আমি কোমালায় এসেছি;
কারণ তারা বলেছে আমার বাবা এখানে থাকে।
পেদ্রো পারামো—আমার বাবার নাম পেদ্রো পারামো।
আমি কোমালায় এসেছি কারণ আমি মাকে কথা দিয়েছিলাম।
মা বলেছিল বাবার সাথে দেখা করতে—
মা তখন মৃত্যুপথযাত্রী, আমি মার মৃত্যুকে সহজ করতে চেয়েছিলাম, তার হাত চেপে আশ্বস্ত করেছিলাম, আমি বাবার সাথে দেখা করব।
বলেছিল, "তার সাথে দেখা করতে ভুলো না। এটাই তার নাম, যদিও তারা তাকে অন্য নামেও ডাকে। আমি জানি সে তোমাকে দেখতে, তোমাকে জানতে উদগ্রীব।“
মৃত্যুশয্যায় মাকে কথা দেয়া ছাড়া কিইবা করার ছিল আমার!
বারবার একই কথা বলতে বলতে আমিও আবেগপ্রবণ ছিলাম, মৃত্যুর পর তাঁর হিমশীতল ঠাণ্ডা হাত ছাড়িয়ে নিলেও, মোহগ্রস্ত মন্ত্রের মতো আউড়াচ্ছিলাম —আমি আসব!
মা আরো বলেছিল: "তার কাছে কিছু চাইতে যেও না।
শুধু দাবি কোরো আমাদের প্রাপ্য—যা থেকে সে আমাদের বঞ্চিত করেছে....
তাকে সেই ঋণ শোধ করতে ব’লো বিনয়ের সাথে, তাকে বাধ্য ক’রো, ঠিক একইভাবে
যেভাবে সে আমাদের অবহেলা করেছে। “
আমি মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, বলেছিলাম,"আমি তাই করব।"
অথচ প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো উদ্যোগ আমার ছিল না।
ধীরে ধীরে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি;
স্বপ্নের পাখা মেলে প্রবেশ করি এক মায়াবী জগতে—
যে জগতে পেদ্রো পারামো নামের লোকটি আমার মায়ের স্বামী।
তাই আমি কোমালায় এসেছি।
তখন গ্রীষ্মের দাবদাহ, গরম বাতাসে সাপোনারিয়ার বিষাক্ত পচা গন্ধ।
আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তা — কোনোটা উপরে, কোনোটা নিচে।
লোকটি বলেছিল, “রাস্তা উপরে উঠছে না নামছে তা নির্ভর করে পথচারির উপর, নির্ভর করে সে যাচ্ছে না আসছে তার উপর, যে যায় তার জন্য উর্ধমুখী, যে আসে তার জন্য নিম্নমুখী। “
: ঐ যে নিচে শহরটা দেখা যায়, তার নাম কি?
: ঐটা কোমালা, সেনর।
:আপনি কি নিশ্চিত যে ওটা কোমালা?
:হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।
: তবে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?
: সময়টাই যে বিষণ্ন তার, মহাশয়।
আমি কোমালাকে দেখেছিলাম আমার মায়ের চোখে,
মায়ের স্মৃতিতে, তার স্মৃতিকাতরতা আর ফিরে আসার আকুতিতে।
মার অপরিসীম অপেক্ষা ছিল কোমালার জন্য,
সে কোমালায় ফিরে আসতে চেয়েছিল; কিন্তু পারেনি, তার বদলে আমি এসেছি।
আমি সেই চোখ নিয়ে এসেছি যে চোখে এক কিশোরী কখনো কোমালাকে দেখেছিল,
আমার এ দৃষ্টি তাঁরই দান:
"সেখানে, লসকলি মোটস বন্দর পেরুলেই
পাকা ভুট্টার হলুদ রঙে রাঙানো সবুজ সমভূমির সুন্দরতম দৃশ্য!
সেখান থেকে তুমি দেখতে পাবে—
পৃথিবী উজ্জ্বল করে, রাতকে আলোকিত করে দাঁড়িয়ে আছে কোমলা!"
তার কণ্ঠস্বর ছিল আবেগরুদ্ধ,বশীভূত,
যেন ফিসফিস করে ভেসে আসা কোন গোপন কথা,
এতটাই অস্পষ্ট যেন নিজের সাথেই নিজেই কথা বলছে...
আমার মা!
: "আমি কি জানতে পারি আপনি কেন কোমলা যাচ্ছেন?" লোকটির প্রশ্ন।
:"আমি আমার বাবার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি," আমার উত্তর।
: "ওহ্!” সে বলল। তারপর আবার চুপ।
আমরা পাহাড় বেয়ে নিচে নামছিলাম, বোঝা টানা খচ্চরগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছিল, চৈত্রের তাল ফাটা রোদ্দুরে তাদের চোখ-ভর্তি ঘুম।
: "আপনাকে ঘিরে অনেক বড় উৎসব হবে" পাশ থেকে বলল লোকটা, " এখানে কেউ আসে না, এত বছর পর কেউ এল!" তারপর বলল, "আপনি যেই হোন না কেন, আপনাকে পেয়ে ওরা পেয়ে দারুণ খুশি হবে।"
সূর্যের প্রতিফলনে, সমভূমিটি যেন এক স্বচ্ছ উপহ্রদ,
টুকরো টুকরো বাষ্পে ভেঙে, ধূসর দিগন্তে জ্বলে উঠেছিল।
দিগন্তের ওপারে পাহাড়ের সীমানা।
আরও দূরে, দূরতম দূরত্ব, শূন্যতা ...
: "আমি কি আপনার বাবার পরিচয় জানতে পারি?"
: "আমি তাকে দেখিনি," বললাম, “শুধু জানি তার নাম পেদ্রো পারামো। “
: “আচ্ছা! ভাল...”
: “হ্যাঁ, তারা আমাকে তাই বলেছে, এটিই তার নাম। “
খচ্চর তাড়াতে তাড়াতে সে আবার বলল, “হুম! ভাল...”
লস এনকুয়েন্ট্রোসের চৌরাস্তার মোড়ে তার সাথে আমার দেখা। আমি অস্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে, সে হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাজির।
: আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাকে।
:আমি নিচে যাচ্ছি, জনাব।
:কোমালা বলে একটা জায়গা আছে, আপনি চিনেন?
: আমি সেখানেই যাচ্ছি।
কোমালায় যাচ্ছে শুনেই আমি তাকে অনুসরণ করতে শুরুকরি । তার ক্ষিপ্র গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পিছনে পিছনে তাকে ধরার চেষ্টা করি, বুঝতে পেরে সে ততক্ষনে তার দৌড়ের তাড়া কমিয়ে আমার জন্য দাঁড়ায়— কাছাকাছি, প্রায় আমার কাঁধ স্পর্শ করে।
: "আমিও পেদ্রো পারামোর সন্তান," সে বলেছিল।
শূন্য আকাশে তখন আমাদের মাথার উপর একঝাঁক উড়ন্ত কাক, কা... কা…কা…।
পাহাড় পেরিয়ে আমরা আরও নিচে নামলাম। উপরের গরম বাতাসকে পেছনে ফেলে আরো বিশুদ্ধ তাপে ডুবে, গভীর থেকে গভীরতর খাদে, আরো নিচে। অপেক্ষার বাঁধ যেনো আর ভাঙছিল না …
: “এখানে প্রচন্ড গরম”, আমি বলেছিলাম।
: “হাহা! এতো কিছুই না”, সে বলেছিল।“ অপেক্ষা করুন, কোমলায় গেলে বুঝতে পারবেন গরম কাকে বলে! পৃথিবীর জ্বলন্ত কয়লার উপর সে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক নরকের মুখে। আমি নিশ্চিত সেখানে যারা একবার মরতে যায়, জাহান্নামে ফিরেও তারা শীতেরকম্বল চাইবে!”
: আপনি কি পেদ্রো পারামো সম্পর্কে জানেন? সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাকে, তার চোখের আত্মবিশ্বাস আমাকে আলোড়িত করেছিল, “কে সে? আবারও জানতে চাইলাম।
: “সে এক জীবন্ত ক্ষোভ," তার উত্তর।
তারপর বিনা কারণেই খচ্চরগুলোকে লাঠি দিয়ে তাড়াতে শুরু করেছিল সে, এমনিতেই যারা ঢাল বেয়ে এগিয়েছিল বহুদূর।
আমি অনুভব করলাম, বুকের কাছে আমার হৃদয় ছুঁয়ে শার্টের পকেটে যেখানে মায়ের ছবিটি রাখা, সে পাশটা ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে, যেন এই গরমে সেও ঘামছে। ছবিটি পুরানো, প্রান্তগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত; কিন্তু সেটাই আমার মায়ের একমাত্র ছবি। ছবিটি আমি রান্নাঘরের আলমারিতে পেয়েছি, একটি পাত্রে লুকিয়েছিল, পাত্রটি ভর্তি ছিল মশলা: লেবু, বালামপাতা, ক্যাস্টিলা ফুল থেকে রুয়ের শাখা,আরো কত কি! সেই থেকে আমি ছবিটি যত্ন করে রেখেছি, আমার মায়ের একমাত্র চিহ্ন। মা ছবি তোলার বিপক্ষে ছিল। কাউকে তাঁর ছবি তুলতে দিত না, বলত, “প্রতিকৃতি নির্মান, ছবি তোলা জাদুবিদ্যার সামিল, কালো-জাদুর হাতিয়ার।“ ছবিটা দেখে সত্যিই আমার তাই মনে হয়েছিল; কারণ পুরো ছবিটা জুড়ে ছিল সুই ফোটানো গর্ত, শত ছিদ্রযুক্ত, বিশেষ করে তারঁ বুকের বামপাশে, যেখানে হৃদয়…হৃদপিন্ড যেখানে থাকে, সেখানে একটি বড় ছিদ্র, যেন আঙুল দিয়ে তাঁর আত্মা ছোঁয়া যায়! ছবিটি আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি, যেন বাবা বিশ্বাস করে আমি তারই ছেলে।
: "দেখতে পাচ্ছেন?” খচ্চরগুলো থামিয়ে সে আমাকে বলেছিল, "ঐ যে পাহাড়টি— শূকরের মূত্রাশয়ের মতো দেখাচ্ছে, ঠিক তার পিছনে মিডিয়া লুনা। ভাল করে দেখুন। আপনি কি পাহাড়টির ভ্রু দেখতে পাচ্ছেন? সেখানে, সেইদিক থেকে তাকালে আরো দূরে, নজর দিলে আরো অনেক দূরে আপনি কি আরো একটি পাহাড়ের ভ্রু দেখতে পান? খুব আবছা, এখান থেকে ভাল দেখা যায় না, ঝাপসা? দিগন্ত বিস্তৃত সেই পুরো জায়গাটা মিডিয়া লুনা, এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত, শেষ থেকে শেষ, একজন বলেছিল, চোখ দিয়ে যতদূর দেখা যায়, যদি সমস্ত পৃথিবীর মুখ ঢেকে দেয়া যায়, যাকিছু পার্থিব — সব তার।
আমরা সেই পেদ্রো পারামোর সন্তান! অথচ আমাদের মায়েরা আমাদের জন্ম দিয়েছে মাদুরে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার সে আমাদেরকে ব্যাপটাইজডও করিয়েছিল। আপনারও তো হয়েছে, তাই না?”
: আমার মনে নেই।
:তাহলে জাহান্নামে যান!
:কি যা তা বলছেন?
: আমি বলছি যে আমরা চলে এসেছি, জনাব। কাছাকাছি চলে এসেছি।
:হ্যা আমি দেখতে পাচ্ছি…ওটা কি?
:একটা‘রোডরানার’, মহাশয়। এই পাখিগুলোকে তারা ‘রোডরানার’ নামে ডাকে।
:না, আমি শহরটির কথা বলছি, এত নিঃসঙ্গ কেন মনে হচ্ছে, যেন পরিত্যক্ত! মনে হয় যেন এখানে কেউ থাকেনা!
: মনে হওয়ার কোন ব্যাপার নেই। বিষয়টা এমনই, এখানে কেউ থাকে না।
:আর পেদ্রো পারামো?
:পেদ্রো পারামো! সেতো কবেই মরে গেছে।
(চলবে)
* * *
মেক্সিকান লেখক হুয়ান রুলফো তার পেদ্রো পারামো নামের ক্ষীণতনু উপন্যাসের জন্য বিশ্বখ্যাত। এটি ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং ইংরেজি সংস্করণটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। লাতিন সাহিত্যের এই মাস্টারপিস স্বয়ং মার্কেজকে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করেছে।