করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ৯ সংখ্যা
এপ্রিল ২০২৫

লেখক-সংবাদ :





ঢাকায় বাস: কল্যাণী রমা
‘ওড়না কোথায়? ওড়না কোথায়? আব্রু লাগবে তো!’ বাড়ির ভিতর থেকে আর্তনাদ ভেসে এল। আমি যাব একটু ছাদে হাওয়া লাগাতে। ওড়নাটা নাকি পাতলা। ওপরে মোটা চাদর লাগবে। মাঝ সকাল। বেশ রোদ উঠে গেছে। আমি মোটা চাদর গায়ে দিয়ে ঘামতে ঘামতে ছাদে গেলাম। কামিনী ফুল দেখলাম। কিন্তু আমার আব্রু দেখবার জন্য কেউ ছিল না। কী আর করা! টোড়িমাসির গলা সবচেয়ে উঁচুতে। মা-রা চার বোন। টোড়িমাসি আমার ছোটমাসি।
আমার বেশ কিছু সুন্দর টি-শার্ট আছে। ভ্যান-গ্যঁ, মাতিসের ছবি আঁকা। খুবই আর্টিস্টিক। সাথে ট্রাউজার। সবাই এখন আলমারিবন্দি। বদলে বানানো হয়েছে কয়েক সেট সালোয়ার, কামিজ, ওড়না। রয়্যাল ব্লু কামিজের উপর হলুদ হলুদ ফুল। একটা কমলা রঙের জামার বুকে কাচ বসানো। সবাই বলল এটা স্ট্রবেরি রঙ। মেনে নিলাম।
সকালে খাবার টেবিলে হাতে গড়া রুটি, সবজি ভাজি, দুই রকমের মিষ্টি, স্বাস্থ্য রার্থে ডিমের জল পোচ, রংচা। আমার জন্য স্পেশাল দুধ চা তিন চামচ চিনি দিয়ে। দশটা এগারোটার দিকে কয়েক রকমের ফল কাটা--আপেল, নাশপাতি, ছাড়ানো কমলা, কখনো আখ, বাংলা কলা। বাংলা কলার নাম এই প্রথম শুনলাম। সব ছোট ছোট করে কেটে বাইট সাইজ। এদিকে আমি তো আমেরিকায় একটা আস্ত বাইট দিয়েই আপেল খেতাম। ছোট ছোট করে ফল কেটে দিচ্ছে কে? জংলি অবস্থা। আর ব্রেকফাস্টে কপাল ভালো থাকলে একটা টোস্ট। একটু পর শেফালিসহ সকলের কাপে কাপে দুধ খাওয়া। শেফালি আমাদের বাসার রান্নাঘর থেকে সব সামলায়। এ বিষয়েও একটা গল্প আছে। শেফালির আসল নাম আহাদি।
মা-বাবার অতি আদরের মেয়ে আহাদি। কিন্তু মানুষের বাসায় রান্না করতে এসে তা কি আর বলা যায়? তাই ও নিজের নাম নিজেই ঝেড়ে ফেলেছে। যখনই এ বাড়িতে প্রথম এসেছে, সাথে সাথে নিজের নাম নিয়েছে শেফালি। আমি বাড়িতে বলেছি দুই বছরের পর মানুষের দুধ খাওয়ার কোন দরকার নেই। সেজন্যই কিনা জানি না গত কয়েকদিন থেকে দুধের কাপ দেখছি না। দুপুরে সবজি, ভাজি, মাছ বা মাংস, ডাল। পাবদা মাছ সকলের পাতে দুটো করে পড়লেও আমার পাতে সব সময়ই তিনটা। করুণাময়ের করুণায়। সাত বছর পর আমেরিকা থেকে এসেছি, আর সাতাশ বছর হল আমেরিকায় থেকেছি ক্যাটফিশ খেয়ে! ভাবলেই মায়ের চোখে জল আসে!
ওড়না পরিস্থিতির পরের পরিস্থিতি হচ্ছে স্নান করা। আমি এতদিন জানতাম স্নান করাটা হচ্ছে পারসোনাল হাইজিন। না, এ বাসায় নয়। সকালের ফল খাওয়ার পরই জেরা শুরু হয়ে যায়, ‘গীজার চালিয়েছিস? স্নান করেছিস?’ ‘পিয়াশ স্নান করেছ?’ পিয়াশ আমার ছোট মেসো। কিন্তু মুক্তি নেই। অবশ্য এমন কথাও শোনা যায় মার মুখে, ‘আজ স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গা ম্যাজম্যাজ করছে।’ স্নান বিষয়ে তাকিয়ে দেখি শেফালি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিভিতে মনোযোগ দিয়ে ইলেকশনের নিউজ দেখছে। টোড়িমাসির এক ধমক, ‘ইলেকশনে দাঁড়াবা নাকি? যাও, স্নানে যাও!’


(২)
কাল জ্যান্ত কইমাছ এসেছে। আমি তো প্রেমেই আধমরা। মাছগুলো সারারাত বালতির জলে ছিল। এই মাছ কাটা হবে? বাড়ির লোকজন উত্তেজিত ফ্রেশ মাছ খাওয়া হবে বলে, আর আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মমতায় মাছ খাব, নাকি খাব না। খেলে টোড়িমাসি আমায় আঁতেল বলবে, নাকি না খেলে? দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
এদিকে সকালে উঠে দেখি টোড়িমাসি উপোস করে বসে আছে। শনিবারের পূজা বৃহস্পতিবারে সুবিধা হবে বলে বৃহস্পতিবারেই দেবে। এরকম নিয়মটা ভালো। ছেলেবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে দুপুরে একটা পূজা হত আর সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি। কিন্তু এখন দেখছি প্রতিদিন টোড়িমাসি পূজা দেয়, শেফালি পূজা দেয়, মা পূজা দেয়। পারিবারিক অবস্থা সংগীন নাকি? আগে জানতাম ধূপের গন্ধে মশা পালায়। পূজা দেওয়ার বাই-প্রোডাক্ট। আমাদের বাড়িতে প্রচুর মশা। কিন্তু এত ধূপেও কেউ কোথাও পালাচ্ছে না। কেবলই বংশবৃদ্ধি করে চলেছে।
পূজা এবং মশা জাতীয় গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে ভাবছি, এমন সময় দেখি শেফালি এক গ্লাস জল নিয়ে এসে হাজির। মা বলেছে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর আমাকে জল দিতে। এত জল খেয়ে আমি কি বঙ্গোপসাগর হব? টোড়িমাসির আর আমার একই রকম দেখতে দু’টো জলের গ্লাস। আলাদা করে চিনবার জন্য আমার গ্লাসের নিচে নেল পলিশ দিয়ে লাল ফোঁটা দেওয়া হয়েছে। কী যে পরিস্থিতি! ফলস্বরূপ, পেডিকিউর করা গ্লাসেই জল খাই আমি।
জল খাবার পর ভাবলাম একটু মিষ্টিও খাই। যদিও লোকে মিষ্টি খাওয়ার পর জল খায়। সেদিন আমার বন্ধু রূপা আমাকে দেখতে এসেছিল। অনেক মিষ্টি আর দই নিয়ে। একটা মিষ্টির নাম মন্ডা। বেশ পছন্দ হল নামটা। প্রায় অর্ধেক খেয়ে ফেললাম। কিন্তু একী? মিষ্টির এমন কাগজ কাগজ স্বাদ কেন। চোখ খুলে দেখি ছাগলের মত আমি কাগজই খাচ্ছি। ছেলেবেলায় আমরা জন্মদিনে গিফট মুড়তাম যে পাতলা রঙিন কাগজ দিয়ে অনেকটা সেরকম পাতলা কাগজ। শুধু রঙটা সাদা। কাগজ খুলে বাকি মিষ্টিটুকু খেলাম। অমৃত! টোড়িমাসিকে বলতেই বলল,’গাধা নাকি? মুক্তাগাছার মন্ডার নাম শুনিসনি কোনদিন? কাগজ খেয়ে বসে আছিস!’


(৩)
হঠাৎ দেখি ফ্যান বন্ধ। লোডশেডিং নাকি? না, টোড়িমাসি ফ্যান অফ করে দিয়েছে। ভোর ছয়টা বাজে। টোড়িমাসি বলল আমি নাকি অনেক ঘুমিয়েছি। এবার উঠতে হবে। মোবাইলে শুনি গান, কবিতা, নাটক নানাকিছু হচ্ছে, মানে শব্দ হচ্ছে। আমি ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে তুচ্ছ করে আবার ঘুমাতে শুরু করলাম। কিন্তু বেশিণ পারা গেল না। নয়টার সময় আবার ফ্যান বন্ধ। আমি নাকি রাত নয়টা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত বারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে ফেলেছি। আর চলবে না। এবার রমনায় হাঁটতে যেতে হবে। কি আর করা! অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলাম। উঠে বিছানাটা ঠিক করছি। টোড়িমাসির প্রশ্নবান- দাঁত মেজেছিস? আরে দুটো কাজ একসাথে করব কীভাবে? তাও একটা বেডরুমে, অন্যটা বাথরুমে। কাজের চাপে যখন আমি ছত্রখান তখন শুনি টোড়িমাসি শেফালিকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘তোমার মামা তো কবিয়াল। তুমি কবিয়াল গান করতে পার না?’ শেফালির সরল উত্তর, ‘না।’ টোড়িমাসি ছাড়বার পাত্র নয়। ‘তা কবিয়াল গান না হোক, এমনি গান করতে পার তো?’ শেফালি তাও বলে, ‘না!’ এত চাপাচাপিতে আমি এবং শেফালি দুজনেই এখন হতভাগা শেফালির গলায় কবিয়াল গান শোনার অপোয় আছি।
অবশেষে রমনায় যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছি। মা’র সাথে হাঁটতে যাব। সালোয়ার কামিজ পরেছি। মা শুধু বলেই চলেছে, ‘পাজামাটা উঁচু করে গুঁজে পর। রাস্তার সব ময়লা লাগবে। তারপর ধুলেও পরিষ্কার হবে না।’ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কোন উচ্চতায় পায়জামাটা পরব! ঘটনাটা কী এবং কতটুকু গুরুতর!
ফ্যানের কথা দিয়েই যখন শুরু করলাম, তখন বলি আজকাল টোড়িমাসিকে ঘরের ভিতর লাইট, ফ্যান অফ করবার এক নতুন রোগে পেয়েছে। থেকে থেকেই সব অফ করে দেয়। কার্যকলাপ সেখানেই থেমে নেই। রমনায় যাওয়ার জন্য লিফটের সামনে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ দেখি টোড়িমাসি লিফটের করিডোরের লাইট নেভাচ্ছে। এ কোন অনাসৃষ্টি? বেশি কিছু না বলে আধো, অন্ধকারে রমনায় যাওয়ার জন্য লিফটে উঠলাম পাজামাটা উঁচু করে গুঁজে ।
(চলবে)

লেখক পরিচিতি: ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী কল্যাণী রমা-র শৈশব-তরুণবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। দীর্ঘকাল বসবাস করছেন মার্কিন মুল্লুকে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং স্পেশালিস্ট তিনি। সাহিত্যচর্চা করেন। গ্রন্থ সংখ্যা আট। বহু বছর পর মাঝে বেশ কয়েক মাস ঢাকায় কাটিয়ে গেলেন। তারই বিচিত্র ও আর্কষণীয় অভিজ্ঞতা সরল অথচ সংবেদী ভাষায় লিখছেন বাংলামাটিতে।- সম্পাদক









লেখা পাঠান, চিঠি লিখুন: [email protected]