করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





গ্রীষ্মের দিন আরো আসবে
প্যাত্রিক মোদিয়ানো, অনুবাদ : কল্যাণী রমা
গ্রীষ্মের দিন আরো আসবে, কিন্তু কখনো আর গরম এত কষ্ট দেবে না কিংবা সেই মঙ্গলবারে মিলানের রাস্তা যেমন ফাঁকা ছিল তেমনটি আবার হবে না। পনেরোই আগস্টের পরের দিন সেটা। মালপত্র রাখবার বামদিকের জায়গায় আমার সুটকেসটা রাখলাম, স্টেশনের বাইরে ইতস্ততঃ করছিলাম মুহূর্তের জন্য। এই কাঠফাটা রোদে কেউ শহরের পথে হাঁটতে যেতে পারে না। বিকাল পাঁচটা। প্যারিসের ট্রেনের জন্য চারঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কোন একটা আশ্রয় খুঁজে নেওয়া দরকার, হোটেলের দিকে এগিয়ে চললাম আমি। স্টেশন থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরের এক এভিনিউ-এ হোটেলটা। হোটেলের সামনেটা খুব জমকালো।  
এর বিবর্ণ মার্বেলের করিডোর তোমাকে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচিয়েছে, আর পানশালার আধো অন্ধকারে তুমি যেন একদম এক কূয়ার নিচের শীতলতা খুঁজে পেয়েছ। আজো আমি ওই পানশালাকে একটা কূয়ার মতই দেখি, আর হোটেলটা যেন এক দানবীয় দূর্গমত। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমি গ্রেনাডিন আর অরেঞ্জ জুস মিশিয়ে তা স্ট্র দিয়ে খেয়েই তৃপ্ত ছিলাম। বারম্যানের কথা শুনলাম, কিন্তু তার মুখ আজ পুরোপুরি ভুলে গেছি। সে আর একজন খরিদ্দারের সাথে কথা বলছিল। আমি যদিও কিছুতেই ওই মানুষটার চেহারা বা পোশাকের বর্ণনা দিতে পারব না । ওর সম্বন্ধে শুধু একটা জিনিষ আমার মাথার ভিতর থেকে গেছে কথায় কথায় সে কেমন একটা ‘মাহ্’ বলে উঠত। শুনে মনে হত যেন কুকুরের বিষণ্ণ কান্না।
দুই দিন আগে একজন মহিলা হোটেলের একটা ঘরে আত্মহত্যা করেছেন। পনেরোই আগষ্টের প্রাক্কালে। বারম্যান বলছিল ওরা এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। মহিলা বারে এসেছিলেন। একা একাই। আত্মহত্যার পর পুলিশ বারম্যানকে অনেক প্রশ্ন করেছিল। খুব একটা বিস্তারিত কিছু সে ওদের বলতে পারে নি। ঘন বাদামি চুল - ব্রুনেট। এদিকে হোটেল ম্যানেজার কিছুটা নিশ্চিন্ত এই ভেবে যে বছরের এই সময়টা লোকজন কম থাকায় ঘটনাটা লোকজনের নজর অনেকটাই এড়িয়ে গেছে। আজ সকালে করিয়্যার ডেলা সেরা-তে এক প্যারাগ্রাফ লেখা হয়েছে। ফরাসি মহিলা। আগস্ট মাসে উনি মিলানে কি করছিলেন? ওরা আমাকে চেপে ধরেছিল, যেন আমার কাছে উত্তর আছে। তখন বারম্যান ফরাসিতে আমাকে বলেছিল -
“আগস্ট মাসে কারো মিলানে আসা উচিত নয়। মিলানে আগস্ট মাসে সবকিছু বন্ধ থাকে।”
পাশের লোকটা তাতে সায় দিল। বিষণ্ণ গলায় সেই ‘মাহ্’ শব্দটা বলে। আর তারা দু’জনই আমার দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। বুঝিয়ে দিল যে আমারও বিচক্ষণতার অভাব আছে, আর বিচক্ষণতার অভাবের চেয়েও বড় কথা আগস্ট মাসে মিলানে এসে হাজির হওয়ার দায়ে দায়ী আমি।
“পরীক্ষা করে দেখতে পারেন,” বারম্যান আমাকে বলল। “দেখুন আজ মিলানে কেমন একটা দোকানও খোলা নেই।”
হোটেলের বাইরে অপেক্ষায় থাকা হলুদ ট্যাক্সিগুলোর একটাতে উঠে পড়লাম। টুরিস্টের মত ইতস্তত করছি দেখে ড্রাইভার আমাকে পিয়াজা ডেল ড্যুওমোতে নিয়ে যেতে চাইল।
এভিনিউগুলোতে কেউ ছিল না, সব দোকান বন্ধ। আমি ভাবছিলাম ওরা এই এখনই যে মহিলার কথা বলছে, কে জানে সেও হোটেলে গিয়ে আত্মহত্যা করবার আগে হলুদ ট্যাক্সিতে ক’রেই মিলান পার হ’য়েছিল কিনা। ওই জনমানবশূন্য শহরের ছবিই তাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল- তখন এমন কিছু ভেবেছিলাম বলে মনে হয় না। বরং, আমি যদি ষোলোই আগস্টে মিলান আমার মনে কী ছবি এঁকেছিল তা বোঝানোর জন্য শব্দ খুঁজে বেড়াই, তবে দেখব যে আমার মনের ভিতর সাথে সাথেই ভেসে উঠছে মুক্ত শহর। মনে হচ্ছিল এই শহর বুঝি নিজেকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কর্মব্যস্ততা আর হৈ চৈ আবার শুরু হবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
 পিয়াজা ডেল ড্যুওমোতে পর্যটকরা টুপি পরে ক্যাথিড্রালের বাইরে ঘোরাফেরা করছে, গ্যালেরিয়া ভিটোরিয়া ইমানলে ঢুকবার মুখের কাছে একটা বিরাট বড় বইয়ের দোকানে ঝলমল করছে আলো। আর একমাত্র খরিদ্দার হচ্ছি আমি। উজ্জ্বল আলোর নিচে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। উনি কি এই বইয়ের দোকানে পনেরোই আগস্টের প্রাক্কালে এসেছিলেন? ছবির বইগুলোর পাশে, দোকানের পিছনের দিকে রাখা ডেস্কটার পিছনে বসে থাকা মানুষটিকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মহিলাটি সম্বন্ধে খুব অল্পই জানতাম। শুধু এটুকু - তার গাঢ় বাদামী চুল ছিল আর সে ছিল ফরাসী ।
গ্যালেরিয়া ভিটোরিয়া ইমানলে পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মিলানের সব জীবিত প্রাণী সূর্যের ভয়ঙ্কর তেজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছে বাচ্চারা আইসক্রিমের দোকানদারের চারপাশ ঘিরে, জাপানীরা, জার্মানরা, দক্ষিণ থেকে আসা ইতালীর লোকেরা। প্রথমবারের মত শহর দেখতে এসেছে ওরা। যদি তিনদিন আগে সেখানে থাকতাম, হয়ত গ্যালারীতে আমাদের দেখা হ’ত। ওই মহিলা আর আমি, আর যেহেতু দু’জনই ফরাসী, কে জানে হয়ত আমরা নিজেদের মধ্যে কথাও বলতাম।
প্যারিসের ট্রেন ছাড়বার এখনও ঘণ্টা দুই বাকি। আর একবার আমি পিয়াজা ডেল ড্যুওমোতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সিগুলোর একটাতে উঠে পড়লাম। ড্রাইভারকে হোটেলের নামটা দিলাম। রাত নেমে আসছে। আজ এভিনিউগুলো, বাগানগুলো, ওই বিদেশী শহরের ট্র্যাম আর এই গরম যা কিনা আরো একাকী, আরো বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয় মানুষকে মানুষের কাছ থেকে, সব সব যেন আমাকে ওই মহিলার আত্মহত্যার সাথে গেঁথে দিচ্ছে। কিন্তু সেই সময়ে, ট্যাক্সির ভিতর, আমি নিজেকে বললাম যে এটা আসলে শুধু এক দুঃখজনক ঘটনা, যেখানে আছে এক আকস্মিক মিল ।
বারম্যান একা ছিল। সে আমাকে আর একটা গ্রেনাডিন আর অরেঞ্জ জুস দিল।
“কী, খুশী তো?...মিলানে দোকানপাট সব বন্ধ...”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম মহিলা হোটেলটায় বেশীদিন ছিলেন কিনা। কথার বাকি অংশ “যে কিনা” দিয়ে শুরু করতেই বারম্যান সশ্রদ্ধভাবে বলে উঠল, “নিজের জীবন নিজেই নিয়েছিল।”
“না, না বলছিলাম আত্মহত্যা করবার দিন তিনেক আগের কথা...”
“উনি কোথা থেকে এসেছিলেন?”
 “প্যারিস। দক্ষিণে ছুটিতে কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করবার জন্য যেতে চেয়েছিলেন। ক্যাপ্রিতে...পুলিশ তেমনই বলেছে। কাল ক্যাপ্রি থেকে কেউ একজন আসবে সব ঝামেলা মেটাতে...”
সব ঝামেলা মেটাতে! এইসব বিষণ্ণ শব্দের সাথে জাদুকরের মত ভেল্কি দেখিয়ে ক্যাপ্রি উজ্জ্বল নীল রঙ, সাগরের গুহা, গ্রীষ্মকালের আনন্দ-উল্লাস- এর কি মিল দেখাতে পারবে?
“খুব রূপসী ছিলেন...ওইখানে বসেছিলেন...”
ডানে পিছনের দিকে একটা টেবিল দেখিয়ে দিল সে।
“আমি তোমাকে যে ড্রিঙ্ক দিয়েছি, তাকেও সেই একই ড্রিঙ্ক দিয়েছিলাম...”
আমার ট্রেনের সময় হ’য়ে গেছে। বাইরে অন্ধকার, কিন্তু গরমের তেজ ভরদুপুরে যেমন ছিল এখনও ঠিক তেমনই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। এভিনিউ পার হ’য়ে গেলাম, আমার চোখ আটকে গেল স্টেশনের সামনের দেয়াল জোড়া ভাস্কর্যের গায়ে। মালপত্র রাখবার বামদিকের বিশাল হলঘরটায় দাঁড়িয়ে আমি আমার সব পকেট খুঁজে দেখতে থাকলাম। সুটকেসটা যেন আবার পেতে পারি।
করিয়্যার ডেলা সেরা কিনেছি। মহিলার উপর লেখা প্যারাগ্রাফটা পড়তে চেয়েছিলাম। আমি যে প্ল্যাটফর্মে এখন দাঁড়িয়ে আছি, সেটাতেই উনি প্যারিস থেকে এসে নেমেছিলেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর আমি পাঁচদিন পর সেই একই পথ পার হতে যাচ্ছি, উল্টোদিক থেকে...এখানে এসে আত্মহত্যা করা-- সত্যি কি এক অদ্ভুত ভাবনা, আর যখন কিনা বন্ধুরা তার জন্য ক্যাপ্রিতে অপেক্ষা করছে...কিসের জন্য সে এমনটা করল, আমি তা কোনদিন জানতে পারব না।

[বারবারা রাইট-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে প্যাত্রিক মোদিয়ানোর ‘মধুচন্দ্রিমা’ (‘হানিমুন’-- ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশকাল: ১৯৯২) উপন্যাসটির একটি অধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ বাংলামাটিতে পোস্ট করা হলো।

এই ম্যাগাজিনের কোনো লেখা কোনো অনলাইন বা প্রিন্ট পত্রিকায় প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই সম্পাদকের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন হবে [email protected]]