করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





লিউ তলস্তয় : বিশ্ব সাহিত্যের পুরোহিত
কামরুল হাসান
গত শতকের একেবারে গোড়ায়, ১৯০১ সালে, যখন সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ প্রবর্তিত হল, তখনও লিও তলস্তয় জীবিত, সাহিত্যিক খ্যাতির গগনস্পর্শী চূড়ায়। সারা পৃথিবীর সাহিত্যমোদী মানুষ ভেবেছিলেন পুরস্কারটি তলস্তয়ই পাবেন, কেননা তাঁর আশেপাশে সমতুল্য কোন লেখক বা কবি ছিলেন না। অথচ সবাইকে হতবাক করে পুরস্কারটি দেয়া হল স্বল্পপরিচিত, তলস্তয়ের তুলনায় প্রায়অখ্যাত, প্রতিভায় তাঁর সিকিভাগ, ফরাসী কবি সালি প্রুধোমকে। গোড়ার ওই মারাত্বক ভুলটি সংশোধনের জন্য আরও নয়টি বছর পেয়েছিল সুইডেনের নোবেল কমিটি, কেননা তলস্তয় বেঁচে ছিলেন আরও নয়টি বছর। ২০১০ সালের ২০ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করলে নোবেল কমিটিকে আজীবন হাত কামড়াতে হয় ওই ‘অমার্জনীয় অপরাধের’ জন্য। নোবেল প্রাইজ নিয়ে বিতর্কের  সেই শুরু, আর এরপরে ওই কমিটি এরকম বহু তুঘলঘী কা- ও অবিবেচনার স্বাক্ষর রেখেছে। গোড়ায় গলদ বোধহয় একেই বলে!

তরুণ বয়সে বিশ্ব সাহিত্যের যে দরোজাটি আমাদের সমুখে খোলা ছিল, তা হল রুশ সাহিত্যের দরোজা, যে দরোজা দিয়ে প্রবেশ করে আমরা ঐশ্বর্যম-িত এক সাম্রাজ্যের সন্ধান পেয়েছিলাম। প্রগতি প্রকাশনের কল্যাণে আর কতিপয় অনবদ্য রুশভাষা অনুবাদকের দক্ষতায় আমরা পাচ্ছিলাম বিশ্বের অন্যতম সেরা সাহিত্যের স্বাদ - অতিসুলভমূল্যে, মাতৃভাষায়।  সে বালক বয়সেই পরিচিত হয়েছিলাম জগদ্বিখ্যাত সব নামের সাথে, তরুণ বয়সে পেয়েছি পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা ব্যাপী  তাদের অতুলনীয় মেধার বুনন, পুরোটা বুঝিনি, প্রতিভার দীপ্তি পরিপূর্ণ উপলব্ধির  বয়স সেটা নয়। তলস্তয়ের নাম তখন থেকেই মগজে বাসা বেঁধেছে, তাঁর উপন্যাসসমূহকে সমুদ্রের মত আহবানকারী ও দুর্লঙ্খনীয় মনে হত।

লিউ তলস্তয়ের জন্ম ১৮২৮ সালে রাশিয়ার এক অভিজাত পরিবারে। বাবার জমিদারি ছিল রাশিয়ার তুলা অঞ্চলে। তার মা ছিলেন একজন বিদূষী নারী যিনি কয়েকটি ভাষা জানতেন ও পিয়ানো বাজাতেন। দুঃখজনক যে মাত্র নয় বছর বয়সে তলস্তয় মা-বাবা দু’জনকেই হারান। বালক তলস্তয় দাদার আশ্রিত এক ফুফুর দ্বারা প্রতিপালিত হন। আশ্চর্য যে এই স্বল্পশিক্ষিত ফুফুই তলস্তয়কে উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ষোলবছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান, সেখানকার পড়াশোনার পাঠ না চুকিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তৃতীয় বর্ষে বাড়ি ফিরে আসেন। এর চারবছর পরে  সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখান এবং ককেশীয় অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর শৈশব নিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চাইল্ডহুড’ লিখেন। দু’বছর পর সেবাস্তোপলে বদলি হয়ে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে লড়াই করেন এবং  সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেন ‘স্টোরিজ অফ সেবাস্তোপল’। ১৮৬২ সালে তিনি প্রতিবেশি এক জমিদারের কন্যা সোফিয়া আন্দ্রিভনা বের্হসকে বিয়ে করেন। ওই বছরেই রাশিয়ার ধনী কৃষকদের জীবন নিয়ে লিখেন ’কসাকস’ উপন্যাস। তলস্তয় তাঁর বিয়ে পূর্ববর্তী প্রেম ও যৌনতার ঘটনাবলী নবপরিণীতা বধূকে নির্দ্বিধায় জানালেও বিয়ের প্রথম কিছু বছর তারা সুখেই কাটিয়েছিলেন। সোফিয়া তার ব্যক্তিগত সহকারী, প্রুফ রিডার ও ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তলস্তয়ের জীবনের প্রতি বৈরাগ্য ও র‌্যাডিকাল ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদের সম্পর্ককে ক্রমশ তিক্ত করে তোলে।

জমিদারপুত্র হয়ে প্রথম জীবনে তিনি নিজেও ভোগবিলাসে গা ভাসিয়েছিলেন, আর তা করতে গিয়েই টের পেলেন এর সারবস্তুহীনতা। রাশিয়ায় অভিজাত শ্রেণির বিলাসী জীবন তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন, ছিলেন তার ভিতরেই,  আর ছিলেন বলেই তাঁর রচনায় সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে সেসব তুলে আনতে পেরেছেন। আরাম-আয়েসের জীবন ছেড়ে সাদামাটা জীবনের প্রতি কেবল ঝুঁকেই এলেন না, সরল জীবনযাপনের মাহাত্ম্য সকলকে বোঝাতে থাকলেন। তাকে যে নৈতিক দার্শনিক বলা হয় তার কারণ, উপন্যাসিক মানুষটি ছিলেন বিভিন্ন মতবাদের উ˜্গাতা। সে সময়ে রাশিয়ায় দাসপ্রথা চালু ছিল, তিনি এর বিপক্ষে প্রচারণা চালালেন, ছিলেন পুজিবাদের বিরোধী। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি অনেক নীতিকথামূলক পুস্তিকা লিখেছেন ও প্রচার করেছেন। অর্থডক্স চার্চের বিভিন্ন ভুলত্রুটি প্রকাশ্যে তুলে ধরতে লাগলেন আর নিজের উদ্ভাবিত সহজ-সরল খ্রিস্টিয় ধারণা প্রচার করতে লাগলেন। এ কারণে ১৯০১ সালে অর্থডক্স চাচের্র বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ধর্ম-সর্স্পকিত তাঁর ধারণাসমূহ খ্রিস্টিয় মতাদর্শ আশ্রয়ী হলেও  তাতে বৌদ্ধধর্মের চেতনাই বেশি প্রতিফলিত। পুজিবাদ ও শোষণ বিরোধী সংগ্রামে তিনি অহিংস প্রতিবাদের কথা বলেছেন। এ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রবর্তক গান্ধীজি ও আমেরিকার কালো মানুষদের নেতা মার্টিন লুথার কিং। তলস্তয়ের ঞযব করহমফড়স ড়ভ এড়ফ রং ডরঃযরহ ণড়ঁ বইটি মহাত্মা গান্ধীকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, তলস্তয়কে তিনি অহিংস আন্দেলনের সবচেয়ে ‘বড় গুরু’ বলে স্বীকার করেছিলেন। আশ্চর্য নয় যে, দক্ষিন আফ্রিকায় গান্ধীজির আশ্রমটির নাম ছিল তলস্তয় কলোনি।  

জমিদারপুত্র হয়েও তাঁর লক্ষ্য ছিল আড়ম্বরহীন, সাদাসিধে জীবনযাপন করা; মৃত্যুর পর তাকে যেন সবচেয়ে সস্তা কফিনে সমাহিত করা হয়, নিকটজনদের তা বলে গিয়েছিলেন। পিতার জমিদারী যখন চার ভাইয়ের মাঝে ভাগ করা হয়, তিনি নিয়েছিলেন সবচেয়ে অনুর্বর অংশটি, যুক্তি হিসেবে বলেছিলেন তাঁর প্রয়োজন সীমিত, ওতেই চলবে। দুঃখী মানুষদের প্রতি আজীবন সহানুভূতিশীল মানুষটি সেই আমলে আশি হাজার রুবল দান করেছিলেন দুখবোর সম্প্রদায়কে, যে টাকা দিয়ে জাহাজ কিনে পুরো সম্প্রদায়টি অভিবাসী হয়ে কানাডা চলে গিয়েছিল। নির্যাতিত মানুষের প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ, শুভবোধের প্রতি পক্ষপাত আর দার্শনিক জিজ্ঞাসা তলস্তয়ের মনোভূমিতে মহৎ রচনার ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণির দায়িত্বজ্ঞানহীন, ইন্দ্রিয়পরায়ন জীবনচর্চ্চায় তাঁর বিবমিষা জাগে, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন আর তা থেকে মুক্তি পেতে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীর জীবনে গিয়ে লিখেন প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস চাইল্ডহুড (১৮৫২)। নিজের লেখা সম্পর্কে তলস্তয়ের গভীর সংশয় ছিল। পয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত তলস্তয় ঠিক করে উঠতে পারেন নি তিনি কী লিখবেন বা আদৌ তার লেখা উচিৎ কিনা। তুর্গেনেভকে চিঠি লেখেন, ‘আমি সাহিত্য-চর্চার যোগ্য নই, তাই লিখব না।’ নিজেকে রুশ সাহিত্যের অতীত আর তলস্তয়তে ভবিষ্যত আখ্যায়িত করে তুর্গেনেভ তলস্তয়কে লেখা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলেন, কেননা প্রতিভা চিনতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। শক্তিশালী ঔপন্যাসিক টমান মান চাইল্ডহুডকে  হোমারের ইলিয়াড-এর সমগোত্রীয় রচনা বলে উল্লেখ করেন। সন্নিকটবর্তী সময়ে বয়হুড (১৮৫৪) ও ইয়ুথ (১৮৫৬) লিখে তিনি আত্মজীবনীর ট্রিলজি সম্পূর্ণ করেন। আশ্চর্য যে, বেশিরভাগ ঔপন্যাসিক যেখানে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আত্মজীবনী লিখেন সেখানে তলস্তয়ের যাত্রা শুরু আত্মজীবনীর ট্রিলজি দিয়ে। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা এত বিপুল ছিল যে কাহিনী রচনায় অন্তত প্রথমদিকে তাকে কল্পনার আকাশে ভাসতে হয়নি। এ উপন্যাসে একজন জমিদার পুত্রের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বেড়ে ওঠা আর কৃষক প্রজাদের সাথে অবস্থানের দুস্তর ব্যবধানকে উপলব্ধী করার বর্ণনা রয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে তলস্তয় এ উপন্যাসত্রয়কে আবেগেভরপুর বলে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন, তবু তা একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার বিশ্বজনীন কাহিনীরই বিশ্বস্ত রূপায়ন।

সেবাস্তোপল স্টোরিজ ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণের নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাশিয়ার সাধারণ সৈনিকদের দুর্বিষহ জীবনের কাহিনী মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখা তলস্তয়ের প্রথম ছোটগল্পের সংকলণ। গল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল কনটেমপোরারি পত্রিকায়, রাশিয়ার সেন্সর বোর্ড তাতে কান্ডজ্ঞানহীন কাঁচি চালাচ্ছিল। তার পরেও তলস্তয়ের লেখা প্রশংসা কাড়ছিল বিখ্যাত সব লেখকদের। খ্যাতিমান কবি নেক্রাসভ এক চিঠিতে তলস্তয়কে লিখেছিলেন ‘তোমার লেখা হারিয়ে যাবে না ... তুমি যেভাবে সত্যকে সাহিত্যের অবিমিশ্র উপাদান করে তুলছ, তা আগে কখনোই ঘটেনি।’ রাষ্ট্রের সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার জার তা পড়ে অভিভূত হন, সম্রাজ্ঞীর চোখে কান্না চিকচিক করে ওঠে, আর তলস্তয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাশিয়ার বিদগ্ধমহলে।

কাউন্ট লিউ তলস্তয়ের সবচেয়ে আলোচিত দুটি উপন্যাস ওয়ার এন্ড পিস ও আনা কারেনিনা উনিশ শতকের রাশিয়ার জীবন ও মূল্যবোধকে সুগভীর ও সুবি¯তৃতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। বাস্তবধর্মী উপন্যাসের চূড়ান্ত শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে এ দুটি উপন্যাসে। ২০০৭ সালে পরিচালিত এক জরীপ অনুযায়ী সর্বকালের সেরা দশটি উপন্যাসের তালিকায় আনা কারেনিনা প্রথম আর ওয়ার এন্ড পীস তৃতীয়, অর্থাৎ সেরা দশের দুটিই তলস্তয়ের রচনা, তাও শীর্ষের। তলস্তয় কোন মাপের ঔপন্যাসিক তা বোঝাতে এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হচ্ছে ওয়ার এন্ড পিস। দস্তয়ভস্কি তলস্তয়কে জীবিত সকল লেখকদের ভিতর শ্রেষ্ঠ ভাবতেন। ওয়ার এন্ড পিস পাঠ করে ফ্লবেয়ার মস্তব্য করেছিলেন, ‘কী মহান শিল্পী, কী অসামান্য মনস্তত্ত্বিক!’ আন্তন শেখভের মূল্যায়ন ছিল যখন সাহিত্যের একজন তলস্তয় থাকে তখন লেখক হওয়া কতইনা সহজ ও সুখের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালের অনেক মহান লেখক- প্রাউস্ত, মান,  তলস্তয়কে বিশ্ব সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলে স্বীকৃতি দেন। ভার্জিনিয়া উলফ তাকে আখ্যায়িত করেন ঔপন্যাসিকদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে; জেমস জয়েস বলেন, তলস্তয় কখনোই নীরস, ক্লান্তিকর, জ্ঞানগর্ভমূলক বা নাটুকে নন। টমাস মানের মতে খুব কম সময়েই সাহিত্য অতখানি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক হতে পেরেছে।

ওয়ার এন্ড পিসকে দানবাকৃতির উপন্যাস বলা যায়; এতে প্রধান চরিত্রই আছে ৫৮০টি, যারা চারটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। বংশানুক্রমিক ও জটিল উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে ইতিহাস, নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের ঘটনা। উদ্ভাসিত কল্পনাশক্তির চূড়ান্তরূপসম্পন্ন বিপুলায়তন উপন্যাসটির ঘটনার শুরু তলস্তয়ের জন্মেরও আগে। প্রথম সংস্করণটি বেরুয় চার খন্ডে, ১৮৬৮ সালে; পরের বছর দ্বিতীয় সংস্করণে আরো দুটি খন্ড যুক্ত হয়। নিজের লেখা নিয়ে অসম্ভব খুঁতখুতে তলস্তয় বারংবার এর পরিমার্জনা, পরিবর্ধন করেন, সামনের ঘটনা পেছনে, পেছনের ঘটনা সামনে আনেন, ততোদিনে বিখ্যাত হয়ে ওঠা উপন্যাসের কোন কোন চরিত্রকে বদলে দিতে চান। আজকের দিনের কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে আমরা এই পরিশ্রমের মাত্রা বুঝতে পারবনা, কিন্তু  চারখন্ডে বিন্যস্ত ৮০০ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাসকে বারংবার পরিমার্জনা করা ও হাতে লিখে তার নতুন নতুন পা-ুলিপি তৈরিকে এখন অসাধ্য কাজ বলেই মনে হয়। এতে বোঝা যায় পরিশুদ্ধ রচনার প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট কত গভীর ছিল। এই গভীর নিষ্ঠার কারণেই তলস্তয়ের প্রস্তুতি ও সাধনা হয় অতিমানবিক।  তিনি ক্রমাগত পাঠ করে গেছেন রুশ ও বিশ্বসাহিত্য, অন্য ভাষার সাহিত্য মূল থেকে পাঠের জন্য সেসব ভাষা শিখেছেন। জগৎ যাকে গুলিয়ে ফেলে জুয়ারী, মাদকাসক্ত, নারীবিলাসী হিসেবে; বা দাঁড় করাতে চায় দার্শনিক, বিপ্লবী, ধর্ম-সংস্কারকদের কাতারে, তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয়Ñতিনি ঔপন্যাসিক। প্রথম দু’টি সংস্করণের উপর সমালোচকদের অনেক মন্তব্যকে বিবেচনায় এনে সংশোধন করেন,  সেসব বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা দাঁড় করান আর বিতর্কিত বিষয়সমূহকে বইটির পরিশিষ্টে ঠেলে দেন। ১৮৭৩ সালে তৃতীয় সংস্করণ বেরুয়, প্রথম সংস্করণের মত চার খন্ডেই; এই সংস্করণটিই আজ গৃহীত। মহাকাব্যের মত বিস্তৃত, অজস্র চরিত্র ও ঘটনার মিলিত কোলাজ, বিশাল প্রেক্ষাপটের বিস্ময়কর উপন্যাসটি লিখতে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর ব্যয় করেছিলেন।

ওয়ার এন্ড পিস রচনার কয়েক বছর পরে তিনি আনা কারেনিনা রচনায় হাত দেন এবং পরবর্তী তিন বছর ধরে সেটি লিখেন। পয়ত্রিশ থেকে বাহান্ন জীবনের এই ষোল-সতের বছর ছিল তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠসময়। আনা কারেনিনাকে ‘বিশ্বসাহিত্যের সর্বোত্তম প্রেমের উপন্যাস’ বলেছেন রুশ সাহিত্যের আরেক নক্ষত্র ভøাদিমির নবোকভ। এ দুটো সাড়াজাগানো সৃষ্টি ছাড়াও তলস্তয়ের অন্যান্য মহৎ রচনার ভিতর রয়েছে ইভান ইলিয়াচের মৃত্যু, পুনরুত্থান ও হাজী মুরাদ (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)।  ইভান ইলিয়াচের মৃত্যু নিয়ে ভøাদিমির নবোকভ খুবই আলোড়িত ছিলেন। উপন্যাসের পাশাপাশি তলস্তয়ের ছোটগল্পের বই আছে নয়টি আর রয়েছে তিনটি নাটক।

শেষজীবনে স্ত্রীর সাথে তাঁর প্রবল ঝগড়াঝাটি কেবল দু’জনের জীবনকেই অশান্তিপূর্ণ করে তোলেনি, তলস্তয়ের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে প্রচুর হাস্যরস জুগিয়েছে আর এই মহান সাহিত্যিকের জীবনের অন্য সকল কাহিনীর মতই সেসবও কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছে। স্ত্রীর ভুল-ত্রুটি, রূঢ় আচরণের বর্ণনা তিনি একটি ডাইরীতে লিখে রাখতেন, ডায়েরিটি জীবদদ্দশায় সঙ্গতকারণেই লুকিয়ে রেখেছিলেন, কেননা স্ত্রীর নজরে এলে ঘটত তুলকালাম ঘটনা। মজার ব্যাপার হল, তাঁর স্ত্রীও একটি ডায়েরি লিখতেন, যাতে তিনি তলস্তয়ের দুর্ব্যবহারের বিশদ বিবরণ লিখে রাখতেন। দু’টি ডায়েরিই প্রকশিত হয়েছিল তাদের মৃত্যুর পরে। বিখ্যাত হলে ব্যক্তিগত জীবনের কিছুই যে আর লুকানো থাকেনা লিউ তলস্তয় তার বড় উদাহরণ। স্ত্রী সোফিয়াকে প্রচ- ভালবাসতেন তলস্তয়, কিন্তু সম্পর্কের তিক্ততা এতটাই তল ছুঁয়ে গিয়েছিল যে মৃত্যুসন্নিকটবর্তী  জীবনের শেষদিনগুলোয় তিনি চাইতেন না স্ত্রী এসে তাকে দেখে যাক। অভিমান করেই বাড়ি ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে বেশিদূর যেতে পারেননি, নেমে পড়েছিলেন আস্তপোভা নামক এক ছোট্ট রেলস্টেশনে, যেখানকার স্টেশনমাস্টার ছিলেন তলস্তয়ের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। এই  ভক্তের বাড়িতেই ৮২ বছর বয়সে এ মহান প্রতিভার শেষপ্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি তাঁর সকল সম্পদ ও ঐশ্বর্য ত্যাগের এবং  বৈরাগ্যের পথ অবলম্বনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে আজীবন লালিত দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেন।  তলস্তয়ের জীবনের ঘটনাবহুল শেষ বছরটি নিয়ে গতবছর ‘দ্য লাস্ট স্টেশন’ নামে একটি চলচিত্র নির্মিত হয়েছে।

তলস্তয় কেবল বিখ্যাত ছিলেন না, ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য। মৃত্যুর একশ বছর পরেও সে কিংবদন্তী ম্রিয়মান না হয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে চলেছে। কেবল রাশিয়ার ঔপন্যাসিকদের নন, তিনি প্রভাবিত করেছেন বিশ্বের সকল মহৎ ঔপন্যাসিককে। তাঁর রচিত উপন্যাসের আখ্যান মেনে রচিত হয়েছে অজস্র উপন্যাস। আগে যেমন ছিল প্রথমে চরিত্রের বর্ণনা, পরে পরিবেশের বর্ণনা, অবশেষে ঘটনার বর্ণনা- উপন্যাসের এই চিরাচরিত রীতি ভেঙ্গে তলস্তয় তৈরী করেন ঘটনা বর্ণনার সাথে সাথে চরিত্র ও পরিবেশ বর্ণনার নতুন আঙ্গিক। তাঁর দুটি মহৎ উপন্যাস ওয়ার এন্ড পীস ও আনা কারেনিনা - উপন্যাস রচনার দুটি আলাদা আঙ্গিক তৈরী করে দিয়েছিল - যা অনুসরণ করেছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ঔপন্যাসিকেরা। আর কোন কারণে না হলেও শুধু এ কারণেই তলস্তয় প্রবাদপ্রতিম বা কিংবদন্তীতুল্য হতে পারতেন।