করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





কাজানজাকিস: আধুনিক গ্রিক সাহিত্যের প্রধান কণ্ঠস্বর
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
বাঙালি পাঠকের কাছে গ্রিসের এই মহাকবি ও ঔপন্যাসিক অনেকটা অপরিচিত হলেও গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় নিকোস কাজানজাকিস ছিলেন রীতিমতো বিস্ময় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক। তাঁর মহাকাব্য অডিসি : এ মডার্ন সিক্যুয়েল-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে তা ওই সব দেশের বিদগ্ধ মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করে। হোমারের অডিসির তিনগুণ বড়, তেত্রিশ হাজার তিনশো তেত্রিশ পঙ্ক্তির এবং এক একটি পঙ্্ক্তি সতেরো সিলেবলের এই বিশাল সাহিত্যকর্ম অনবদ্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মার্কিন কবি কিমন ফ্রায়ার। এর পরই শুরু হয় তাঁর বৃহদায়তন উপন্যাস রচনার পালা।  জোরবা দ্য গ্রিক, ফ্রিডম অর ডেথ, ক্রাইস্ট রি-ক্রুসিফাইড (গ্রিক প্যাশন), লাস্ট টেম্পটেশন, সেন্ট ফ্রান্সিস ইত্যাদি একরে পর এক উপন্যাস প্রকাশতি হয় এবং সেগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লিরিক, ছোটগল্প ইত্যাদি ছোট রচনায় আগ্রহ তাঁর কম ছিল বলেই মনে হয়। “মারি তো গ-ার, লুটি তো ভা-ার” পণ করেই সম্ভবত কাজানজাকিস সাহিত্যকর্মে অবতীর্ণ হন এবং সৃষ্টি করেন এক একটি বিস্ময়।
রপর্িোট টু গ্রকেো কাজানজাকিসের আত্মজীবনী, বলা হয় আধ্যাত্মকি আত্মজীবনী এবং তাঁর শষে রচনা। ইউরোপীয় রেনেসাঁর একজন অন্যতম চিত্রকর, ভাস্কর ও স্থাপত্যশিল্পী, এবং কাজানজাকিসের জন্মভূমি ক্রিটের কৃতী সন্তান এল গ্রেকোকে (১৫৪১-১৬১৪) পিতৃপুরুষ বিবেচনা করে জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কাজানজাকিস তাঁর কাছেই নিজের কৃতকর্মের একটি হিসাব দাখিল করছেন। গ্রন্থ শেষের এপিলোগ বা যবনিকায় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে এল গ্রেকোকে একটি দীর্ঘ কবিতাও উৎসর্গ করেছেন। বস্তুত এই আত্মজীবনীর পুরোটাই এল গ্রেকোকে নিবেদিত। গ্যেয়টে বলতেন, “উত্তরসুরির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ কিছু রেখে যেতে চাও তো জীবনের স্বীকারোক্তি লেখ।” কাজানজাকিস তাঁর এই শেষ এবং বহুলাংশে অপরিশুদ্ধ সাহিত্যকর্মে নিজের দৈহিক, মানসকি, এবং সমানতালে আধ্যাত্মিকভাবে বেড়ে ওঠার সেই কাহিনিই বয়ান করেছেন।
তাঁর জীবনাদর্শেও এই দুই আপাতবিরোধী বিষয়- দেহ ও আত্মাকে কাজানজাকিস সমান গুরুত্ব দিতেন। মানবজীবনে, প্রকৃতিতে, বিশ্ব ব্রাহ্মা-ে সর্বত্রই দ্বান্দ্বিকতা একটি অবশ্যম্ভাবী সৃজনশীল ধারা। জন্ম-মৃত্যু, আত্মা-দেহ, ঈশ্বর-শয়তান, আলো-অন্ধকার, এ্যাপলো-ডাইওনিসাস, গ্রিস-তুরস্ক ইত্যাদির সহ অবস্থানকে কাজানজাকিস বিরোধ হিসেবে দেখেন নি, বরং মরমি সাধকদের মত পরস্পরের পরিপূরক হিসেবেই দেখেছেন। বস্তুত কাজানজাকিসের নিজের জীবনও ছিল বহুলাংশে ডাইওনিসিও বিশৃঙ্খলা ও অ্যাপলোনীয় সংযমের, বিপরীতধর্মী শক্তির টানাপোড়েনে সমৃদ্ধ। অডিসি: একটি আধুনিক উত্তরকা-র ভূমিকায় কিমন ফ্রায়ার লিখেছেন যে কাজানজাকিসের এই মহাকাব্যের নায়কের চরিত্রে যত দোদুল্যমানতা আর বৈপরীত্যের সমাহার তার সবই কাজানজাকিসের নিজের জীবনেও ছিল বিদ্যমান। ব্যক্তিজীবনে তিনি অন্তর্মুখী, স্বল্পবাক, স্বল্পাহারী, কিন্তু বিপরীতধর্মী মানুষের চরিত্র সৃষ্টিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পিতৃ পিতামহ এবং তাদের বহুসংখ্যক নাতিপোতার চরিত্র আঁকতে পছন্দ করতেন যদিও নিজে ছিলেন নিঃসন্তান; গ্রিসের প্রতি বিশেষ করে জন্মভূমি ক্রিটের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালবাসা এবং দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ, যদিও জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন দেশের বাইরে ভ্রমণ কিংবা অবস্থান করে; মানবতার প্রতি সহমর্মিতা বোধ করতেন, কিন্তু ব্যক্তি মানুষকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। বুদ্ধের ত্যাগ, খ্রিস্টের আত্মোৎসর্গের প্রতি সশ্রদ্ধ হলেও অন্যায় অবিচার সহিংসতা বর্বরতাকেও জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এইসব বৈপরীত্যের মধ্যে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে তাঁকে নৈতিকতার প্রশ্নে নিরপেক্ষ হতে হয়েছে। এই নৈতিকতা-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর প্রধান দুই চরিত্র জোরবা এবং অডিসিয়াসেরও। কাজানজাকিস বিশ্বাস করতেন জীবনকে এভাবে অনুভব করেই ব্যক্তি একটি মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে। তাঁর নায়কদের ভেতর তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বৈপরীত্যর দোলাচলের সহাবস্থান এবং শক্তি। ফাউস্ট যেমন একপেশে জ্ঞানী, দন কিহোতে যেমন একরোখা গোঁয়ার, হ্যামলেট দোলাচলের মাত্রাতিরিক্ত টানাপোড়েনে নিষ্ক্রিয়- অডিসিয়াস কিন্তু এদের কারো মতনই নয়। এদের চরিত্রের কিছু কিছু উপকরণ নিয়ে সে আধুনিক একজন মানুষেরই ইতিবাচক প্রতিকৃতি। জীবন ও জগৎ দেখার এই দৃষ্টিকেই কাজানজাকিস বলছেন ক্রিটের নজর বা তৃতীয় নয়ন। জীবনের সর্বাপ্লুত অর্থহীনতার পটে এইসব বৈপরীত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর অসম্ভব ও নিরন্তর প্রচেষ্টাই হয়ত ব্যক্তিজীবনকে কিছুটা সার্থকতা দিয়ে থাকে।    
অডিসি: এ মডার্ন সিক্যুয়েল-এর ভূমিকায় কিমন ফ্রায়ার কাজানজাকিসের “আমার বিশ্বাস” শীর্ষক লেখা থেকে যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেন তাতে কাজানজাকিসের দ্বান্দ্বিক দর্শনের সারকথাই প্রকাশ পেয়েছে:

প্রথম যৌবন থেকেই আমার ভেতর মাংস ও আত্মা নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলত। আমার মধ্যে ছিল আদিম, প্রাক-মানবিক অন্ধ লালসার সৈন্যদল; আমার আত্মার পাটাতনে নিরন্তর রত ছিল তারা মল্লযুদ্ধে। আমার মনে হতো, হায় যদি এই দুটোর একটা জিতে যায় এবং অন্যটাকে একেবারে শেষ করে দেয় তো আমিও যাব শেষ হয়ে কারণ দেহকে আমি ভালবাসতাম এবং সে ধ্বংস হোক তা চাইতাম না কখনই। আবার আমার আত্মাকেও ভালবাসতাম এবং চাইতাম না সে অধঃপাতে যাক। এজন্য আমি কসরত করতে থাকি কি করে এই দুই সর্বজনীন দ্বান্দ্বিক শক্তির ভেতর বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায় এবং তারা ভাবতে থাকে যে তারা পরস্পর শত্রু নয়, বরং সহযোদ্ধা; এবং এভাবে তারা শেষ পর্যন্ত পরস্পরকে চিনতে পেরে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, এবং তখন আমিও ওদের মেলবন্ধনে উল্লসিত হই।
এই দুয়ের যুদ্ধ আমার ভেতর চলেছিল বহু বছর। বিভিন্ন পথ আমি অনুসরণ করি যেন মুক্তির একটা দিশা পাই: ভালবাসার পথ, বিজ্ঞানের কৌতূহলের পথ, দার্শনিক অনুসন্ধানের পথ, সামাজিক পুনর্জন্ম, এবং শেষে কবিতার নির্জন, বন্ধুর পথও অনুসরণ করি। কিন্তু যখন দেখি সব পথই নিয়ে যায় এক অন্ধকার গুহামুখে, ভয়ে তখন কাঁপতে থাকি এবং ফিরে এসে অন্য পথ ধরি। এই সব পথচলা, এই সব হরদম হতাশায় ঢলে পড়া চলে আমার বহু বছর। শেষে নিরুপায় হয়ে আমি চলে যাই গ্রিসের আথোস পর্বতমালায়, গয়িে সেখানে আশ্রয় নিই আশ্রম।ে সেখানে কোনো নারীর পদচারণা ঘটেনি, সেখানে হাজার বছর ধরে সহস্র সন্ন্যাসী, ভিক্ষু, যাজক প্রার্থনা আর সাত্ত্বিক ধ্যানাভ্যাসের সোপানে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। সমুদ্রের অনেক উঁচুতে সেখানে পূতপর্বতের নির্জনতায় প্রাচীন সন্ন্যাসীর আশ্রমে আমার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। প্রথমে আত্মার আদেশ মানতে আমি শরীরকে প্রস্তুত করি। মাসের পর মাস শরীরকে দেখাই কি করে ঠান্ডা সহ্য করতে হয়, কি করে ক্ষুধাতৃষ্ণা তন্দ্রাহীনতা এবং প্রতিটি দৈহিক বালাই, উপসর্গ সহ্য করতে হয়। এরপর ফিরি আত্মার দিকে: কষ্টকর ধ্যানে ডুবে আমি নিজের মধ্যকার ছোটখাটো ভাবাবেগ জয় করতে থাকি, সহজ গুণ, সস্তা আধ্যাত্মিক আনন্দ, সহজ, সুবিধাজনক আশাভরসা জয় করতে শিখি; শেষে একদিন রাতের বেলা মহা আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠি কারণ সে-রাতে আমি দেখেছি এক যোদ্ধার আরোহণের পথ। দেখেছি সে উঠে যাচ্ছে এবং পেছনে ফেলে যাচ্ছে, মানুষের বসতরি ভেতর ফেলে যাচ্ছে লাল ফিতে। তখন সারা ব্রহ্মা-ে পরিষ্কার দেখতে পাই তার রক্তাক্ত পদরেখা- অজৈব বস্তু থেকে জীবনের আরোহণের পথে সে উঠে যাচ্ছে এবং সেখানে উঠে জীবন ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে চলেছে সে আত্মার পথে।
তখন হঠাৎ করেই আমার মধ্যে এক দীপ্ত আলোর অভ্যুদয় ঘটে : বস্তুর রূপান্তর ঘটে আত্মায়। এখানেও সেই মহারহস্য, দেখি সেই লাল ফিতের চিহ্ন ধরে হাঁটছে সেই যোদ্ধা। সে যদিও অজৈব বস্তু থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে এবং উদ্ভিদের জীবন্ত প্রাণিসত্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার হঠাৎ মনে হল তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এজন্য সে জীবসত্তায় লাফিয়ে পড়ে বস্তুকে ক্রমাগত আত্মায় রূপ দিতে থাকে। কিন্তু আবার তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে; তখন সে সমসাময়িক নর-বানরের শরীরে লাফিয়ে পড়ে। এই নর-বানরকে আমরা সময় পোক্ত হবার আগেই নাম দিয়েছি ‘মানুষ,’ আর এখন সে নর-বানর থেকে পালাতে সংগ্রাম করছে কারণ সে পালিয়ে সত্যিকারের মানুষ হতে চায়। আমি স্পষ্ট দেখলাম সইে অদৃশ্যর অগ্রগতি এবং হঠাৎ বুঝলাম আমার কর্তব্য কী- হ্যাঁ, যোদ্ধার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা, রূপান্তর ঘটানো, নিজের ক্ষুদ্র শক্তিতে বস্তুকে রুহে রূপান্তর করা, কারণ মাত্র তখনই আমি মানুষের সর্বোচ্চ প্রয়াসের স্তরে পৌঁছতে পারব, আর কি সইে প্রয়াস? সে হল ব্রহ্মা-ের সঙ্গে মহা মেলবন্ধনে মিশে যাওয়ার প্রয়াস।
আমি খুব গভীরভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করি এবং মুক্ত হই। ব্রহ্মা- আমি পাল্টাইনি- সেটা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়- কিন্তু নজিরে দৃষ্টি তো আমি পাল্টিয়েছি, যে দৃষ্টিতে জগতসংসার দেখি তা পাল্টেছি। আর তখন থেকেই আমি কসরত করে চলেছি- প্রথমে সচেতনভাবে আশঙ্কা উদ্বেগ নিয়ে; এরপর ক্রমে ক্রমে অবচেতনে কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়া চেষ্টা করেছি এমন কিছু না করতে যা মহাযোদ্ধার ছন্দের সঙ্গে বেতাল হয়। তখন থেকে কোনো বেহায়া কাজ করতে, মিথ্যাচার করতে, ভয়ভীতি দ্বারা আপ্লুত হতে আমার লজ্জা করে। কারণ, আমি জানি বিশ্বের অগ্রযাত্রায় আমারও রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। এখন আমি কাজ করি, চিন্তাভাবনা করি বেশ নিশ্চিতভাবে। কারণ, আমি জানি আমার অবদান যেহেতু ব্রহ্মা-ের গভীর অতলান্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে, সেজন্য তা বিফলে যাবে না। আমিও এক মরণশীল, আমিও যিনি অমর তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারি, এবং যতটুকু সম্ভব আমার আত্মাও ক্রমেই আরো অবিনশ্বর হতে পারে। এই সামঞ্জস্য নিষ্ক্রীয় নয়, বরং বিপরীতধর্মী শক্তির সঙ্গে নিরন্তর সহযোগিতা এবং আপোষ রফার নবায়িত রূপ, এবং এতেই রয়েছে আমার মুক্তি আর উদ্ধারের চাবিকাঠি।

কাজানজাকিসের আত্মজীবনীতে নানা বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস, সন্দহে, অবিশ্বাস, কৌতূহল ইত্যাদি তাঁর অননুকরণীয় প্রকাশভঙ্গিতে দীপ্ত হয়ে উঠেছে। যদিও তিনি বলেন যে, তাঁর লেখার উদ্দেশ্য সৌন্দর্যসৃজন নয়, বরং আলোকের শক্তিকে, উত্তমকে বিজয়ী হতে সাহায্য করা, ক্রিটকে মুক্তি অর্জনে সহায়তা করা, তবু তাঁর রচনার সর্বত্রই সমুদ্র আর পাহাড়, সূর্য আর চাঁদ তারা, দ্রাক্ষাকুঞ্জ আর পুষ্পে র্পণে ভরে ওঠা খুবানি বাদাম গাছ আর হাজারো নৈসর্গিক অনুসর্গ এমনভাবে চিত্রিত যে তাতে এদের প্রতি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে পাঠকের ভালবাসা সৃষ্টি যে তাঁর একটি উদ্দেশ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খাদ্য গ্রহণের পূর্বে প্রার্থনার মাধ্যমে ঈমানদার ব্যক্তি খাদ্যে উপস্থিত ঈশ্বরকে মুক্তিদান করে, এবং এই প্রথাকে কাজানজাকসি মরমী বলে অভিহিত করেন। এমন সুন্দর অনুভবের সঙ্গে ডি. এইচ. লরেন্সের ‘দ্য মিস্টিক’ কবিতায় একটা আপেল খাওয়ার সময় বীজ থেকে শুরু করে সেই আপেলের পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় প্রাকৃতিক অনুসর্গের কথা স্মরণ করে খাওয়ার পরামর্শর চমৎকার মিল দেখি। লরেন্স প্রার্থনার কথা না বললেও এভাবে আপেল খাওয়া তো আর্হায বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং প্রকারান্তরে প্রকৃতরি কাছে কৃতজ্ঞতাই স্বীকার করা। এ জন্যই একে তনিি বলেছেন মরমি আহার নইলে পশুর মৃতদেহ সংহারের সঙ্গে মানুষের খাদ্য গ্রহণের কোনও ফারাক থাকে না। আবার, সিনাই পর্বতাঞ্চলে র্তীথে গয়িে মরুভূমির বর্ণনায় যখন কাজানজাকিস বলেন যে মরুর একাকীত্ব অমানবিক এবং তা বালু আর ঈশ্বর সমাহারে নির্মিত, তখন তা বালজাকের মরু বর্ণনা স্মরণ করায়। বালজাকের ‘প্যাশন ইন দ্য ডেসার্ট’ গল্পের শেষে মরুভূমিকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি বাক্যে : ‘মরুভূমি হল মানববর্জিত বিরান ঈশ্বর।’
রিপোর্ট টু গ্রেকো কাজানজাকিসের যুগপৎ পার্থিব ও আধ্যাত্মকি জীবনের বৃত্তান্ত। এজন্য এতে সব কিছুই যে তাঁর বাস্তব জীবনে ঘটেছিল তা মনে করার কারণ নেই। আথোস পর্বতের আশ্রমে বিচরণের সময় মধ্যযুগরে সাধু মাকারিওস দ্য স্পেলিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথোপকথন, বাইবলেে র্বণতি পয়গম্বররে অনুকরণে মৃতদেহে কবিবন্ধুর ফুৎকারে জীবনদানের প্রয়াস ইত্যাদি প্রতীকী এবং কাল্পনিকই মনে হয়।
কাজানজাকিস নীশে, বার্গসঁ দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর লেখায় জেমস জর্জ ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ পাঠের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। এডোনিস ও খ্রিস্টের ধারণায় মিল দেখতে পাওয়া, এবং দেশাত্মবোধ থেকে উদ্ভুত এমন বিশ্বাস যে গ্রিক সভ্যতা বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার চেয়ে, বশিষে করে মশিরীয় ও ভারতীয় সভ্যতার চয়েে বেশি মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সেজন্য হয়েছে বেশি টেকসই ইত্যাদি ধারণা তার ফ্রেজারের বই থেকেই পাওয়া। কাজানজাকিস মনে করতেন গ্রিক সভ্যতা মধ্য আসমানে ঝুলে থাকা কোনো অলৌকিক ফুল নয়, বরং এমন এক বৃক্ষ যার শেকড় প্রোথিত মাটির গভীরে। সেখান থেকে তা আহরণ করেছে পার্থিব জীবনের কর্দম এবং এই কাদা সে রূপান্তরিত করেছে পুষ্পে, পঙ্কজে। যতই সে গিলেছে পঙ্ক ততই পেরেছে বর্ণিল ফুল ফোটাতে। তাঁর মতে বাস্তব জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতার পরই গ্রিকজাতি এমন সুষম সভ্যতা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে।
কাজানজাকসি-এর অধকিাংশ বই বেস্ট সলোর হলওে জনপ্রয়িতায় জোরবা দ্য গ্রকি কে ছাড়াতে পারনেি কউে। জোরবা ছাপা হয় ১৯৪২ সালে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গইে তা পাঠক মহলে বপিুল সাড়া ফলে এই উপন্যাসে কাজানজাকসি সবচয়েে সফলভাবে বারগসঁর এলান ভতিাল র্দশনরে প্রতফিলন ঘটান। বইটা তনিি লখেনে মাত্র দড়ে মাসে কন্তিু জোরবা চরত্রি এতই প্রাণবন্ত এবং র্সবজনগ্রাহ্য হয় যে আজ পর্যন্ত অন্তত পঞ্চাশটি ভাষায় এই বই অনূদিত হয়ছে তবে বইয়রে জনপ্রয়িতা কয়কেগুণ বাড়য়িে দয়ে এর সনিমো সংস্করণ।  ১৯৬৪ সালে চলচ্চত্রি নর্মিতি হলে মক্সেকিান অভনিতো এন্টনি কুইনরে অনবদ্য অভনিয়ে এই কাহনিি বশ্বিব্যাপী আদৃত হয়। কুইন নজিইে একটা অভজ্ঞিতার কথা এভাবে র্বণনা করনে যে একবার রাতরে বলো নউিইর্য়ক সনেট্রাল পাকর্রে ভতের দয়িে তনিি পার হচ্ছলিনে। হঠাৎ পছেন থকেে বন্দুকরে নলরে গুঁতো এবং সইে সঙ্গে হুঙ্কার, খবরদার, নড়বি না। ভয়ে সঁিটকে তনিি মুখ ফরোতইে বন্দুকধারী ওহ, মস্টিার জোরবা, সরি সরি বলে দে দৌড়। এন্টনি কুইন সনেট্রাল র্পাকএর ওই অভজ্ঞিতাকে তার অভনিয় জীবনরে এক শ্রষ্ঠে অভজ্ঞিতা বলে উল্লখে করছেনে।  জোরবাকে চলচ্চত্রিে রূপ দনে মখিালসি কাকোইয়ান্নসি। এই ছবি তনিটে একাডমেি পুরস্কার পায়। যুক্তরাষ্ট্রে একে গীতনিাট্যে রূপ দওেয়া হয়। এ ছাড়া লোরকা মাসাইন একে ব্যালে নাচওে রূপান্তরতি করনে। এ সব থকেে জোরবা কাহনিরি গ্রহণযোগ্যতা বুঝতে পারা যায়।
জোরবা চরত্রি শঘ্রিই এক মাট-িঘঁেসা, ভোগী, নারী প্রমেকি, পরপর্িূণ  জীবনবাদী এক আরকটিাইপাল চরত্রি হসিবেে সাহত্যিে জনপ্রয়ি হয়ে ওঠ।ে বস্তুত কাজানজাকসি তাঁর আত্মজীবনীতে একটা র্দীঘ চ্যাপ্টার জোরবাকে নয়িইে লখেনে এবং জোরবাকে তাঁর গুরু হসিবেে মান্য করনে।  রপর্িোট টু গ্রকেো তে তনিি লখেনে, জোরবা আমাকে শখিয়িছেে জীবন ভালােবাসত, মৃত্যুভয়ে ভীত না হত। জীবনে যদি কাউকে গুরু হসিবেে মানতইে হয় তাে অবশ্যই সে জোরবা।
গ্রকি পূরাণে সাইসফিাস অমর হতে চয়েছেলি, তাই দবেতারা তাকে শাস্তি দয়ে। সাজাটা এমন যে তাকে একটা বশিাল শলিাখ- ঠলেে ঠলেে ওঠাতে হবে পাহাড় চূড়ায়। কন্তিু যখনই সে প্রস্তরখ- অনকেটা উঠয়িে নয়ে, তখনই তা আবার গড়য়িে পড়। এরকম চলতে থাকে অনন্তকাল। অস্তিত্ববাদী লখেক আলবয়োর কামু এই মথিরে যে ব্যাখ্যা দনে তা হল সাইসফিাস আসলে একজন সুখি মানুষ কারণ সে ধরে নয়িছেে র্শীষে পৌঁছতে পারাটাই সাফল্য নয়, বরং তা সংগ্রামরে অপমৃত্যু। র্শীষে ওঠার নরিলস প্রয়াসই হয়া উচতি মানুষরে লক্ষ্য। এই ধারণাকে কাজানজাকসি আরও এক ধাপ এগয়িে ননে এবং মনে করনে সর্বোচ্চ শখিরে উঠে সে নতুন লক্ষ্য স্থরি করে যাত্রা অব্যাহত রাখবে এবং চাইবে শ্রমরে ঘামকে আত্মায় রূপান্তরতি করত। কাজান- জাকসিরে ক্ষত্রেে এমন হয়ত ভাবাই যায় যে প্রতবিার পাথর গড়য়িে পড়লে তাঁর সাইসফিাস শূন্যে দু হাত তুলে সইে সাফল্য বা র্ব্যথতায় জোরবার মত নৃত্য করত, কারণ তার কাছে র্ব্যথতা ও সাফল্য পরস্পর পরপিুরক।
আসলওে, সবকছিুতে দান্দ্বিকতাকে একটি অপরহর্িায  এবং ইতবিাচক বশৈষ্ট্যি হসিবেে র্সবত্র দখেতে পাওয়ার এই গুণ কাজানজাকসিরে অভনিব কােনো র্দশন নয়। তবে তাঁর মৌলকিত্ব হয়তাে এটুকুই যে তনিি এই এই  দান্দ্বিক আর্বতনকে কৃষ্ণ গহ্বরে বলিীন হতে দনেন; বার বার নয়িে গছেনে সইে গহ্বররে বপিজ্জনক কনিারায়, কন্তিু সখোন থকেে আবার ফরিয়িে এনে নানা পথ পরক্রিমার পর দাঁড় করয়িছেনে নতুন তমিরি গুহার দ্বার। কাজানজাকসিরে এই দর্শনকে বলতে পারি দান্দ্বিক অধবিদ্যিা। তইেশ বছর বয়সেে লখো প্রথম উপন্যাস শাপ ও শাপলায় জীবন সর্ম্পক, মানুষের সংগ্রাম, বস্তুজগত সর্ম্পক, দ্বধিাদ্বন্দ্ব, বশ্বিাস-অবশ্বিাসরে দোলাচল সর্ম্পকে একজন প্রমেপাগল চত্রিকররে মনে যে বীজ তনিি বপন করছেলিনে পরর্বতী জীবনে ৯ টি ঢাউস উপন্যাস আর ১ টি মহাকাব্যে তা সহস্র ডালপালা মলেে বশিাল মহাদ্রমে আত্মপ্রকাশ কর। এজন্যই টমাস মান, আল বয়োর কামু, সুইটজার, কলনি ঊইলসন তাঁকে তলস্তয়-এর পর ইউরোপরে সবচয়েে উল্লখেযোগ্য সাহত্যিকি বলে অভহিতি করছেনে।