করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





ধারাবাহিক উপন্যাস
রূপে তোমায় ভোলাবো না
সৈয়দ আনওয়ারুল হাফিজ
(৫)
সকালবেলা হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে যাবার জন্য ওরা দু’জনে তৈরি। ড. গুপ্ত বললেন, ‘সংঘমিত্রার দরজায় একবার টোকা দাও তো। দেখি ও রেডি কিনা!’
সুফী তাই করলো। কিন্তু কোন জবাব নেই। মনে হয় ও আগে উঠেই খেতে চলে গেছে। ডাইনিং রুমে ঢুকেও কিন্তু সংঘমিত্রাকে দেখতে পেল না। ওরা দু’জন একটা টেবিলে বসে পড়লো।
ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিতে যাচ্ছে এমন সময় সংঘমিত্রা হাসিমুখে ঢুকলো ডাইনিং রুমে। বললো, ‘দেখেন দেখি এই চাদরটা কেমন হয়েছে? সামনের দোকান থেকে কিনলাম। সস্তাই হলো। এটা কটনের কিন্তু দেখতে ঠিক আমার ওই চাদরটা যেটা ট্রেনে ওই মেয়ের গায়ে রেখে এসেছি। রঙ সম্বন্ধে কিছু খারাপ বলতে পারবেন না। লাল আমার সবসময় পছন্দ। যেটা ফেলে এসেছি সেটা পশমের ছিল। তাই বেশ গরম। আর কাঠমান্ডুর জন্যে ওটা ঠিক ছিল। আর বম্বেতে নাকি বেশি ঠাণ্ডা পড়ে না। তাই এই চাদরটাই বোধহয় ভালো হবে।’ হাসিমুখে ও বলেই চলেছে নিজে নিজে। বোঝাই যাচ্ছে খুব খুশি হয়েছে ও চাদরটা কিনে।
শেষ পর্যন্ত সুফী বলতে চেষ্টা করলো, ‘আমাকে যেটা দিয়েছেন সেটা নিয়ে নিলেই হতো। আমার জন্য এ রকম একটা এখান থেকে কিনে নিতাম।’
ভ্রু তুলে সংঘমিত্রা এবার বললো, ‘এই লাল চাদর আপনি গায়ে দেবেন? আপনি একদম কী যেন! এই রঙ কী পুরুষদের মানায়?’
‘এই লাল চাদরটা বদলে অন্য রঙের একটা পছন্দমতো চাদর এখনই দোকানে গিয়ে নেয়া যায়, চলুন না।’ বললো সুফী।
সংঘমিত্রা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘আপনি তো দেখছি মহাঝামেলার লোক। যে চাদরটা আপনাকে দিয়েছি আর কোন কথা না বলে সেটা নিজের কাছে রেখে দিন। ওটাতে আপনাকে মানায় বেশ ভালো। আমার খিদে পেয়েছে। আপনারা কিছু অর্ডার দিয়েছেন?’
অজন্তায় ওরা যখন পৌঁছলো তখন প্রায় দুপুর। দূর থেকে দেখতে পেল দুই পাহাড়ের মাঝে একটা ক্যানিয়নের মতো। তার গভীরে একটা ছোট্ট নদীর আভাস। ওয়াগোরা নদী। চতুর্দিকে সবুজের জঙ্গল। দূর থেকে
অজন্তার গুহাগুলোর মুখ অল্প অল্প দেখা যায়। জঙ্গলে প্রায় ঢেকেই রেখেছে। গুহাগুলোর কাছে দেখলো বেশ ভিড় জমে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে গাইডের জন্য। একটু পরে গাইড এসে একটা ভূমিকা দিলেন অজন্তা সম্বন্ধে।
এদেশে পাহাড় কেটে কিংবা গুহার ভেতর ছবি এঁকে বুদ্ধের জীবনী বা তাঁর বাণীগুলো মূর্ত করা পুরাকালে একটা রেওয়াজ ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টাব্দ ছয় শতাব্দী পর্যন্ত অজন্তার বিভিন্ন রাজার আমলে এই পুরাকীর্তি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তারপর কোন কারণে এগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রায় দেড় হাজার বছর অজন্তার কথা লোকে ভুলে যায়। ধীরে ধীরে জঙ্গলে আবৃত হয়ে যায় এই সুন্দর গুহাগুলো। তারপর এরা শুধু বন্যপ্রাণী আর বাদুড়ের আস্তানা হয়ে যায়।
বহু বৎসর পর ১৮১৯ সালের ১৯শে এপ্রিল জন স্মিথ নামক বোম্বাই প্রেসিডেন্সী থেকে এক ইংরেজ অফিসার অজন্তাকে পুনরাবিষ্কার করেন। তিনি বাঘশিকারী ছিলেন। বাঘের খোঁজে এসব দুর্গম জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ এই গুহাগুলো দেখতে পান। এখন যেটা নয় নম্বর গুহা তার দেয়ালে তিনি নিজের নাম আর তারিখও খোদাই করে লিখে গিয়েছিলেন। অস্পষ্ট সেই স্বাক্ষর এখনও দেখা যায়। এখন অবশ্য অজন্তার দেয়ালে কোন কিছু লেখা একেবারে নিষিদ্ধ। যদি কেউ করেন তবে তাকে এই ওপর থেকে বহু নিচে ওয়াগোরা নদীতে ফেলে দেয়া হবে।’ হাসতে হাসতে বললেন গাইড। বললেন, ‘কতগুলো গুহা বেশ অন্ধকার। একটু সাবধানে চলবেন কিন্তু।’
এরপর গাইড একের পর এক গুহায় নিয়ে গিয়ে বোঝাতে লাগলেন এদের ইতিহাস, ভাস্কর্য আর ম্যুরালের তাৎপর্য ইত্যাদি। প্রথমে এগুলো ছিল চৈত্য বিহার অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার জায়গা। পরে ভাস্কর্য আর ম্যুরালের শুরু। শতবাহন রাজাদের সময়ে এগুলো শুরু হয়। পরে অন্যান্য রাজারাও বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজ্যের শিল্পীদের দিয়ে এখানে কাজ করিয়েছেন। নিজেদের ধন ও উপাদান দিয়ে নানা রকম সাহায্য করেছেন। মাঝে মাঝে কাজে যতি পড়েছে। যখন তারা যুদ্ধবিগ্রহে বা অন্য রকম বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়তেন। আবার অনেক বছর পর যখন হয়তো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন অন্য শিল্পীরা এসে আবার কাজ শুরু করেছেন।
গুহাগুলোর সামনের দিকটায় দিনের আলো আছে কিন্তু ভেতর দিকে একটু একটু অন্ধকার। ভেতরে জায়গাও কম। তাই ভিড়টা সেখানে একটু বেশি ঠেকছে।
সুফী বললো, ‘ড. গুপ্তকে তো দেখছি না। তিনি বোধহয় ভিড়ের ঠেলায় আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন।’
সংঘমিত্রা বললো, ‘তাই তো। তাঁকে দেখছি না। চিন্তার কথা। সবাইকে একসঙ্গে হোটেলে ফিরতে হবে কিন্তু। আচ্ছা আপনি আমার হাত ধরবেন? তা নইলে আমরা দু’জনেও হয়তো আলাদা হয়ে যেতে পারি। আমার এতো ভিড় ভালো লাগছে না। আর ভেতরে গরমটাও বেশি।’
সুফী তার ডান হাতের মুঠোর ভেতরে সংঘমিত্রার বাঁ হাতটা ধরলো। মাথার পিছন দিকটায় সুফী একটা শিরশিরনি অনুভব করলো। একটা সুখ জাগানিয়া অনুভূতি। একজন অচেনা মেয়ের হাত সে কখনো ধরে নি। বিশেষ করে এ রকম একটা একান্ত পরিবেশে।
সংঘমিত্রা ফিস ফিস করে বললো, ‘আপনি বোধহয় কখনো কোন মেয়ের হাত ধরেন নি, বুঝতে পারছি। মুঠোর মধ্যে আমার হাত না ধরে আমার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে আপনার আঙুল দিয়ে ধরে থাকুন।’
তাদের গাইড কী বলছে ওর কানে তখন ওগুলো ঢুকছিল না। জাতকের যেসব গল্প তিনি বলছিলেন সেসব শোনার মতো ওর মনের অবস্থা তখন নেই। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে গুহা থেকে ওরা বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন আলো। গুহার ভেতরের অন্ধকার ভাবটা কেটে গেছে। বাইরে জায়গা বেশি। তাই ঠেলাঠেলি নেই।
সংঘমিত্রা বললো, ‘এবার তাহলে আমার হাতটা ছেড়ে দিন। খোলা জায়গায় হারিয়ে যাবো বলে মনে হয় না।’ কিন্তু সুফী কথাটা শুনলেও সংঘমিত্রা যে তার হাতটা এবার ছেড়ে দিতে বলছে সেটা ওর কানে ঢুকলেও মাথায় ঢুকলো না। কয়েক মুহূর্তের জন্য ও হাতটা ছেড়ে দিতে ভুলে গেছে। সংঘমিত্রা একটু হেসে বললো, ‘ঠিক আছে, আমার হাতটা ধরেই থাকুন। আমারও ভালো লাগছে।’ সুফী লজ্জা পেয়ে হাতটা ছেড়ে দিলো।
ওদের সামনেই একজন বুড়ো ভদ্রলোক আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। হঠাৎ মনে হলো তাঁর পা উঁচুনিচু মেঝের কিছু একটাতে হোঁচট খেলো। অমনি তিনি সেই পাথরের মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ কিছু করার আগেই সংঘমিত্রা মেঝেতে বসে পড়লো লোকটার পাশে। কাঁধে হাত দিয়ে বললো, ‘আপকো চোট লাগা? দুখ পাঁয় আপ?’
লোকটা কিছু বলতে পারলো না প্রথমে। ওমনি করে হঠাৎ পড়ে গিয়ে তিনি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর নিজের দু’হাত দিয়ে হাঁটু দুটো চেপে ধরলেন। পাথরের মেঝেতে পড়ে গিয়ে তাঁর পা ছড়ে গেছে। চামড়া কেটে কিছু রক্ত বেরুতে শুরু করেছে। ততক্ষণে আরো কয়েকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। মনে হলো গাইডটি একাই একটু বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন। জটলা দেখে ফিরে এলেন। ব্যাপারটা বুঝে বললেন, ‘মেইন গেটের ওখানে ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা আছে। আমি খবর দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না।’
সংঘমিত্রা বললো, ‘আমি নিজে ওখানে গিয়ে বলছি কিছু ব্যবস্থা করতে।’ গাইডকে বললো, ‘আপনার তো অনেক কাজ ভিজিটরদেরকে নিয়ে। আপনি বরং এ ধারে দেখুন। আমি যাচ্ছি গেইটে।’
সবাই মিলে বুড়ো ভদ্রলোককে ধরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল।
সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আপনি থাকুন তাঁর সঙ্গে। আমি এক্ষুণি আসছি ফাস্ট এইড নিয়ে।’
সুফীর নিজেকে তখনো একটু অসহায় মনে হচ্ছিলো। কী করবে সে বুঝতে পারছিল না। অথচ সংঘমিত্রা চটপট সব করণীয় কাজ করে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। সুফীর মনে একটা গর্ব ভরা আনন্দের ভাব এসে গেল সংঘমিত্রার কাজ দেখে। লোকটার পাশে সেও বসে পড়লো পাথরের ঠাণ্ডা মেঝেয়। গাইডও সংঘমিত্রার চটপটে কাজ দেখে প্রশংসার সুরে বললো, ‘বহুৎ স্মার্ট লাড়কি হ্যায়। অওর দিল মে বহুৎ দায়া ভি হ্যায়।’
গাইড লোকটা সুফীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপতো উনকে সাঁথ হ্যায় না?’
সুফীর মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যদিও প্রশংসা সবটাই সংঘমিত্রার জন্য। কিন্তু একটু আগেই তো সে মেয়েটির হাত ধরেছিল। ভাবতেই তার নিজের মনেও একটা গর্বের ভাব এসে গেল।
সংঘমিত্রা ফিরে এলো দু’মিনিট পরেই। সঙ্গে এলেন দু’জন লোক একটা স্ট্রেচার নিয়ে। ওরা ধরাধরি করে বুড়ো লোকটাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ফিরে চললো। হাতটা তুলে বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাগওয়ান আপকি ভালা কারে।’ কথাটা সংঘমিত্রার জন্য সেটা সবাই বুঝতে পারলো।
গাইড বললো, ‘আব চলিয়ে ইসকে বাদ আপলোকগো আঠারে নামবার কেভ দেখায়েঙ্গে। মেরা পসন্দ কা পেইন্টিং ইস কেভ মে হ্যায়।’
সুফীর মাথা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক গুহার ভেতর ঢুকেছে। বুদ্ধের কত রকম ছবি আর ভাস্কর্য দেখালো গাইড। কতো কথা বললো হিন্দিতে, মাঝে মাঝে ইংরেজিতে। কতকগুলো গুহার একটু ভেতরে ঢুকলেই অন্ধকার বেশ গাঢ় লাগে। দুপুরবেলার বাইরের আলো গুহার বেশি ভেতরে যেতে পারে না। গাইডের হাতে রয়েছে একটা স্পটলাইট। বিদ্যুতের লম্বা তার বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছিলো তাদের। মেঝেতে সাপের মতো তার ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এই তার একটু বাঁচিয়ে সাবধানে চলবেন। তা নইলে হোঁচট খেয়ে পড়বেন। ইলেকট্রিক শকও লাগতে পারে কিন্তু।’
সংঘমিত্রা ওর পাশে পাশেই কিন্তু ওর হাত ধরা নেই সুফীর মুঠোয়। সেই ছোঁয়া থেকে সে এখনও মুক্ত হয়নি মনে হয় তার। একটু আগেই সেই নরম হাতটা ছিল তার মুঠোয়। তখন সংঘমিত্রা কোন রকম ভাবান্তর দেখায় নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করছিল সে। গাইডের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করেছিল। কিন্তু সুফী তখনও আচ্ছন্নের মতো হাঁটছিল সংঘমিত্রার পাশে পাশে।
গাইড বলছিলো আঠার নম্বর গুহার ফ্রেসকো চিত্রের কথা। রাজকুমারী প্রসাধনে ব্যস্ত। তাঁর পরিচারিকা আয়না ধরে আছে যুবতী রাজকুমারীর মুখের সামনে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে সে ব্যস্ত। একটা ছোট ছেলে তাকিয়ে দেখছে রাজকুমারী আর তার পরিচারিকার দিকে ওপর দিকে মুখ করে। প্রাসাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা স্থির চিত্র কিন্তু বহু বৎসর পরেও জীবন্ত লাগছে।
হঠাৎ গাইডের হাতে ধরা স্পটলাইট নিভে গেল। মুহূর্তে পুরো গুহাটা একেবারে নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল। সংঘমিত্রা আবার ‘আই মাম্মী’ বলে একটা চাপা ভয়ার্ত চিৎকার দিলো। সুফীকে জড়িয়ে ধরলো সে। এটা সুফী মোটেও ভাবতে পারে নি। তার আগের দিন ট্রেন যখন টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো আর এরকম হঠাৎ অন্ধকারে সংঘমিত্রার ভয়মিশ্রিত সেই ‘আই মাম্মী’ ডাক সে প্রায় ভুলে গেছিল। কিন্তু এবার মেয়েটি আরো জোরে সুফীকে প্রায় জড়িয়ে ধরলো।
গাইড বললো, ‘সরি, ইলেকট্রিকের কানেকশন বোধহয় কোনভাবে কেটে গেছে। তবে আলো আবার আসবে এখুনি। ভয় পাবেন না।’
মিনিট খানেক থাকলো অন্ধকার। সংঘমিত্রা ছাড়লো না সুফীকে যতক্ষণ না আলো আসলো। যদিও অন্ধকার ছিল হয়তো মিনিট খানেক কিন্তু সংঘমিত্রার কাছে বোধহয় মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল। সুফীও সময়ের কোন হিসেব রাখতে পারে নি। সংঘমিত্রা দু’হাত দিয়ে ওকে প্রায় জাপটে ধরে আছে। ওর শরীরের স্পর্শ বুকের ছোঁয়ার আভাস সুফীকে বোবা করে দিয়েছে। একটা সান্ত্বনার কথাও সে বলতে পারলো না সংঘমিত্রাকে। তারপর হঠাৎ আবার আলো এসে গেল।
এবার গাইড বললো, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। মাঝে মাঝে এ রকম হয়। হয়তো বিদ্যুতের তারটা কারো পায়ের তলায় পড়ে কানেকশনে ব্যাঘাত ঘটেছিল। তবে একটা কথা ভেবে দেখুন - এই দিনদুপুরেই এ গুহার ভেতর কী রকম অন্ধকার। এ রকম অবস্থায় প্রায় দু’হাজার বছর আগে শিল্পীরা এতো সুন্দর রঙিন ছবিগুলো এঁকেছিলেন। আলো কোত্থেকে আসতো তখন? হয় তারা অনেক প্রদীপ বা মশাল ব্যবহার করতেন কিন্তু তাতে এ রকম বন্ধ গুহার ভেতরে অনেক ধোঁয়া নিশ্চয় আটকে থাকতো। মাসের পর মাস সে ধোঁয়া একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করতো। অনেকে বলেন, বাইরের সূর্যের আলো অনেকগুলো আয়না দিয়ে প্রতিফলিত করে গুহার ভেতরে আনা হতো। এই আলোয় শিল্পীরা কাজ করতেন।’
সবাই আস্তে আস্তে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো চোখ ধাঁধানো দিনের আলোয়। সংঘমিত্রা তখনও সুফীর কনুইয়ের কাছটা দু’হাতে ধরে আছে। বললো, ‘সরি, আপনাকে চমকে দিয়েছিলাম বোধহয়। আগেই বলেছি আমার হঠাৎ অন্ধকারকে ভীষণ ভয়।’
সুফী ওর কথায় কান না দিয়ে বললো, ‘আপনি মাকে মাম্মী বলে ডাকেন তাই না?’
‘হ্যাঁ তাই। আপনি মাকে কী বলে ডাকেন?’
‘আমি বলি আম্মা। তবে অনেকেই মা বলে আমাদের দেশে।’
‘আমাদেরও তাই। মা, আম্মা এ রকম নামগুলো বোধহয় সব ভাষাতে একই। তবে আমি বলি ‘মাম্মী’।’
সুফী গম্ভীর সুরে বললো, ‘চলুন, সামনের ওই জঙ্গলে ঘেরা গুহায় যাই। সেখানে আরো অন্ধকার।’
‘কেন ওই গুহাটায় আরো কিছু আছে নাকি দেখবার মতো?’
‘তা নেই। তবে আপনার ‘আই মাম্মী’ ডাকটা আবার শুনতে চাই।’
সংঘমিত্রা এবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সুফীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে তর্জনী তুলে ওর দিকে চেয়ে বললো, ‘ভালো হবে না কিন্তু। একটা নিরীহ মেয়েকে একলা পেয়ে আপনি ভয় দেখাচ্ছেন।’
এমন সময় পেছন থেকে ড. গুপ্তের গলা শোনা গেল। বেশ বাজখাঁই গলা। ‘এই যে তোমরা এখানে। আমি তো ভাবছিলাম তোমরা হারিয়ে গেলে কেমন করে?’
‘যাক বাঁচলাম। আমরা তো চিন্তায় পড়েছিলাম আপনাকে হারিয়ে।’ বললো সংঘমিত্রা। তারপর সুফীর দিকে চেয়ে চুপে চুপে বললো, ‘বলে দেবো মাস্টার মশায়কে। আপনি আমাকে শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছিলেন একটু আগে।’
‘আচ্ছা আর করবো না। যদি করি তাহলে না জানিয়েই করবো।’ ড. গুপ্তের দিকে ফিরে বললো, ‘আপনারা এখানে দাঁড়াবেন স্যার। আমি একটা ছবি তুলবো দু’জনের।’
‘আপনার কাছে ক্যামেরা আছে? আমাদের ছবি তুলবেন জানলে কিন্তু পারফিউম মেখে আসতাম।’
ঠাট্টা গায়ে মাখলো না সুফী। বললো, ‘এই যে এখানে দাঁড়ালে প্রায় পুরো কেভগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে পাওয়া যাবে।’
‘হ্যাঁ, বেশ ভালো আসছে এখন। একটু অপেক্ষা করি। পেছনের লোকগুলো যদি একটু সরে যায় তাহলে কম্পোজিশনটা ভালই হবে।’
সংঘমিত্রা মনে হয় ভাল মেজাজেই ছিল। বললো, ‘বেশ তো। আমরা ছবিতে থাকবো তো, গুহা আর আমরা সবাই।’
সুফী বললো, ‘মুখ গোমড়া করে থাকলে কিন্তু বাদ দিয়ে দেব।’ ক্লিক করলো ক্যামেরা।
‘থ্যাংক ইউ’, ড. গুপ্ত বললেন, ‘এসো এবার তোমার ছবি তুলে দিই তোমার ক্যামেরায়।’
সুফী দাঁড়ালো সাতাশ নম্বর গুহার সামনে।
ড. গুপ্ত বললেন, ‘সংঘমিত্রা তুমিও দাঁড়াও ওর সাথে।’ ছবি তোলার ঠিক আগে আবার বললেন, ‘সংঘমিত্রা বেশি বেশি পোজ দিও না। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো।’
ওরা দু’জনেই হেসে ফেললো। ছবিও উঠলো।
ক্যামেরা উল্টে পাল্টে দেখলেন ড. গুপ্ত। বললেন, ‘বেশ ভালো ক্যামেরা শুনেছি তোমার এই রোলিফ্লেক্স। কতদিন ব্যবহার করছো এই ক্যামেরা?’
‘এই প্রথম। রোলিফ্লেক্স আমি কোথায় পাবো? আসলে এটা আমার খবরের কাগজের সম্পত্তি। সাংবাদিক হিসেবে যাচ্ছি বিদেশে। তাই আমাকে দেয়া হলো। লেখার সাথে সাথে ছবিও যদি তুলতে পারি তাহলে প্রতিবেদনটা আরো জীবন্ত হবে তাই।’
ড. গুপ্ত বললেন, ‘তোমাদের খিদে পাচ্ছে না? চলো ফেরার পথে ইলোরা আর আওরঙ্গাবাদ দেখবো। পথেই খেয়ে নেব। রাত্রে বম্বে মেইলটা ধরতেই হবে। আওরঙ্গাবাদেই খেয়ে নেয়া যাবে। বড় শহর। ভালো খাবারের জায়গা থাকবেই।’
‘হ্যাঁ, তবে তার আগে পথে কোথাও একটু চা-টা হয়ে গেলে ভালই হবে।’

(চলবে)
অঙ্কন: তাইয়ারা ফারহানা তারেক