতিক্রমী বাঙালি কবিকে আমাদের শ্রদ্ধা।
[email protected]