করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৮ বর্ষ ৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৫

লেখক-সংবাদ :





আল মাহমুদের কবিতা
আল মাহমুদ তাঁর কবিতা সম্পর্কে দুটি মূল্যবান ব্যক্তিগত তথ্য এবং মন্তব্য জানিয়েছেন : 

১. পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় আল মাহমুদের দু’তিনটি কবিতা ছাপেন। এই স্বীকৃতি না পেলে সেই আমলের ঢাকা-পূর্ব পাকিস্তানি সাহিত্য পরিবেশে মাহমুদের কবিসত্তা টিকে থাকা মুশকিল ছিল। 

২. তিনি রবীন্দ্রাথের কাছে না গিয়ে বরং প্রথম তিরিশি কবিদের নিকট, বিশেষ করে আধুনিক কবিতার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে অক্ষরবৃত্ত দ্বারা মুগ্ধ, তাড়িত এবং উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। 

উল্লিখিত তথ্যের সঙ্গে যোগ করা যাক মাহমুদের বাল্য-কৈশোর-যৌবন-জীবন এবং তাঁর লালন-পালন দীক্ষা - সে কালের এবং সে সমাজের পটভূমিতে। তিনি জন্মেছিলেন জুলাই ১১, ১৯৩৬ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটি ধর্র্মভীরু, কৃষি-ব্যবসায়ী, অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রামী পরিবারে। প্রায় ২২-২৩ বছর মফস্বল অঞ্চলে পড়াশুনা করে পরে ঢাকায় আসেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর কবিসত্তার বিকাশ। ইসলাম ধর্মের লোকায়ত দিক, কিছু কেতাবি বিষয় এবং গ্রাম-জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, নিম্নবিত্তের কৃষিজীবীর-নদীজীবীর বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর আবাল্য পরিচয়। এও স্মরণযোগ্য যে ব্রাক্ষণবাড়িয়া অঞ্চলে আলাউদ্দিন-মনমোহন সৃষ্ট এবং প্রচলিত মলয়া-গানের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা রয়েছে। তা ছাড়া উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কল্যাণে ঐ অঞ্চলে গীতি-বাদ্যের একটা প্রচলন, পরিবেশ এবং পরিচর্যা ছিলো। পুঁথিপাঠ, ইসলামী লোকায়ত চর্চা, মলয়ার চর্চা এবং সান্নিধ্য তাঁর কবিতা সাধনার লয়-স্বর-মাত্রার দিকটি প্রভাবিত এবং সমৃদ্ধ করেছে। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর বিষয়বস্তু স্বভাবতই ছিলো গ্রামজীবন নিষ্কাশিত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-সমস্যা-আনন্দ-বিষাদ-সংগ্রাম। মাহমুদের গতর-মন-অক্ষর বাঙলা মাটির গন্ধ-পানি- কাদা-কাম-ঘাম  আবাল্য সম্পৃক্ত। 

আল মাহমুদের কাব্যবিবেচনায় এটুকু নান্দীপাঠের প্রয়োজন আছে। তাঁর প্রথম কবিতাগুচ্ছ, লোকলোকান্তর-এই তিনি নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ করে কবি-অস্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। ঐ বইতেই তাঁর প্রায় সকল স্ব-চিহ্ন বিচক্ষণ পাঠকের নজরে পড়ে। প্রথম থেকেই তিনি একটি নিজস্ব ভাষা গড়েছেন (ক) অক্ষরবৃত্তের লয়ে, (খ) গ্রামীণ ও আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে শুদ্ধ ভাষার একটি বিশেষ মিশ্রণে, (গ) কিছু আরবী-ফারসী জাতীয় এবং পুঁথিতে ব্যবহৃত শব্দের সংযোজনে। শব্দের চয়ন এবং সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অক্ষরবৃত্তে তাঁর বিশিষ্ট লয়টিও নিজস্ব। ঐ ভঙ্গি ব্যতিরেকে শুধু শব্দ, শব্দ-বন্ধ কিন্তু মাহমুদীয় অনুষঙ্গ ও প্রতিবেশ তৈরি করতে পারবে না। তাঁর ভাষার গ্রামীণ অংশটুকু না জসীম উদ্দীনের (তিনি অনেক বেশি লোকায়ত) না জীবনানন্দের (তিনিও প্রাতিস্বিক এবং তাঁর ভাষায় য়ূরোপীয় সাহিত্যের ধ্বনিও কিঞ্চিৎ অংশীদার)। মাহমুদের ভাষার স্বকীয়তা স্বীকার করতে হবে; সঙ্গে সঙ্গে এও স্বীকার্য যে তাঁর কবিতার বিষয়গুলোও ঐ ভাষার সহজানুগ। 

আল মাহমুদ সনেটে সিদ্ধহস্ত এবং যে শ্রুতিকল্পের অক্ষরবৃত্ত তিনি প্রথম যৌবনেই রপ্ত করেছিলেন-পুঁথি-মাইকেলী-রাবীন্দ্রিক-জীবনানন্দীয় শৈলী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষার মশলা মিশিয়ে - সেটি সনেট প্রকাশের প্রভূত সহায়ক। তাঁর প্রথম বই লোক-লোকান্তর, ১৩৭০-এই তার স্পষ্ট স্বাক্ষর : 

শুরু হোক স্ত্রোত্রপাঠ গন্ধবতী তোমার সুনামে,
পীতাভ ধোঁয়ার তলে ডুবে যাক মন্দির দেহলী,
শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি,
লজ্জায় বিবর্ণ মন ঢেকে যাবে ক্রিসেনথিমামে-
অথবা রক্তের নাচে শুরু হবে সিম্ফনির সুর
বৃষ্টির শব্দের মতো মনে হবে তোমার নূপুর। 

[সিম্ফনি, (লোক-লোকান্তর)]

এই বাচন-রস-সৌরভ সম্পূর্ণরূপে পূর্ব-বাংলার (এবং ওপার-বাংলার) কবিতার কানন ছেয়ে ফেলতো সোনালী কাবিন, ১৯৭৩-এর ১৪টি সনেট। এই কবিতাগুলোর মাহাত্ম্য এই যে, এখানে বাংলার গ্রাম-প্রকৃতি-নারী-বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম-ঐতিহ্য-মানব ভ্রাতৃত্ব-সাম্যের মন্ত্র -এত সব উপকরণ ও চিন্তা বাংলা ভাষার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধের  মধ্যে অবিচল রেখেও, মাহমুদ বোদলেয়ারোত্তর আধুনিক কবিতার সুর-ছবি-সৌষ্ঠব-সান্দ্রতার সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পেরেছেন। 

এই ঘটনা তিরিশের কবিদের বিশাল ও বিদগ্ধ সৃষ্টির পরে, ষাট-সত্তরের দশকে ঢাকায় ঘটা একটি ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় সাহিত্যকর্ম। আমার বিচারে, এই কবিতাগুলো সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশের সনেট রচনার সমগোত্রীয়। অবশ্য এদের সকলেই স্বস্থানে, স্বমহিমায় স্তম্ভ-স্বরূপ। (এখানে  এদের পারস্পরিক তুলনা আমার মোটেই অভিপ্রেয় নয়। সংগীতশাস্ত্রের গুণীরা বলে থাকেন, ‘হর ফুল কি আপনি আপনি খশ্বু ’)। 

আল মাহমুদ গদ্যকবিতায়ও সিদ্ধহস্ত এবং তাঁর নিজেস্ব স্টাইল আছে। কবিতা মাত্রারহিত হলেও তাঁর গদ্যের ভিতরে তিনি নিজের স্পন্দন-গতি-নিরবতা তিনটেই স্বভঙ্গীতে সৃষ্টি করেছেন। কতগুলো ভালো গদ্যকবিতা : (১) ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, (২) ‘অন্তরভেদী অবলোকন’, (৩) পালক ভাঙ্গার প্রতিবাদ’, (৪) ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, (৫) ‘অস্পষ্ট স্টেশন’, (৬) ‘স্বরভঙ্গ’। বক্রোক্তির কবিতা, ‘স্বরভঙ্গ’, পাবলো নেরুদার  ঊীঃৎধাধমধৎরধ-র অন্তর্গত অ্যান্টি-পোয়েট্রি, স্মরণ করায়। এগুলোর পরও তিনি বহু সনেট লিখেছেন, গদ্যকবিতাও লিখেছেন। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছর পর ‘কবি ও কালো বিড়ালিনী’ (মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো) , ‘কিংবা খনার বর্ণনা : সনেট পঞ্চক’ (দ্বিতীয় ভাঙন)-এ গুলো চমৎকার সনেট। এবং গুচ্ছকবিতায়ও ছড়ানো-ছিটানো সনেট তাঁর আছে। তবে সোনালী কাবিনগুচ্ছর মতো সব মশল্লা, যতো সুন্দর সামঞ্জস্যে, যতো ভালো চিত্রার্পণে, যতো মধুর সৌগন্ধে বিকশিত হয়েছিলো, এগুলোতে মুন্সিয়ানা সত্ত্বেও সেই অমৃত সৃষ্টি হয় নি। 
আল মাহমুদ নিসর্গ-ত্যাগী কবি মোটেই নন। বুদ্ধদেবের শার্ল বোদলেয়ার-এর ভূমিকা এবং কবিতা পড়েও, তাঁর অনুরাগী হয়েও তিনি বোদলেয়ারীয় প্রকৃতির-বিরুদ্ধে-সংগ্রাম করেন নি। বঙ্গদেশীয় প্রকৃতিতে ধান-নদী-জোনাকি-পানকৌড়ি-পানের বরজ-তেলাপোকা-ঘোরলাগা বর্ষণ-ফড়িং-জলডোরা সাপ-হাঁসের ডিম-আটচালা-জিয়ল মাছে ভরা বিশাল ভা--বেশরম কাউয়ার গতর-কৈবর্তপাড়ার নলিনীদের ভিটেবাড়ি-সিকস্তী গ্রামাঞ্চল-মারফতীর টান-শোনা বাতাস এবং শস্য ও সবুজের সমৃদ্ধিকে আল মাহমুদ মহামাতৃকুল গাঙের ঢেউয়ের মতো কবুল-কবুল করে স্বীকার করেছেন। মোদ্দা কথা, তাঁর বহু কবিতাই প্রকৃতিজনিত; অন্যবিধ বিষয়কেও তিনি প্রকৃতির সহায়তায় এবং পশ্চাৎপটে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতি-বন্দনায় বা ব্যবহারে তিনি রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-র দলের লোক, যদিও তাঁর নিজের ব্যবহার স্বতন্ত্র। 
বাংলা কবিতায় অনেকেই আত্মীয়-স্বজন-পরিবারবর্গ (দেশের প্রধান, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া) নিয়ে কবিতা লিখেছেন। পেরুর কবি, সেজার ভায়্যোহো, যার দক্ষিণ আমেরিকার আদি ইনকা রক্তের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিলো, তিনি বিশেষভাবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত এই বিষয়ের কবিতা লেখার জন্য।  পাবলো নেরুদা তাঁর এ সব কবিতার প্রশস্তি করেছিলেন। আমার মনে হয়েছে, এই ধরনের বিষয়ে আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় শ্রেষ্ঠ। আত্মদর্শী, সমবেদনা-সঞ্চারক হয়ে এবং আধুনিক কবিতার টেকনিক (চিত্রকল্প, শ্রুতিকল্প ইত্যাদি) আপাদমস্তক আত্মস্থ করে অথচ গ্রামবাংলার স্নিগ্ধ-সরল-সৌরভ অনাবিল রেখে অনন্য এবং অপূর্ব কবিতা লিখেছেন। এ ব্যাপারে একটি প্রবন্ধে আমি বিষ্ণু দে এবং আল মাহমুদের নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছি। 

কবির কররেখা গ্রন্থের শেষ স্তবক স্মরণ করা যাক। কবিদের দোহাই পেড়ে তিনি লিখেছেন : 
আমি শুধু কবি আর তো কিছু নই। আমার একটাই দোষ সেটা হলো আমি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, আমার মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি ভাসে। ভাসে কত নদী কত নারী। আমি ফুল ভালবাসি। কারণ তার আয়ু একদিন মাত্র। পরের দিন সে আর্বজনা স্তুপে চলে যায়। সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী যারা আমি তাদের মধ্যেই থাকি। কিন্তু আমার স্থায়িত্ব দৈব নির্ধারিত। মানব জাতির আমাকে ভাল না বেসে গত্যন্তর নেই। কারণ আমি ছন্দ জানি। মিল রচনা করি। আমার হাতে তাল ভঙ্গ হয় না। আমি প্রতিটি ভাষার সম্ভবপর সঙ্গীতের উদগাতা। 
পৃথিবীতে আসিরীয়-বাবিলন কালের আগের থেকেও কবিরা শ্লোক রচনা করে আসছেন, কিন্তু নিরো গোত্রীয় শিল্পী ছাড়া কেউ এই ধরনের আত্মপ্রসাদ খোঁজেন না। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথও তার স্বকর্ম সম্পর্কে অনেক সংশয়ী ছিলেন। আল মাহমুদ পঞ্চাশের পরের প্রধান কবি। তাঁর কৃতিত্ব তাঁরই কৃতিত্ব। কিন্তু তিনি যা পারেন, তার বেশি পারেন না। তাঁরই গ্রামের সন্নিকটের আরেকটি গ্রাম শিবপুরের আরেকজন মহৎ শিল্পী, উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ-র কথা শুনিয়ে দিতে চাই :
আমি কিছুই জানি না। আমি বনে গিয়ে অনেক সময় বাজিয়েছি, কিন্তু কই, আমার বাজনা শুনে কোন পাখি তো ডালে এসে বসলো না, বা কোন হরিণ এসে নিস্তব্ধ হয়ে আমার বাজনা শুনলো না - তবে আমি কী শিখলুম।

(এটি লেখকের দীর্ঘ প্রবন্ধের অংশবিশেষ)

- ওমর শামস








লেখা পাঠান, চিঠি লিখুন: [email protected]