করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





ঢাকার দিনরাত
মারুফ রায়হান
কী আশ্চর্যভাবেই না বদলে গেল ঢাকা! এর আগে কোনো রোজার মাসে, ঈদের আগে এমন হতাশায় মোড়ানো হতশ্রী ঢাকা কি আমরা দেখেছি? এই সময়টায় দেশে ঈদ করতে যাওয়া মানুষের মনে কতই না আনন্দ থাকে, থাকে শিহরণ। বাড়ি ফেরার বাসের একটা টিকিটের জন্যে চলে কতোই না পরিশ্রম, থাকে মধুর উৎকণ্ঠা। চানরাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। ভিড়বাট্টায় পথ চলাই হয়ে ওঠে কঠিন। ঘরে ঘরে চলে ইফতার তৈরির রকমারি আয়োজন, প্রিয়জনদের মাঝে ইফতার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পরিতৃপ্তি আস্বাদনের প্রয়াস! কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব সুন্দর ছবি, জীবনের ছবি। এখন জীবন বাঁচাতে মানুষের প্রতিদিনের শঙ্কা। নিভৃতে গোপনে অর্থকষ্টে কতো কর্মহীন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অতিক্রমণ; একেকটি রাত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাত পাড়ি দেয়া! তবু আশা নিয়েই বাঁচে মানুষ। এই যে কয়েকটা দিন নিদারুণ গরমে কষ্ট পাচ্ছে ঢাকার লাখ লাখ মানুষ। অসহ্য গরমে সব যেন পুড়ে যাবে, এমন একটা পরিস্থিতি, তারপরও কোথায় যেন স্বস্তির ইশারা। এই কষ্টকর আবহাওয়াই হয়তো বাঁচিয়ে দিচ্ছে ঢাকাবাসীদের; আরো দূর দৃষ্টি প্রসারিত করলে বলা যেতে পারে যে, সারা দেশের মানুষই রেহাই পেতে চলেছে করোনা নামক অশরীরী মৃত্যুদানবের মহাতা-ব থেকে। চোখের সামনেই তো দৃষ্টান্ত রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার। কীরকম নাকাল হলো তারা করোনার থাবায়। আমরা সে-বিচারে কি অনেক ভালো নেই! এই লেখা যারা পড়ছেন, সেইসব পাঠকের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই, দুস্থ অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, তাদের অর্থসহায়তা দিন। কবিতার কথাই মনে এলোÑ রোদন ভরা এ বসন্ত, সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে। এমন কান্নামেশানো ঈদ বুঝি কখনো আসেনি এই সতত সংগ্রামী দেশটিতে।

ড. আনিসুজ্জামান: সকরুণ প্রস্থান
মানবমৃত্যু মাত্রই সকরুণ বেদনার, আর প্রিয়জনের মৃত্যু, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীর মৃত্যু আমাদের একেবারে যেন নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন এমন আকস্মিকভাবে! বিশ্বমহামরীর এক সকরুণ সময়পর্বে। ঢাকা শহরে এমন একজন স্নিগ্ধ প্রাজ্ঞ শিক্ষকের সান্নিধ্য আর আমরা পাবো না, একথা ভাবতেই বুক ভেঙে যায়। তাঁর সঙ্গে আমাদের কতো কতো স্মৃতি! এমন স্নেহ খুব কম ব্যক্তিত্বের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমাদের শোকের পাথর বুকে চাপা দিয়ে সংবাদপত্রের জন্যে লিখতে বসতে হয়। জনকণ্ঠে তাঁকে নিয়ে সম্পাদকীয়  লিখতে বসে বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠছিলাম। একটি প্রাইভেট চ্যানেল কর্তৃপক্ষ চাইলো স্যারের শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠান আমি সঞ্চালনা করি দ্রুততম সময়ের ভেতর। নিজেকে প্রস্তুত করে উঠতে পারি না। কতো আয়োজনে কতো প্রয়োজনে, কী অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া আড্ডায়, কী আনুষ্ঠানিক মঞ্চে, কতোভাবেই না তিনি আমাকে, আমাদের সমৃদ্ধ করে গেছেন।  বিদায়কালে তিনি করোনাক্রান্ত ছিলেন এমন তথ্য আমাদের বিমূঢ় করে দেয়। আমাদের বন্ধু চিত্রশিল্পী রফি হক যা লিখেছেন তা কি আমাদের বহুজনেরই মনের কথা নয়? লেখার অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি: ‘টেলিভিশনে আনিসুজ্জামান স্যারের শেষ বিদায়ের ছবি দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। তারপর থেকে মূলত, মনটা ভারি হয়ে আছে। তাঁর শেষ যাত্রাটি এমন নিঃসঙ্গ হবে, তা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। বন্ধু, স্বজন, সহকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, দল মত ভুলে রাজনৈতিককর্মী, তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, বাংলা একাডেমী, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ মুখরিত হবে নাÑ এ ছিল অবিশ্বাস্য। অপ্রতিরোধ্য কারোনা সব উলোট-পালোট করলো তো, করেই দিল ! আনিস স্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুটিও ছিল অকস্মাৎ, নাটকীয় ও রাজসিক । মৃত্যুরও বোধ হয় ভাল সময় মন্দ সময় আছে !’

বরেণ্য সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান
তিনিও বিদায় নিলেন। এক শোক সামাল না দিতে পারার বাস্তবতায় আরেক কষ্টের আঘাত। জনকণ্ঠের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেই সংখ্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কর্তব্যপালন করতে গিয়ে গ্রীনরোডে সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের বাসায় গিয়েছিলাম। তাঁর কাছের মানুষ কবি সুলতানা শাহরিয়া পিউ নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। তাঁর সঙ্গে সেই আমার প্রথম সামনাসামনি আলাপ। সেই স্মৃতি সত্যিই আনন্দের। কাছে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর প্রায়ই ফোন করতেন। অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলতে চাইতেন। আমরা যারা সংবাদপত্রের মানুষ, তাদের সামাজিকতার সময় সত্যিই কম। কর্মসূত্রে কতশত ব্যক্তির সঙ্গে, গ্রেট সব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। মিথ্যে বলবো না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আজাদ রহমানের সঙ্গে আলাপচারিতা সংক্ষিপ্তই রাখতে হয়েছে। দ্বিতীয়বার আর তাঁর বাসায় যাওয়ার সময় করে উঠতে পারিনি। তাই মর্মপীড়া থেকে মুক্তি মিলছে না। আমাদের হাতে তিনি যে লেখা তুলে দিয়েছিলেন সে সময়, তার কিছুটা অংশ পাঠকসমীপে নিবেদন করছি। এটুকু পড়লেই বোঝা যাবে এই বড় মাপের সংগীত ব্যক্তিত্বের নিষ্ঠা ও সাধনার আন্তরচিত্র।
আজাদ রহমান লিখেছেন: ‘বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা খেয়াল, লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বাংলা টপ্পা, বাংলা ঠুমরী, বাংলা গজল, বাংলা দাদরা, বাংলা কাজরি এবং বাংলা রাগাশ্রিত গান শেখানো হচ্ছে এবং প্রচারে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সঙ্গীত অনুরাগী ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গীতের বিষয় শেখা-জানা-বোঝার লক্ষ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ও সঙ্গীতের যথার্থ সমঝদার সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সুকণ্ঠের অধিকারী, সঙ্গীত শিক্ষার্থী, নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের ধ্রুপদ, খেয়াল প্রভৃতি গান শিখিয়ে তা রপ্ত করার জন্য আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সবধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অনুরাগী নানান বয়সী শিল্পীদের বাংলা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ব করার জন্য যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করানো হচ্ছে। আমি বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, বাংলা খেয়াল, বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীত- বাংলা টপ্পা, বাংলা ঠুমরী প্রভৃতি গান সৃজন করি একটি প্রক্রিয়ায়। কোন কোন গান বহু বছর লেগে যায় পরিপূর্ণ রূপ পেতে। বহু বছর আগে হয়ত একটি গান করেছি তা আমি গেয়েছি আমার পরিবারের সদস্য কিংবা ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছি এবং নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রেখেছি পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজনের মাধ্যমে তা যখন মনে হয়েছে যথার্থ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের রূপ লাভ করেছে। তখনই শিল্পীদের দিয়ে তা পরিবেশন করানোর ব্যবস্থা নিয়েছি।’


করোনাজয়ী চিকিৎসক
গত সপ্তাহের লেখায় করোনাজয়ী করোনাযোদ্ধা পুলিশের কথা লিখেছি। এবার চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।  ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীসহ ৪০ জন সুস্থ হয়ে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন, এমন সংবাদে আনন্দে ও গৌরববোধে চোখ ভিজে ওঠে। এই সাহসী করোনাযোদ্ধাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। তারা সেফটি পোশাক (পিপিই) পরে হাসপাতালের ভেতরে ঢোকেন। সে সময়, হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক ও কর্মীরা হাততালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানান। সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেওয়া চিকিৎসকেরা বলেছেন, করোনা জয় করে এসে আবারও রোগীদের সেবা করতে পারা তাদের জন্য আনন্দের বিষয়।
পাশাপাশি আরেকটি মন ভালো করে দেয়া খবর ঢাকা মেডিকেলে প্লাজমা দিয়েছেন করোনাজয়ী দুই চিকিৎসক। হাসপাতালটির ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ করোনাজয়ী দুই চিকিৎসকের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করেছে। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এক সপ্তাহের মধ্যে সংগ্রহ করা প্লাজমা রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হবে। করোনাজয়ী  প্লাজমা দেওয়া চিকিৎসকেরা হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক দিলদার হোসেন বাদল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক পিয়াস। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ৪৫ জন রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হবে। আইসিইউতে যাওয়ার আগে রোগীর প্লাজমা থেরাপি দিলে ভালো ফল পাওয়ার প্রমাণ রয়েছে।

ভার্চুয়াল আদালত
আমরা কি ভেবেছিলাম এমন বিস্ময়কর আদালতের অভিজ্ঞতা হবে আমাদের? সাধারণ ছুটি চললেও অপরাধ কিন্তু থেমে নেই। তাই ভুক্তভোগীরা যেন প্রতিকার পান, সেই সুযোগটি সবসময়ের জন্য উন্মুক্ত রাখা দরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু সময়ের দাবি। করোনার মতো পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের মৌলিক মানবাধিকার ও মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এমন একটি পথ চালু রাখার কোনো বিকল্প নেই। সশরীরে আদালতে উপস্থিত না হয়ে যার যার জায়গা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার পরিচালনা করাই হচ্ছে ভার্চুয়াল কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ১১ মে থেকে আইনজীবীরা ই-মেইলের মাধ্যমে অধস্তন আদালতগুলোতে জামিনের দরখাস্ত দাখিল করছেন। আটটি বিভাগের জেলা ও দায়রা জজ, চীফ জুডিসিয়াল ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কয়েক দিনে হাজার হাজার জামিনের আবেদন দাখিল করেছেন আইনজীবীরা। দাখিলকৃত আবেদনের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরির মামলাসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে। এসব আবেদনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আবেদন মঞ্জুর করেছেন বিচারকরা। জামিনপ্রাপ্তদের অধিকাংশই কারামুক্তি পেয়েছেন। যারা পাননি তাদের মুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। করোনাকালে এ এক ইতিবাচক ঘটনা।

ঈদের পর ঢাকার রাস্তাঘাট অফিস আদালতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো, কিন্তু মানুষের শঙ্কা আর ঝুঁকি কি একবিন্দু পরিমাণও কমলো? রোববার থেকে অফিস আদালত খুলে যাওয়ার পর ঢাকা করোনাপূর্ব ব্যস্ত নগরীর চেনা চেহারায় ফিরবে এমনটি জানা কথাই। অর্থনীতির সঙ্গে মানুষের প্রতিদিনের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন সরাসরি যুক্ত। ব্যয় আছে, আয় নেই। এ অবস্থা কতোদিন চলতে পারে? তাই ৬৬ দিনের ছুটিশেষে আবার নিয়মিত অফিস শুরু। তবে আমরা গণমাধ্যমের কর্মীরা সহ জরুরি সেবার আওতাধীন হাজার হাজার মানুষের কোনো ছুটি ছিল না। আমরা কাজেই ছিলাম। সে যাক, ঢাকা চেনা চেহারায় ফিরছে বটে কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি কি কমবে?

বাসে উঠলে বাড়তি সতর্কতা

যারা কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য বাসে চড়তে বাধ্য তাদের ওপর ব্যয়ের নতুন বোঝা চেপেছে। বাসভাড়া বেড়েছে।  এই বাড়তি টাকার যোগানো স্বল্পবিত্তের মানুষের জন্যে অনেক কষ্টের। ঢাকার লাখ লাখ মানুষ এই দলেই। একদিকে বাড়তি ব্যয়, আরেকদিকে উচ্চ ঝুঁকি। গণপরিবহনের যাত্রীরা পড়েছেন উভয় সংকটে। করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির তালিকা করতে গেলে প্রথমদিকেই আসবে গণপরিবহনের বিষয়টি। এখন দেশে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এমনটাই অনুমিত হওয়া স্বাভাবিক যে ভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করছে দেশ। এই সময়পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নিজের সুরক্ষা বজায়ে করণীয় কড়াকড়িভাবে পালনের আবশ্যকতা রয়েছে। এখানে বিন্দুমাত্র শিথিলতা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। গণপরিবহন বাস-মিনিবাসে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক যাত্রী বহন করা হবে স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার স্বার্থে। তার মানে হলো একজন যাত্রীকে অপর যাত্রীর গা ঘেঁষাঘেষি করে বসতে হবে না। দুই আসনের স্থলে একজন এবং তিন আসনের জায়গায় দুজনকে বসানো হলে পাশাপাশি হয়তো তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু ঠিক পেছনের সিটে যে যাত্রী বসবেন তার কি এই অত্যাবশ্যকীয় দূরত্ব বজায় থাকছে? বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এতে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তার ওপর মাস্ক পরিধানও বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। কোনো যাত্রী যদি তা পরিধান না করেন তাহলে তাকে কি গণপরিবহনে উঠতে বাধা দেয়া হবে? সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি সম্ভব কিনা। বাসের হ্যান্ডেল, রড এবং সিটের উর্ধভাগ হাতের স্পর্শ লাগবেই। তাই সার্বক্ষণিকভাবেই হাত জীবাণুমুক্ত করার তাগিদ থাকবে।

করুণ অসহায়ত্ব

আমাদের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই সত্তরোর্ধ মুরুব্বি রয়েছেন। বাড়ির বৃদ্ধ বাবা কিংবা মা যদি করোনাক্রান্ত হয়ে পড়েন, এবং তার বিশেষ চিকিৎসার জরুরি হয়ে ওঠে তাহলে রোগীর স্বজনেরা কতোটা অসহায় পরিস্থিতির শিকার হন তারই একটি বিবরণ পাওয়া যাবে নিচের লেখা থেকে। দুই ভাইই কবি, একজন বারডেম হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অপরজন একটি প্রধান দৈনিকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। সমাজে উভয়েরই রয়েছে নানামুখি সংযোগ। তাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন আকস্মিকভাবে। শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন ভুগে মা মারা যান। বড় ভাইয়ের এ লেখা পড়ে আমরা বুঝতে পারি আমাদের এই মহানগরীর হাসপাতালের বাস্তব চিত্র।
কবি ফরিদ কবির লিখেছেন: ‘শুক্রবার (ঈদের আগে) বিকেলে হঠাৎ করেই আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন! তিনি ছিলেন কেরানীগঞ্জে আমার নানাবাড়িতে। সেখান থেকে আমার আত্মীয়রা জানালেন, সারাদিন কয়েকবার লুজ মোশন হওয়ায় তিনি আর একেবারেই নড়তে পারছেন না। শরীরে একটু জ্বরও আছে! কেরানীগঞ্জে আম্মা যেখানে ছিলেন, সেখানে কারোরই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি এখনো। আমারও ধারণা, একেবারেই সাধারণ ডায়ারিয়া! সঙ্গে হালকা জ্বর। যদিও এ দুটোই করোনার লক্ষণ। এমন লক্ষণ থাকলে বারডেমে রোগী ভর্তি করা যাবে না, এটা জানাই ছিলো। খবর পেয়েই আমি আর সাজ্জাদ অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিলাম। কিন্তু কোথাও কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছিলো না।...
আম্মাকে পরে আমরা বারডেমে নিয়ে এলাম। বারডেমে নানা পরীক্ষা শুরু হলো। সেখানে অবশ্য তার শরীরে কোনো টেম্পারেচার পাওয়া গেলো না। কিন্তু এক্সরেতে বুকে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা গেলো। আম্মার কিছুটা শ্বাসকষ্টও হচ্ছিলো। ইমার্জেন্সি ডাক্তার বললেন, রোগীর অবস্থা খারাপ। তার আইসিইউ'র সাপোর্ট লাগবে। আপনি রিপোর্টগুলো নিয়ে একটু আইসিইউতে যান। সেখানকার ডাক্তাররা রিপোর্টগুলো নিয়ে প্রায় একঘন্টা বসে রইলেন। ঘন্টাখানেক পর তারা জানালেন, রোগী সাসপেক্টেড কোভিড। কাজেই তাকে আইসিইউতে নেয়া সম্ভব না। তার শরীরে যদি করোনা থাকে তাহলে আইসিইউর বাকি রোগীদের জীবন বিপন্ন হবে।
আমি সাততলা থেকে নিচে নেমে আবারও ইমার্জেন্সিতে ফিরলাম। ডাক্তার জানতে চাইলেন, আইসিইউর ডাক্তাররা কী বললেন? আমি তাদের বক্তব্য জানালে ইমার্জেন্সি ডাক্তার বললেন, রোগীর তো করোনা আছে। আমরা তাকে ভর্তি দিতে পারবো না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বারডেমের যুগ্ম পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. নাজিমকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ফরিদ ভাই, আমি আইএমওর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে একটু পরেই জানাচ্ছি।
তিনি মিনিট পাঁচেক পর ফোন করে জানালেন, করোনা সাসপেক্টেড হলে তিনি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করতে পারবেন না। তিনি বিনয়ের সঙ্গেই জানালেন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন, খালাম্মার যদি করোনা থাকে তাহলে অন্য রোগীরাও বিপদে পড়বেন!
আমি বললাম, দেখেন, আমার ধারণা, আম্মার করোনা হয়নি। করোনা হওয়ার সম্ভাবনা তার নেই বললেই চলে। আপনি তাকে এখানেই ভর্তির একটা ব্যবস্থা করেন। নাকি আমি আজাদ স্যারকে বলবো?
তিনি বললেন, আমাকে একটু সময় দেন, আমি জানাচ্ছি।
আমি বললাম, বেশ, তাড়াতাড়ি আমাকে জানান।
মিনিট দশেক পর তিনি জানালেন, ফরিদ ভাই, একটা ব্যবস্থা করেছি। নয় তলায় ৯০১ নম্বর কেবিনে দিতে বলেছি। দেখা যাক কী হয়!
ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হতে হতেই রাত ১১ টা বেজে গেলো। ফিরেই আমি আইসোলেশনে চলে গেলাম। মানে, গেস্টরুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। গোসল সেরে বেরোতেই বারডেম থেকে ফোন। ডিউটি ডাক্তার বললেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে ইমেডিয়েট আইসিইউতে নেয়া দরকার। কিন্তু আইসিইউতে সিট থাকলেও ডাক্তাররা তাকে নিতে চাইছেন না। অন্য কোথাও জলদি শিফট করেন।
রাত তখন প্রায় বারোটা। অতো রাতে আইসিইউ কই পাবো? বললাম, আজকের রাতটা থাকুক। কাল সকালে দেখি, কোথাও আইসিইউ পাওয়া যায় কি না।
ডাক্তার বললেন, দেখুন, এখানে রাখা কিন্তু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ঘটলে তার দায় কিন্তু আমরা নিতে পারবো না। আমরা রোগীর ফাইলে লিখে দিয়েছি, অবিলম্বে রোগীকে আইসিইউতে নেয়ার জন্য।
সাজ্জাদকে ফোন দিয়ে বললাম, কী করবো এখন?
না। আমাদের আসলে করার কিছুই নেই। কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউতে কোনো সিট নেই। নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর বেড খালি থাকলেও সেখানে কোভিড সাসপেক্টেড রোগীকে কেউ ভর্তি নিচ্ছে না! সবচাইতে বড় কথা, কোনো কোভিড হাসপাতালেই আইসিইউতে কোনো বেড খালি নেই।
খুবই অসহায় লাগছিলো।
সমাজের বিভিন্ন স্তরে আমাদের দু'ভাইয়ের কানেকশন খুব একটা মন্দ না! তারপরেও আমরা অসহায়। সাধারণ মানুষেরা সেখানে এসময়ে কতোটা চিকিৎসা পাচ্ছে, সেটা অনুমান করা যায় সহজেই।
শনিবার সকাল থেকে নানামুখি চেষ্টা শুরু হলো। বহু চেষ্টার পর রাত নটার দিকে আম্মাকে অবশেষে গ্রিনলাইফ হাসপাতালের আইসিইউতে শিফট করা সম্ভব হলো।’...

যারা করোনা রোগী নন

বৈশ্বিক মহামারীকালে সংশিষ্ট রোগটিই হয়ে ওঠে সব কিছু ছাপিয়ে প্রধান ফোকাসবিন্দু। তাতে চাপা পড়ে যায় আর সব রোগের ভুক্তভোগীরা। এটা খুব যে অস্বাভাবিক, তাও নয়। এখন নতুন রোগ কোভিড-১৯ নিয়েই যত আলোচনা ও আলোকপাত। কয়েক মাস আগেও এ রোগটির অস্তিত্ব ছিল না। অল্প কিছু সংক্রামক রোগের বাইরে মূলত কয়েকটি প্রধান অসংক্রামক রোগÑ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপই ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিশেষ মনোযোগের কেন্দ্র। এ কয়টি রোগে ভুগে থাকেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বের এক নম্বর হন্তারক রোগ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে হৃদরোগকে। প্রতি বছর পৌনে দ্ইু কোটি মানুষ মারা যাচ্ছেন এই রোগে। অন্যদিকে ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এইডস এবং যক্ষাÑ এই তিনটি রোগ মিলে প্রতি বছর গোটা বিশ্বে মারা যাচ্ছেন ৩৮ লাখ মানুষ। অথচ এ তিনটি রোগকেই ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে হৃদরোগের ভয়াবহতার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা অনুপস্থিত। যাহোক, দেশে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যাও প্রায় এক কোটি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এখন বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ রোগটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর বাইরেও যে লাখ লাখ রোগী রয়েছেন, যারা দীর্ঘকাল যাবত নানা অসুখে ভুগছেন, তাদের চিকিৎসা সেবা যেন গৌণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দের অনেকেই ব্যক্তিগত চেম্বারে বসছেন না দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই। তারা হাসপাতালের ডিউটিতেও আসছেন না। প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনার শিকারও হচ্ছে মানুষ। তাদের জরুরি চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন হচ্ছে। অথচ বেশির ভাগ মানুষই তাৎক্ষণিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না। কিডনি রোগীদের দুরবস্থা অবর্ণনীয়। লাখ লাখ সন্তানসম্ভবার স্বাস্থ্যের যতœ কি ঠিকঠাক নেয়া সম্ভব হচ্ছে? নতুন সংক্রামক ব্যাধি এসে অন্য সব ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে বরং কিছুটা বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দিয়েছে। এজন্যে জরুরি হয়ে উঠেছে সঠিক মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনা।

৩১ মে ২০২০
[email protected]