![](http://banglamati.net/thumbs/zoom/1592272356..jpg)
আরামবাগের আনন্দ প্রিন্টার্স তখন আমাদের নিত্য আড্ডাস্থল। লালমাটিয়া কর্মস্থলের ৯টা-৫টার খোয়াড় থেকে বেরিয়েই অনিবার্যভাবে আমি ছুটে যেতাম সেখানে। সুস্বাদু আলুপুরি-কাবাব ছাড়াও আমার জন্যে অপেক্ষা করতো কখনো মোস্তফা জব্বার ভাইয়ের (বর্তমানে মাননীয় মন্ত্রী) আর কখনো-বা তাঁর অনুজ আমার অকৃত্রিম বন্ধু রাব্বানী জব্বারের সহৃদয় হাসিমুখ অভ্যর্থনা। সেই আড্ডা তখন গমগম করতো আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কমান্ডার আবদুর রউফ, ছাত্রনেতা শাহ আলম, নূরুল ফজল বুলবুল, কামাল হোসেন, শহীদ সেরনিয়াবাত, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, মোজাম্মেল বাবুসহ বহু তরুণ-প্রবীণের সরব পদচারণায়।
তো কোনো এক ছুটির সকালে সেখানেই সদ্য বাঁধাইকৃত বইটি আমি পেয়ে যাই অপ্রত্যাশিতভাবে। তখনো অবশ্য আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে কী রত্ন আমার হস্তগত হয়েছে! স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ও অভিজাত ব্যক্তিত্বের কবি হিসেবে সিকদার আমিনুল হককে দূর থেকে চিনি। তাঁর কবিতা পড়ি। কিন্তু বইটি প্রথমেই আমাকে আকর্ষণ করে তার দুর্দান্ত মুদ্রণ সৌকর্যের জন্যে। আকৃতি শুধু নয়, বইটির কাগজ থেকে শুরু করে অঙ্গসজ্জা পর্যন্ত সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিল সেই অভিনবত্ব। প্রতিটি কবিতার শুরুতে খালিদ আহসানের চাররঙা চিত্রকর্ম তাতে যুক্ত করেছিল নতুন মাত্রা। তখন পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) কবিতার বইয়ের এ মানের প্রকাশনা বাংলাদেশে খুব একটা হয়নি বললেই চলে।
সিকদার আমিনুল হক অত্যন্ত ভালো কবি-এ কথা আজ প্রায় সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু মৃত্যুর (১৭ মে ২০০৩) আগেও দেখেছি পা-ুলিপি নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু প্রকাশক সোনার হরিণ! তো বন্ধু হিসেবে তাঁর এ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সাপ্তাহিক সন্ধানী ও দৈনিক ভোরের কাগজ-এর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বেনজির আহমেদ। তিনি তখন ‘মূলধারা’ নামে যে প্রকাশনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-তার পক্ষে প্রকাশক হিসেবে সাবের হোসেন চৌধুরীর নাম ছাপা হয়েছিল। গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছিল আনন্দ প্রিন্টার্স থেকে। যে-কপিটি আমার হস্তগত হয়েছিল সেটি ছিল ‘প্রেসকপি’ সীলযুক্ত।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে এলোমেলোভাবে বইটি আমি পড়তে শুরু করেছিলাম। তারপর মুহূর্তের জন্যেও বইটি হাতছাড়া করিনি। জীবনে সম্ভবত প্রথমবার মালিকের বা কর্তৃপক্ষের অগোচরে বইটি ব্যাগে ঢুকাই। অনেকদিন পর শুধুই কবিতার সম্মোহনে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমি একটি নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করি এবং তা আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে আমি একটি দীর্ঘ রচনা লিখে ফেলি দিন দশেকের মধ্যে। সিকদার আমিনুল হকের যে বিরল বন্ধুত্বকে আমি আমার জীবনের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচনা করি তার সূত্রপাত এই বইটিকে ঘিরেই।
কবিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পা-িত্যের নয়, নিখাদ ভালোবাসার। সেই ভালোবাসার অধিকার নিয়েই অসঙ্কোচে আমি বলতে চাই যে ‘সতত ডানার মানুষ’ শুধু সিকদার আমিনুল হকের নয়, বাংলা সাহিত্যেরও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র
ঢাকা: ১৬ মে ২০২০