উত্তর-তিরিশের বাংলা কবিতার পাঠক, বিশেষ করে আধুনিক কবিতার পাঠক নজরুল ইসলামের কবিতা নিয়ে খুব একটা কি ভাবেন? হয়তো বা! কিছু নিশ্চয়ই পড়েছেন, অন্তত পাঠ্যসূচির তাগিদায়। কিন্তু তাঁদের ধারণা, আমার ধারণায়, রঞ্জিত এবং প্রভাবিত হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর দুটো রচনা দিয়ে: নজরুল ইসলাম, ১৯৪৪; রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক, ১৯৫২।
প্রথমটি প্রকাশিত হয় কবিতা পত্রিকার নজরুল-সংখ্যা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫২ সংখ্যায়। এটি পরে কালের পুতুল প্রন্থে সংকলিত হয়। দ্বিতীয়টি সাহিত্যচর্চা গ্রন্থে সংকলিত হয়। প্রথম প্রকাশ কোথায় হয়েছিলো, সে তথ্য পাই নি। প্রথম প্রবন্ধটি মোটামুটি নজরুল ইসলামের মানস ও সাহিত্যের বিচার। দ্বিতীয়টি বাংলা কবিতার উত্তরসাধকরা কিভাবে রবীন্দ্রনাথের ছত্রছায়ায় আর নিশ্চল নাবালক হয়ে রইলেন না, বরং পাশ্চাত্য সাহিত্যের রসদের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথের রূপ-কৌশলকেই স্বাবলম্বী, নিজস্ব, স্বতন্ত্র অর্জনে রূপান্তরিত করলেন --তার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। এই আলোচনার প্রায় দু-পাতা বুদ্ধদেব নজরুলের সাহিত্যক অস্তিত্ব এবং চারিত্রের কথা বলেছেন। কবিতা, বিশেষ করে আধুনিক কবিতা কি, ঐতিহাসিকভাবে এই শিক্ষাদানের অবিসংবাদিত পুরোহিত হচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু। এই মর্যাদার প্রতাপেই নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেবের ধারণা এবং মতামতকে অনেকের কাছে সহজ-গ্রহণীয় এবং প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সমীচীন মনে হয়েছে। এই ছোট্ট আলোচনার উদ্দেশ্যে বিচার নিয়ে সামান্য পুনর্বিচার, সঙ্গে-সঙ্গে নজরুল-সংখ্যা কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত, জীবনানন্দের লেখা ‘নজরুলের কবিতা’ প্রবন্ধটির পুনঃস্মরণ।
বুদ্ধদেবের বক্তব্যের সারমর্ম স্মরণ করা যাক: ‘একজন মুসলমান যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি সম্প্রতি কলকাতা থেকে এসেছেন এবং তার কাছে -- কী ভাগ্য! কী বিস্ময়! একখানা বাঁধানো খাতায় লেখা বিদ্রোহী কবির আরো অনেকগুলি কবিতা। নোয়াখালির রাক্ষসী নদীর আগাছা-কন্টকিত কর্দমাক্ত নদী তীরে বসে সেই খাতাখানা আদ্দ্যোপান্ত প’ড়ে ফেললুম।’ তরুণ বুদ্ধদেব যুবক নজরুলকে প্রথম দ্যাখেন প্রগতির যুগে ঢাকায় পুরানা পল্টনে । পরে কলকাতায় দেখেছেন ‘কল্লোল’-এর আড্ডায়। শেষবার তাঁর সঙ্গে দ্যাখা হ’লো বছর চারেক আগে -- ‘সবার অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রের আমন্ত্রণে আমরা একদল কলকাতা থেকে যাচ্ছিলাম। স্টিমারে অনেকক্ষণ একসঙ্গে কাটলো-- দেখলাম তাঁর চোখ-মুখ গম্ভীর, হাসির সেই উচ্ছ্বাস আর নেই।’
প্রবন্ধে (১৯৪৪)-র প্রথমাংশে, সংক্ষিপ্ত হলেও, বুদ্ধদেব যুবক নজরুলের ঝাঁকড়া চুল, মদির-চোখ, প্রাণোচ্ছল কন্ঠে গান, সময়হীন-জাত-বোহেমিয়ান রূপ নিখুঁতভাবে পেশ করেছেন। নজরুলের দৈহিক, মানসিক, শৈল্পিক স্বরূপ এবং অন্তত দশ বছরে সেই রূপের বিবর্তনটুকুও। এরপর তাঁর লেখার অভিনিবেশ নজরুলের কবিতার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি , পরে কিছুটা গানেও। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ত্রুটি প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের বক্তব্য হচ্ছে:
১. নজরুল চড়া গলার কবি, তাঁর কাব্যে হৈ-চৈ অত্যন্ত বেশি। . . . অদ্যম স্বতঃস্ফূর্ত নজরুলের রচনার প্রধান গুণ --এবং প্রধান দোষ।
২. কাঁচা, কড়া, উদ্দাম শক্তি, সেই চিন্তাহীন অনর্গলতা, কাব্যের কলকব্জার উপর সেই সহজ নিশ্চিত দখল, সেই উচ্ছৃঙ্খলতা, আতিশয্য, শৈথিল্য, সেই রসের ক্ষীণতা, রূপের হীনতা, রুচির স্খলন।
৩. জীবনদর্শনের গভীরতা তাঁর কাব্যকে রূপান্তরিত করলো না।
৪. যে সম্পদ নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন তার পূর্ণ ব্যবহার তাঁর সাহিত্যকর্মে এখনো হলো না।
৫. ‘বিদ্রোহী’ কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা ‘সর্বহারা’র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানিনে . . .।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে (১৯৫২) নজরুল প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব আরো তীক্ষè, যখন ত্রুটির কথা বলেন:
১. নজরুল ইসলামকে ও ঐতিহাসিক অর্থে স্বভাব-কবি বলেছি ; সে-কথা নির্ভুল।
২. নজরুলের কবিতা অসংযত, অসংবৃত, প্রগলভ ; তাতে পরিণতির দিকে প্রবণতা নেই ; আগাগোড়াই তিনি প্রতিভাবান বালকের মতো লিখে গেছেন . . .
৩. তাঁর কবিতায় যে-পরিমাণ উত্তেজনা ছিলো সে পরিমাণ পুষ্টি ছিলো না . . .।
মেনে নিচ্ছি, বুদ্ধদেবের উদ্ধৃত বক্তব্যের সার কথাকে মেনে নিচ্ছি। চুল-চেরা কোনো তর্কে না গিয়ে এবং বিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে কবিতার যে মান ও ধারণা অর্জন করা গেছে সেই ভাঁড়ারের অবস্থান থেকে। কিন্তু বুদ্ধদেব তো শুধু নেতিবাক্যই বলেন নি। তিনি সোচ্চারে স্বীকার করেছেন:
১. শুধু বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তাঁর আসন নিঃসংশয়, কেননা তাঁর কবিতায় আছে সেই বেগ, যাকে দেখামাত্র কবিত্বশক্তি ব’লে চেনা যায়।
২. সব সত্ত্বেও এ-কথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।
৩. তবু অন্তত এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব।
এ-তো তথ্য এবং সনাতন সংজ্ঞা অনুযায়ী সত্য যে, যখন নজরুল অসুস্থ তখন বুদ্ধদেব বসুই ‘কবিতা’ পত্রিকার দশম বর্ষের কার্তিক-পৌষ, ১৩৫১ সংখ্যা নজরুল-সংখ্যা হিশেবে প্রকাশ করেছিলেন। জীবনানন্দকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ‘নজরুলের কবিতা’ নিবন্ধটি। সুতরাং পক্ষপাতহীন যাঁরা তাঁরা তো বটেই, নজরুল প্রেমিকরাও বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য।
সমস্যা শুধু সেখানেই যখন বুদ্ধদেব বসু লেখেন: “এই যে নজরুল, রবিতাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোলেন, বলতে গেলে অসাধ্য সাধন করলেন এটাও খুব সহজেই ঘটেছিলো এবং এর পিছনে সাধনার কোনো ইতিহাস নেই, কতগুলো আকস্মিক কারণেই সম্ভব হয়েছিলো এটা।
কোন রকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না -নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথ থেকে পালাতে পারলেন তিনি বাংলা কবিতায় নতুন রঙ আনতে পারলেন।
নজরুল ইসলাম নিজে জানেন নি যে, তিনি নতুন যুগ এগিয়ে আনছেন; তাঁর রচনায় সামাজিক রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই।”
নজরুল কোনো দার্শনিক কবি নন, এ কথা সর্ব-স্বীকার্য। ঐতিহাসিকভাবে এবং প্রকরণ অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের পরের কালের কবিদের সগোত্র তিনি নন। এমনকি শেষের রবীন্দ্রনাথের, মানে গদ্যকবি রবীন্দ্রনাথের দলেরও নন। কেননা যে একটিমাত্র গদ্য-কবিতা নজরুল লিখেছিলেন, তাতে গদ্য-কবিতাকেই তিনি আক্রমণ করেছিলেন। তিনি মূলত ফর্মের কবি, মাত্রার কবি। জোর দিয়ে বলি, মাত্রাবেগ ব্যতিরেকে কবিতা তাঁর কাছে অস্তিত্বহীন। কবিতার মাত্রাবেগ-তাড়িত স্বরূপ যে কোনো কবিকেই সাধনা করে লিখতে হয়, বিশেষ করে তিনি যদি নতুন ধ্বনি ও বেগ সঞ্চালন করতে চান কবিতায়। স্বেদত্যাগ আর ভাবনা ছাড়া এই অর্জন কি সম্ভব? সাধনার ইতিহাস নেই এবং নজরুলের কৃতিত্ব আকস্মিক, এ আমি মানতে রাজি নই। আসলে ঐ মেজাজের তিনি নন। হ্যাঁ, তাঁর সাধনা বোদলেয়ার-র্যাঁবো-মালার্মে-ইয়েট্স-- এলিয়ট-রিলকে-উত্তর ‘
correspondence- symbolism-subconscious’ মন্ডিত কাব্যচর্চা নয় ; এ একান্তই বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের অন্তর্গত -- ভারতচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ অব্দি প্রদেশের অন্তর্বর্তী। তাঁর জ্ঞানকে নজরুল বাড়িয়ে নিয়েছিলেন আরব্য-পারস্য কাব্যগুণে। এও তো পারিশ্রমিক ঘাম ফেলে, ভাবনার মৃগকে তাড়িয়েই শিখতে হয়, অবলীলা কিংবা ভাগ্যক্রমে কি পাওয়া সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা কবিতার আঙ্গিক--অন্তত ছন্দোবদ্ধ কবিতার রূপ-- সংগীতের জগৎ থেকে খুব দূরের নয়। অবশ্য স্বীকার্য যে উর্দু কবিতার তুলনায় বাংলা কবিতা অনেক আগেই তর্জমাওয়ালাদের দল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কবিতার ধ্বনির ধারণার অর্জন তাঁর সংগীতজ্ঞানের কাছে ঋণী। তাঁর ছন্দপ্রজ্ঞা গানের জগতের লয়-তাল বিদ্যার সঙ্গে পরিপূরক হিশেবে বেড়ে উঠেছে। বিশদ আলোচনার এ এক স্বতন্ত্র বিষয়, যার বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। বক্তব্য এই যে, নজরুলও একইভাবে সংগীতজ্ঞান থেকে সূত্র গ্রহণ করেছেন তাঁর কবিতার ধ্বনি নির্মাণে। এই অর্জন স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল এবং নিষ্ঠাগত সাধনার ফলাফল-- সে গ্রামীণ গানের চর্চার মাধ্যমেই হোক, উর্দু গজলের শিক্ষায়ই হোক, শাস্ত্রীয় গানের লয়-তালের পারম্পর্যেই হোক, রুবাই-গজল-ক্বাসিদায় অন্তর্গত ‘তক্সীমের’ হিশেব শিখেই হোক। যখন বুদ্ধদেব বলেন যে, ‘. . . যদি পারস্য গজলের অভিনবত্বে তাঁর অবলম্বন না-থাকতো, তাহলে রবীন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথের আদর্শ মেনে নিয়ে তৃপ্ত থাকতেন তিনি বক্তা, কি তখন নিরাসক্ত, নির্বিকার বিচারের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বেশ কিছুটা স্খলিত হয়ে যাচ্ছেন না? নজরুলের কবিতার ধ্বনির প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসবো। এখন কবিতার বিষয়ের প্রতি অভিনিবেশ করা যাক।
আগেই বলেছি নজরুল তত্ত্বপ্রধান কবি নন। তাঁর কবিতার বিষয়ও বড়ো নতুন কিছু নয় : সনাতন প্রেম, প্রকৃতি, তার ওপরে রাজনৈতিক সামাজিক প্রসঙ্গ। শেষেরগুলোকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিদ্রোহের কবিতা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এগুলোর শাঁসে যে বোধ সেটাও প্রাচীন এবং সঙ্গে সঙ্গে যুগোপজীবী নবীন ; সে হচ্ছে: সাধারণ মানুষের অধিকারের বক্তব্যের কবিতা। বাংলা কবিতায় হেমচন্দ্র সম্ভবত প্রথম স্বাধীনতার অধিকারের বিষয়কে প্রচলিত ছন্দোবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালে এবং আয়তন বিস্তৃতসাহিত্যে-- কবিতায় কিংবা গদ্যে গণ-অধিকারের কথা, নিপীড়ন এবং ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে কথা বড়ো একটা আনেন নি। কবিতায় যেটুকু বলেছেন, সে বড়ো নিচু স্বরে ভগবানের কাছে মৃদু প্রতিবাদ --‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছে ভালো’-- কিংবা নিজের ভরসায়, ‘একলা চলো রে’ এই পর্যন্ত গেয়ে। নজরুলের কবিতায় মানবিক অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, নিপীড়নের প্রতিবাদ একটি বড়ো প্রদেশ। এবং আমরা সবাই জানি যে এই বিষয়ের শীর্ষ কবিতাটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’। স্মরণীয় হচ্ছে, নজরুল এই ধরনের বিষয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র, বলিষ্ঠ স্বর নির্মাণ এবং প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ধ্বনি বাংলা কবিতায় আগে ছিলো না, পরেও তাঁর মতো কেউ সার্থকভাবে সেটি প্রয়োগ করেন নি। এই বিশিষ্ট মুক্তক মাত্রাবৃত্ত এবং তার নজরুলী চলন নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রবোধচন্দ্র সেন। ঐ বিষয়ে এখানে পদার্পণ করবো না। বক্তব্য এই যে, রবীন্দ্রনাথ অব্দি বাংলা কবিতার বৃহত্তর বলয়ে স্থাপিত হয়ে গণ-অধিকারের মতো বিষয়কে কবিতাশ্রিত করবার জন্য নজরুলী নির্মাণের চেয়ে সমৃদ্ধতর অন্য কোনো প্রকরণ কি সম্ভব? এই প্রশ্নোত্তর ও পর্যবেক্ষণ তিনি করতে পেয়েছিলেন বলেই, জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, --‘মাত্রাবৃত্ত মুক্তকের উদাহরণ বাংলা কবিতায় বেশি নেই ; এ যুগের অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতার দমন করবার জন্যে সর্বব্যাপী নিপীড়নের যে পরিচয় পাওয়া যায় রাষ্ট্রে ও সমাজে--সেইটে কাব্যের ছন্দালোকে নি:সংশয়রূপে প্রতিফলিত হলে মাত্রাবৃত্ত মুক্তকের জন্ম হয় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। যদি হয় এবং কবিতার ছন্দ যদি যুগের নাড়ি-মূলের নির্দেশ দান করে, তাহলে এরকম মুক্তকে প্রচুর কবিতা আশা করা যায়।’ মুক্তকের ছন্দালোকে বাংলায় এ রকম কবিতা প্রচুর দ্যাখা যায় নি। কেননা স্টাইলে আঁভাগার্ড না হলেও, এ লেখা খুব সহজ-সাধ্য নয়।
স্মরণ করতে হবে গণ-অধিকার এবং নিপীড়ন প্রতিবাদী কবিতা কিন্তু অন্যান্য ভাষায়, বিশেষ করে, স্পানিশে অনেক এগিয়ে গেছে। সে আলেকজাড্রাইনের আঁট-সাঁট পোষাকে রুদ্ধ হয়ে নেই, না রোমান্টিক ভাবালুতায়। বোদলেয়ার-র্যাঁবো-হুইটম্যান নির্দেশিত আধুনিক কবিতার ‘আদর্শ, উপকরণ ও কৌশল অবলম্বন করে, পৃথিবীর বিশ-শতকী কবিতায় এই ধরনের কবিতা স্বাতন্ত্র্যে, মর্যাদায় ও গৌরবে প্রতিষ্ঠিত। একে নিতান্ত মার্ক্সিস্ট কবিতার ছাপ দেয়া যাবে না -- বৃহত্তরভাবে এসব মানবিক অধিকারের কবিতা। এবং এই সাফল্যের সহচর বহুজন, যেমন ফরাশি কবি পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ ; শীর্ষে দু-জন লাতিন : পাবলো নেরুদা এবং সেজার ভায়্যেহো। রেসিডেন্স এন্ লা তির্য়েরা (Residence la Tierra) থেকে কান্তো খেনেরাল(Canto General)-এর কবিতাবলীতে নেরুদা এবং ত্রিল্চে-র( Trilce) পরবর্তীকালীন লেখায় ভায়্যেহো অপূর্ব মহৎ কবিতা রচনা করেছেন গণ-অধিকার বিষয়ে। এইসব কবিতা, মার্ক্সিস্ট কবিতার চিরাচরিত সমস্যা, শ্লোগান, হয়ে ওঠে-নি, পরিশ্রুত সারবত্তারূপে গরীয়ান হয়েছে।
প্রকরণেও এরা আধুনিক, রোমান্টিক ছাঁদের রূপকাশ্রিত ছন্দোবদ্ধ রূপ নয় বোদলেয়ার-র্যাঁবোর পরকালীন কাব্যধারণার সার্থক উত্তরসূরি। এই সব বিদেশী কবি এবং নজরুলের গণ-অধিকার এবং জাগরণমূলক কবিতার বিষয় মোটা দাগে একই। পার্থক্য শুধু এই যে নজরুল লিখেছেন ভারতচন্দ-রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার সংস্কৃতির অন্তর্গত উপকরণ দিয়ে; স্বতন্ত্র সুর নিয়োজনে হিস্পানিক এবং ফরাসি কবিরা উত্তর-বোদলেয়ারীয় কবিতার ধারণায় পুষ্ট হয়ে সান্দ্রতর, চিত্রকল্প-সম্পন্ন, গদ্য-ভেদ বিনাশী স্বরে একই বিষয়ের কাব্যরূপ রচনা করেছেন।
তাঁর অনুজ এবং উত্তর-পঞ্চাশের সব কবিই এবং ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে ঋণী। আধুনিক কবিতা কি, সেই ধারণা তাঁর কাছে শিক্ষালাভের জন্য। সঙ্গে-সঙ্গে এ কথাও সত্য যে প্রতিবাদী এবং গণ-জাগরণমূলক বিষয়কে বুদ্ধদেব বসু কোনোদিনই শ্রেষ্ঠ কবিতার উপযোগী বিষয় বলে মনে করেন নি। বোদলেয়ার, রিলকে এমনকি হেল্ডার্লিন নিয়ে বিশদ লিখলেও পাবলো নেরুদা সম্পর্কে তিনি আদৌ কিছু লিখেছিলেন বলে মনে পড়ে না। আসলে তাঁর মেজাজ ছিলো একা মানুষের মনের অণুরণন, অনুসরণ করে কবিতা রচনার উপযোগী। তিনি উদ্ধুদ্ধ হন একা ব্যক্তির প্রেরণা, উজ্জ্বলতা, কল্পনা, প্রেমে দীপ্ত হওয়া নিয়ে ; সঙ্গে-সঙ্গে পীড়িত হন একা ব্যক্তির অক্ষমতা, দূর্বলতা,অসহায়তা, শত চেষ্টায়ও বিপত্তিতে বিবশ হয়ে যাওয়া নিয়ে। এইজন্যই তিনি বোদলেয়ার ও রেমব্রাঁর শিষ্য অথবা সগোত্র। এই জন্যই বুদ্ধদেব বলতে পারেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত এবং ‘সম্মিলিত মানবতার দৃশ্য যখনই দেখি, আমার মন-খারাপ হয়ে যায়। . . . যেখানে ভীড় সেখানে একই উদ্দেশ্যে -- কি একই উদ্দেশ্যহীনতায় অনেকে জড়ো হয়েছে, সেখানে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য যায় হারিয়ে ; সব মিলে শুধু একটা বিশাল মানবতার পিন্ড যেন কোনো যান্ত্রিক কৌশলে নাড়াচাড়া করছে। সেই দৃশ্য দেখে শুধু ভয় হয়, শুধু কান্তি আসে। এই মানসিকতার মিনার কিংবা দরোজা-জানালা-বন্ধ ঘর থেকে বুদ্ধদেব জীবনানন্দের কাল-সমাজ- ইতিহাস-চেতনাশ্রিত সাতটি তারার তিমির কিংবা মহাপৃথিবীর-র কবিতাকেও গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি বরং তাঁকে ‘স্বপ্নে অনুকম্পায়ী’ ‘নির্জনের নির্ঝর’ হিসেবেই নিয়ন্ত্রিত দেখতে চেয়েছিলেন।
নজরুলের কথায় ফিরে আসা যাক । নজরুলের সাহিত্যকে বিদ্রোহ, কবিাতর ক্ষেত্রে, অন্তত দুটি: ১. প্রতিবাদী বিষয়কে স্বতন্ত্র রূপে র্নিমাণ, ২ বৃহত্তরভাবে তাঁর কবিতার ধ্বনি। দ্বিতীয় বিষয়ের সুবিচার করতে হলে ছন্দ তো বটেই, নজরুলের সংগীত , লয়-প্রজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সে অবকাশ এখানে নেই।
নজরুলের গান নিয়ে বুদ্ধদেব যথেষ্ট প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। ‘গানের ক্ষেত্রে নজরুল সবচেয়ে সার্থকভাবে দান করেছেন। তাঁর সমগ্র রচনাবলীর মধ্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তাঁর গানের।’ এই মন্তব্য সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর গানের অনুরাগ কবিতা ভিত্তিক ; সেটি তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগ প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। এই তথ্যের সমর্থক স্বয়ং প্রতিভা বসুর মন্তব্য এবং ‘রবীন্দ্রনাথের গানে পদ্য ও গদ্য, এই প্রবন্ধের বিশ্লেষণ। গান নিয়ে তত্ত্ব্ শুধু কাব্য দিয়ে হবে না সুর এবং লয় -তাল মাড়িয়ে। সেই জন্য অবাক লাগে, যখন তিনি বলেন, বীর্যব্যঞ্জক গানে চলতি ভাষায় যাকে ‘স্বদেশী গান’ বলে, রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের পরেই তাঁর স্থান হতে পারে। যদি কোন প্রদেশে নজরুল পুরোধা পদপান্ত হতে পারেন, এবং আজ অব্দি, -- তবে সেটা এই গণজাগরণমূলক গানে। সুর-লয়ে তো বটেই, এমনিক পদ রচনায়ও তিনি এখানে সর্বাগ্রে।
‘নজরুলের কবিতা’ এই ছোট নিবন্ধটিতে জীবনানন্দ দাশ অনেক বেশি স্থিতধী, গভীর এবং অন্তর্ভেদী নজরুল বিচারে। নজরুলের কবিতার রূপ এবং উত্থান সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য স্মরণীয় : ‘ইতিহাসোত্থ কারণে এবং অঙ্গাঙ্গী নতুন সময়পর্ব তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো বলে তা একটা আশ্চর্য রক্তচ্ছটায় রঞ্জিত হয়ে উঠেছিলো-- যাকে মৃত্যুর বা অরুণের জীবনেরও বলে মনে করতে পারা যেত।’ ‘বুদ্ধিসর্বস্বতার’ হাতে ধরা পড়েন নি নজরুল, তাঁর কবিমানসের আত্মোপকার প্রতিভাই কবিতার ক্ষেত্রে ‘অঙ্গীকার’ সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছিলো : ‘ধ্বনিময়তাও উৎকর্ণ না করে এমন নয়।’ নজরুলী সাধনার সফলতা এবং সার্থকতা স্বীকার করেও জীবনানন্দ জানিয়েছেন, কবিতা তবুও ‘মহৎ মান এড়িয়ে গিয়েছে।’ তাঁর কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন : ১. জনগণ তখন আজকের মত ঈষৎ উন্নীত কিংবা রূপান্তরিত ছিলো না, চমৎকার কবিতা চাচ্ছিলো ; ২. নিজেকে বিশোধিত করে নেবার প্রতিভা নেই এ-সব কবিতার বিধানে। স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রাগতিরিশের কবিতায় স্বাভাবিকতার দাবি যে বিশোধন এবং ‘অনুশীলিত, সুস্থিরতার’ পরিপন্থী সে কথা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সংবর্ত-র মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন।
রবীন্দ্রত্তোর এবং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতার মধ্যে দুস্তর ফারাক : আধার ও আধেয় দুই মর্মেই। তবু, বুদ্ধদেব বসুর কথাই স্মরণ করা যাক, ‘এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব। এবং সেটা সাহিত্যিক বিদ্রোহে এবং সাধনাসহ। নজরুলের ভালো কবিতায় যে স্বগত বেগ এবং দীপ্তি রয়েছে তার যোগ্য উপস্থাপনে উত্তররৈবিক কুড়ি ও কুড়িশো একের কবিরাও নবতর রূপ এবং অন্তঃসার নির্মাণ সক্ষম হবেন বলেই আমার বিশ্বাস। এই ঘটনার একটি উদাহরণ অন্তত জীবনানন্দের কবিতা থেকেই উত্থাপন করার প্রতিশ্রুতি রইলো।
-ওমর শামস