করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





আন্ডারগ্রাউন্ড—সিস্টেম অ্যান্ড দ্য গ্রোটেস্ক ট্রুথ ইনসাইড?
আশরাফুল আলম শাওন
“...দেখার এটাও বাকি ছিল না যে, এই খুনে প্রান্তরে একদিন কোনো না কোনো এক বাঁকা ধরনের ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার অপরাধে কাউকে কানে ও পায়ে বেদম মারা হবে, আর সেই ব্যঙ্গচিত্রের জন্য একটা বাঁকা ধরনের ক্যাপশন লেখার অপরাধে আরেকজনকে পিটিয়েই পৃথিবীছাড়া করা হবে..." (পৃষ্ঠা: ২০৩)
কিছুদিন আগে আমি বনে-জঙ্গলে ঘুরতে গেছিলাম, আর আমার সাথে ছিল দুইটা বই। সাথে করে নিয়ে গেছি। শুধু শেষ দশ পৃষ্ঠা বাকি ছিল বলে, এবং সেই দশ পৃষ্ঠা শেষ করার জন্য ছিল ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন- দ্য ওসেজ মার্ডারস অ্যান্ড দ্য বার্থ অব এফবিআই‘। ডেভিড গ্রানের লেখা, সত্য ঘটনার বিবরণ—১৯২০ এর দশকে আমেরিকার ওকলাহোমাতে তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী গোত্র, নেটিভ ওসেজ পিপলদেরকে সিরিজ খুন ও তাদের বিরুদ্ধে বিরাট এক চক্রান্তের কাহিনী; যে-বই থেকে মার্টিন স্করসেসি বানাচ্ছেন তার পরের সিনেমা। আর ছিল, আরো একবার, দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস‘। যেহেতু ওই সময় থাকব পানির উপরে কয়েক রাত, কয়েক দিন, এবং গহীন বন-জঙ্গলের ভিতরে, তাই হার্ট অব ডার্কনেসের ভিতরে ঢুকেই ‘হার্ট অব ডার্কনেস‘ পড়ার এই সুযোগ আমি ছাড়তে চাই নাই, কোনোভাবেই। কিন্তু এমন এক ভয়ানক বিপদের মধ্যেই পড়েছিলাম যে, তখন, ওই বন-জঙ্গলের গহীনে আমার কোনোটাই পড়া হয় নাই—না নেটিভ ওসেজদেরকে মার্ডার করার শেষটুকু, না ‘হার্ট অব ডার্কনেস‘। আর পরে মনে হয়েছে যে, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি নিজেই লিখে ফেলতে পারব কিছু একটা—‘হার্ট অব ডার্কনেস টু (২)‘ নাম দিয়ে।
ফিরে আসার পরে তাই পড়তেছিলাম যেমন ‘হার্ট অব ডার্কনেস‘, আর আমি ছিলাম সেই জায়গায়—যখন মার্লোর অপেক্ষা প্রায় শেষ—তার এতদিনের প্রতীক্ষা—সে তার স্যালভেশনের কাছাকাছি, কার্টজের সাথে তার দেখা হবে, তখন আমি সেটা থামিয়ে মাসরুর আরেফিনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘ পড়া শুরু করলাম, যেহেতু আমি জানিই ‘হার্ট অব ডার্কনেস’-এ কী আছে এরপরে, এবং যেহেতু ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নতুন ও বাংলা ভাষার উপন্যাস। আমার এই প্রেফারেন্স বা আগ্রহই আমাকে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ নিয়ে গেল।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পড়া শেষ। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নিয়ে আমি কিছু বলব এবং চেষ্টা করব স্পয়লার ছাড়া বলতে, যেহেতু সাম্প্রতিকতম উপন্যাস, স্পয়লার হয়ত কারো কারো এই উপন্যাস পড়ার আনন্দটাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘ প্লটভিত্তিক ও সম্পূর্ণভাবেই কাহিনী-নির্ভর উপন্যাসগুলির মতো না। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ শক্ত প্লট আছে, কাহিনীও আছে, তবে শুধু সেই কাহিনী দিয়েই আপনাকে এন্টারটেইন করা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর উদ্দেশ্য না। আন্ডারগ্রাউন্ডের উপন্যাসের ভিতরের গল্প, সেই গল্পের রিয়েলিটি কখনো হাইপাররিয়ালিটির দিকে যেতে চায়, আবার কখনো মনে হয় আনরিয়াল একটা বাস্তবতার মধ্যে আছে এই উপন্যাসের চরিত্ররা। অথচ সবকিছু ঘটছে পৃথিবীর এই রিয়ালিটিতেই, এই পৃথিবীরই একটা শহরে, রাশিয়ার মস্কোতে। কিন্তু এটা ঘটতে পারত যেকোনো শহরেই, তাতে হয়ত এই উপন্যাসের চরিত্রদের ভাগ্যের পরিবর্তন ও গল্পের গন্তব্যের পরিবর্তন খুব একটা হতো না। কারণ, এই উপন্যাসেই দেখানো হইছে, পৃথিবীর সব শহরে বা সব জায়গায় যা হয়, যে-ফেব্রিক দিয়ে পৃথিবীর ওভারগ্রাউন্ডে সব ঘটনা তৈরি হয়, তার সবকিছু প্রসেস হয়ে আসে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে। এবং পৃথিবীর সেই আন্ডারগ্রাউন্ড কমন, একটাই—সেখানে রাশিয়ার ভলগা বা আমাদের এখানকার কহরদরিয়া বা তুরাগ নদের মধ্যে কোন ভৌগলিক দূরত্ব নাই।
তবে আমার মনে হইছে, মস্কো পটভূমি হিসাবে আসছে দুই কারণে। একটা কারণ, কবি ওসিপ মান্দেলশতাম। আরেকটা কারণ, বিপ্লবের পরে কী হবে?—এই প্রশ্নের উত্তর বা বিপ্লবের পরে প্র্যাক্টিকালি কী হয় সেটা দেখানোর জন্য অক্টোবর বিপ্লব ও তার পরের স্তালিন আমলকে উদাহারণ হিসাবে আনা।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ শুরু হওয়ার পরে গল্প স্মুথলি দ্রুত আগাতে থাকে, এবং খুব দ্রুতই স্পষ্ট হয় যে, এখানকার মূল চরিত্র খুব একটা সুখী মানুষ না। সে ডিস্টার্বড। পরে দেখা যায় যে, উপন্যাসের সব চরিত্রই আসলে ডিস্টার্বড। বোঝানো হয় যে, পৃথিবীতে সবাই ডিস্টার্বড কোনো না কোনোভাবে, যে সিস্টেম চালায় সেও, এবং যে সিস্টেমের ভিক্টিম হয় সেও। যে ভায়োলেন্স করে সেও, আর যে ভায়োলেন্সের শিকার- সেও।
মাঝে মাঝে গল্প অতীতে চলে যায়, সেই অতীত ডার্ক, অনেকটা ভায়োলেন্ট এবং সেখান থেকে বাউন্স খেয়ে আবার বর্তমানে ফিরে আসে। বাউন্স করতে করতেই, মূল চরিত্রের শৈশবের ভয়ানক এক ঘটনা, ভয়ানক এক প্রতিশোধের ঘটনা সামনে আসে, একটা পুকুর ঘেরাও করে একটা মবের হাতে একজনের খুন হওয়ার ঘটনা, ডিটেইলে।
গল্প একটা সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে পড়ে, আর সেই আন্ডারগ্রাউন্ড পরাবাস্তব নাকি অধিবাস্তব আল্লাহ-ই জানে—সাংঘাতিক উদ্ভট সেই জগত, স্বাভাবিকতার কোনো সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে না।
সেই আন্ডারগ্রাউন্ডে দেখা হয় আরো উদ্ভট কিছু ক্যারেক্টারের সাথে—জেনারেল ফ্লাশটারমেইশটার, অনেক হিজড়া, ওলগা, হুগো বোগলি, বুলডগ, ভ্রুকুস, নগুয়েন লাম খ্যাকসেয়াল এবং পরিচিত অপরিচিত আরো অনেকের সাথে। মনে হইছে, এই চরিত্ররা সব কোনো ফ্যান্টাসি উপন্যাস থেকে উঠে আসা প্রাচীন সব চরিত্র। এই আন্ডারগ্রাউন্ডের জগতের মাধ্যমেই লেখক একটা মোর দ্যান পলিটিক্যাল সত্য বলতে চাইছেন, যেটা এই উপন্যাসের মূল বক্তব্যগুলির একটা—সবকিছুই, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, বিপ্লব ,এমনকী এই আন্ডারগ্রাউন্ডও সিস্টেমের একটা অংশ এবং সিস্টেম ইটসেলফ—আর সেই সিস্টেম নিজের প্রয়োজনেই, নিজের নিয়ন্ত্রণেই ঠিক করে দেয় কখন বিপ্লব হবে, আর বিপ্লব শেষে আবার রাষ্ট্র তার নতুন ক্ষমতাসহ ফ্যাসিস্ট ও ভয়ানক হয়ে উঠবে।
আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসার পরে উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্রদের আচরণের স্বাভাবিকতার যে কমফোর্ট সেইটা আর থাকে না। প্রথমে আমার খটকা লাগে কয়েকবার। পরে বুঝতে পারলাম, এই অস্বাভাবিকতা, অ্যাবনর্মালিটি, ডিসটার্বেন্স—সব ইনটেনশনাল, সব লেখকের ইনটেনশনাল। তকদীরভ, শিভারভ, কিরিল, মারা ভোরহিস, দিমিত্রি, তাদের অস্বাভাবিক, বিচিত্র ও ভয় জাগানিয়া আচরণ—আর মিউজিয়ামের ভিতরে যা যা হয়—সব একটা জিনিসকে স্পষ্ট করার জন্যই—সিস্টেমের ফাংশন, সিস্টেমের ভিতরের ভয়ানক ডিসটার্বেন্স।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে দুইটা ভয়ানক সুন্দর ক্যারেক্টার আছে। মিকি—সেই মিকি সানগ্লাস পরা কুকুর নাকি বাঘের মত বিড়াল নাকি মানুষ নাকি পৃথিবীতে টিকে থাকা এলিটিজম ও সমস্ত অভিজাততন্ত্রের সিম্বল, আমি জানি না। আর আছে সেবাস্তিয়ান—এক প্রানী, আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্যারেক্টার। সেবাস্তিয়ান অনেকটা টলকেইনের ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ মহাকাব্যিক ফ্যান্টাসি উপন্যাসের গোল্লামের মত—কোথা থেকে হঠাৎ উদয় হয় আর কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
চেখভের প্রতি সুন্দর ট্রিবিউট আছে উপন্যাসে—বিশেষ করে চেখভের ‘দ্য লেডি উইদ দ্য লিটল ডগ’ গল্পের হোটেল রুমে তরমুজ খাওয়া দৃশ্যটার মাধ্যমে। এবং আমারও তরমুজ খাওয়া হইল এই উপন্যাস পড়াকালীন সময়ে—পাঁচদিনে তিনটা হয়ত—নট ফর চেখভ, নট ফর ট্রিবিউট, নট ফর দিস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস; পুরাটাই সিজনাল।
আর এখানে বিশালভাবে আছেন রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলশতাম, একটা লিটারারী জার্নি হিসাবেও আছে, রাষ্ট্র-ক্ষমতা, অথোরিটেরিয়ানিজম, ফ্যাসিজমের ফাংশন দেখানোর জন্যও আছে। ফ্যাসিজমের দমন-পীড়ন-অত্যাচার কতটা নীচে নামতে পারে, সেটা ওসিপ মান্দেলশতামের জীবনকাহিনির মধ্যেই আছে। এবং এই জিনিস রিপিটেটিভ বারবার ঘটানোই হয়তো রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও সিস্টেমের নিয়তি।
সেটা ওসিপ মান্দেলশতামের বেলায় যেমন হয়েছিল, মৌরিতানিয়ার মোহাম্মেদুউ স্লাহি—তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছাড়াই যে দীর্ঘ ১৪ বছর জর্ডানের বাগরাম ও গুয়ান্তানামো বে-তে বন্দী ছিল আর ছিল দোযখ-যন্ত্রণার অত্যাচারের মধ্যে—তার বেলায় যেমন হয়েছিল, অথবা, আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসের মূল চরিত্র যেমন বলে: “...দেখার এটাও বাকি ছিল না যে, এই খুনে প্রান্তরে একদিন কোনো না কোনো এক বাঁকা ধরনের ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার অপরাধে কাউকে কানে ও পায়ে বেদম মারা হবে, আর সেই ব্যঙ্গচিত্রের জন্য একটা বাঁকা ধরনের ক্যাপশন লেখার অপরাধে আরেকজনকে পিটিয়েই পৃথিবীছাড়া করা হবে...”—এই সবকিছুর উৎস ও কনসিকোয়েন্স একই। এই সবকিছুই বিলং টু দ্য সেইম ফাংশন, সেইম সিস্টেম, সেইম উদ্দেশ্য। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ এই কথাটাও এবং এই কথাটাই বলা হইছে, এইটাই ওভারগ্রাউন্ডের সত্য।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পলিটিক্যাল, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে, পোস্টমডার্ণ পলিটিক্যাল উপন্যাস, যেখানে কোনো কিছুই আর মডার্নিটির কমফোর্ট জোনের ভিতর নাই । বিপ্লবের পরে কী হবে—বিপ্লবের পরেও রাষ্ট্রের সেই একই ক্ষমতা, নতুন হাতে—আরো বেশি ক্ষমতা এবং সেটা মানেই রাষ্ট্র আরো ফ্যাসিস্ট—‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ এই সত্যটা বলার পরেও লেখক বা মূল চরিত্র অরাজনৈতিক বা প্রতিবিপ্লবী কোনো অবস্থান নেন না। সিস্টেম থাকলে তার বিরুদ্ধে ফাইটও থাকবে, যতই ক্যাওস আর সহিংসতা থাকুক—এই কথাটাও আসে আরো ড্রামাটিকভাবে, লিটারারী জার্নির শেষ ক্লাইম্যাক্স হিসাবে নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস’-এর শেষ লাইন দিয়ে: “...যখন সামনে ভবিষ্যত অন্ধকার ঠিকই কিন্তু তারপরও খেলা চলবে আর আমরা বলতে গেলে প্রায়”
দাঁড়ি বা ফুলস্টপ ছাড়াই, কোনো চূড়ান্ত যতিচিহ্ন ছাড়াই, উপন্যাস শেষ।
এটা কোনো সমালোচনা বা সেই অর্থে বিশ্লেষণ জাতীয় কিছু ছিল না। ছিল আমার শেষ করার পর ইনিশিয়াল রিঅ্যাকশন বা নোটস। আই লাভড ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘, আই লাভড ইট।