করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





ক্যানবেরার তিল: লেক বার্লি গ্রিফিন
ফজল হাসান
একজন রমণীর মুখমন্ডলে স্পষ্ট হয়ে ফুটে থাকা একটা তিলের উপস্থিতির কারণে সেই মুখাবয়ব হয়ে ওঠে অপরূপা এবং বাড়িয়ে দেয় হাজার গুণ সৌন্দর্য। যদি তাই না হতো, তাহলে পারস্য কবি ওমর খৈয়াম প্রিয়ার মুখের তিলের বিনিময়ে তামাম বোখারা শহর বিলিয়ে দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করতেন না। যাহোক, রমণীর লাবণ্য মুখের জন্য তিলের যেমন ভূমিকা এবং অবদান, ইট-সুড়কি-পাথরের তৈরি কোনো শহরের জৌলুস বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক হ্রদের ভূমিকাও অনুরূপ এবং তা অনস্বীকার্য। পরিকল্পিত শহরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য এমনই একটা কৃত্রিম হ্রদ খনন করা হয়েছে অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরের মাঝে, যা ‘লেক বার্লি গ্রিফিন’ নামে পরিচিত।
এই নামকরণের পেছনে একটা ইতিহাস আছে। বিশ শতকের শুরুতে রাজধানী হিসাবে ক্যানবেরা শহর তৈরি করার আগে পুরো শহরের স্থাপত্যের নকশা করেন আমেরিকার শিকাগো শহরের স্থপতি ওয়াল্টার বার্লি গ্রিফিন। তিনি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে নকশা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আশেপাশের ভূমির বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিস্থিতির উপর সামঞ্জস্য রেখে তিনি লেকের নকশায় অনেকগুলো জ্যামিতিক ভাগে বিভক্ত করেছেন। কিন্তু গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে মহামন্দা (গ্রেট ডিপ্রেশন) এবং পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য লেক খননের কাজ শুরু করা যায়নি। যাহোক, পরে ১৯৬০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেনজিসের সরাসরি হস্তক্ষেপের জন্য খনন কাজ শুরু হয়। অবশেষে প্রচন্ড খরা এবং বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে এই লেক উদ্বোধন করা হয়। সেই সময় সরকারি এবং আপামর জনগণ চেয়েছিল মেনজিসের নামে লেকের নামকরণ করা হোক। কিন্তু মেনজিস তাতে রাজি হননি, বরং স্থপতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি নাম রাখেন ‘লেক বার্লি গ্রিফিন’।
সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা লেক বার্লি গ্রিফিন পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘায়িত। যদিও এই লেক ক্যানবেরা শহরকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে, তবে একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া-আসার জন্য দু’টি ব্রিজ রয়েছে। লেকের দৈর্ঘ্য এগারো কিলোমিটার এবং প্রস্থে (সবচেয়ে প্রশস্ত অংশ) এক কিলোমিটারের সামান্য বেশি। লেকের চতুর্দিক চল্লিশ কিলোমিটার পথ দিয়ে ঘেরা। তিন কোটি তিন লক্ষ ঘনমিটার পানি পূর্ণ লেকের গভীরতা কোথাও আঠারো মিটার, কোথাও দুই মিটার। লেকের মাঝে বিভিন্ন আয়তনের ছয়টি দ্বীপ আছে। অ্যাস্পেন দ্বীপে রয়েছে ‘অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ক্যারিলন’। অ্যাস্পেন দ্বীপ মূল ভূখন্ডের সঙ্গে হাঁটার পথ দিয়ে সংযুক্ত। ক্যানবেরার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে রানী এলিজাবেথ ১৯৭০ সালের এপ্রিলে এই ক্যারিলন উদ্বোধন করেন। ক্যারিলনে মোট তিপ্পান্নটি তামার ঘন্টা আছে এবং প্রতি রবিবার সকাল এগারোটায় বাজানো হয়। উল্লেখ্য, নান্দনিক এই জায়গাটি অনেক নবদম্পতির কাছে ফটোশ্যুট করার মোক্ষম স্থান।
কমনওয়েলথ্ ব্রিজের একপাশে লেকের মধ্যম অংশের (সেন্ট্রাল বেসিন) মাঝামাঝি জায়গায় আছে ফোয়ারা, যা ‘ক্যাপ্টেন কুক ওয়াটার জেট মেমোরিয়াল’ নামে পরিচিত। এই ফোয়ারা শীতের সময় দিনে দু’বার এবং গরম কালে তিনবার বৈদ্যুতিক শক্তির মাধ্যমে চালু থাকে। ফোয়ারা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ লিটার পানি নির্গত হয় এবং তা ঘন্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে প্রায় ১৯০ মিটার উঁচুতে ওঠে। এছাড়া স্থপতি গ্রিফিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী লেকের দু’পাশে অনেকগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে লেকের গা ঘেষে দক্ষিণ পাশে রয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারী, হাইকোর্ট, সায়েন্স ডিসকোভারী সেন্টার বা কোয়েস্টাকন, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, এবং একটু দূরে ট্রেজারী ভবন, পুরাতন এবং নতুন সংসদ ভবন উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে লেকের উত্তর পাশে ন্যাশনাল মিউজিয়াম, অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শহরের কেন্দ্রবিন্দু এবং বিশাল পাহাড় (ব্ল্যাক মাউন্টেন, যার চূড়ায় টেলষ্ট্রা টেলিকম্যিনিকেশন টাওয়ার বসানো)। উল্লেখ্য, বর্তমানে যেখানে ন্যাশনাল মিউজিয়াম দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গায় ছিল রয়্যাল ক্যানবেরা হাসপাতাল। উৎসাহী আমজনতার সম্মুখে ১৯৯৭ সালে হাসপাতালের সুউচ্চ মূল ভবন নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ধ্বংস করা হয়। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ছিঁটকে এসে একখন্ড ইট লেকের উল্টোদিকে দাঁড়ানো একটা ছোট মেয়ের মাথায় আঘাত করে এবং মেয়েটির মৃত্যু হয়। যাহোক, সেই হাসপাতালেই জন্ম হয়েছে আমাদের প্রথম সন্তান।
পরবর্তীকালে সত্তরের দশকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য লেকের উত্তর পাশে আছে সবুজ মসৃণ ঘাসে আবৃত ‘রিগ্যাটা পয়েন্ট’ এবং ‘ন্যাশনাল ক্যাপিটেল এক্সিবিশন সেন্টার’। এই ন্যাশনাল ক্যাপিটেল এক্সিবিশন সেন্টারে গেলে দেখা যায় ক্যানবেরা শহরের গোড়াপত্তনের কাহিনী, ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের পরিকল্পনা এবং গ্রিফিন সাহেবের মূল নকশার প্রদর্শনী। এছাড়া রিগ্যাটা পয়েন্টের একপাশে বিশাল একটা গ্লোব আছে, যার নাম ‘ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়াল’। সেখানে ক্যাপ্টেন কুকের তিনবার অষ্ট্রেলিয়ার জলপথে পরিভ্রমণের আলাদা রঙে তিনটি পথ দেখানো হয়েছে। এছাড়া এই ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়ালের সামনে বিশেষ দিনে, যেমন অস্ট্রেলিয়া ডে, ক্যানবেরা ডে, নিউ ইয়ার’স্ ডে এবং কুইন্স বার্থ ডে, সন্ধ্যের পরে ফায়ার ওয়ার্কস দেখানো হয়। এই লেকের পাড়েই বসন্তকালীন পুষ্প উৎসব (ফ্লোরিয়াড)-এর আয়োজন করা হয়, যা দেখার জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আগমন ঘটে।
উল্লেখ্য, অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনার জন্য আমার স্ত্রী এবং আমি সেই ১৯৮৪ সালের শুরুর দিকে যখন প্রথম ক্যানবেরায় আসি, তখন হাতে গোণা কয়েকজন ছাত্র/ছাত্রী এবং বাংলাদেশি-অষ্ট্রেলিয়ান নাগরিক বসবাস করতেন। এছাড়া বাংলাদেশ দূতাবাসে ছিলেন অল্প সংখ্যক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী। যদিও আমাদের মধ্যে দারুণ সখ্য ছিল, ছিল কারণে-অকারণে আসা-যাওয়া ও খানা-পিনার উৎসব, কিন্তু মাঝেমাঝে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতদের কথা মনে হলে অনায়াসে মন-খারাপের কালো মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসতো ভাবনার আকাশে। সেই সব মন-খারাপের দিনগুলোর পড়ন্ত বিকেলে আমরা প্রায়ই বাসা থেকে পনের মিনিটের পথ হেঁটে রিগ্যাটা পয়েন্টে যেতাম। মসৃণ সবুজ ঘাসের নরম গালিচায় চিৎ হয়ে শুয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম আর ভারী নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুকের ভেতর টেনে নিতাম চারপাশে ভেসে বেড়ানো নস্টালজিয়ার পোড়া মরিচের তীব্র গন্ধ। সেই গন্ধে চোখ ঝাঁ ঝাঁ করতো এবং মনের অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে যেত। এই তেত্রিশ বছর পরেও সেখানে গেলে সেই পুরোনো দিনের স্মৃতি মনের ভেতর শুশুকের মতো ভুস্ করে ভেসে উঠে এবং পুনরায় আবেগে আপ্লুত হই। এছাড়া তখন, বিশেষ করে গরম দিনের ছুটির সময়, আমরা দল বেঁধে লেকে কার্প মাছ ধরতে যেতাম। আসলে মাছ ধরা ছিল গৌণ বিষয়, বরং মূখ্য বিষয় ছিল সপ্তাহে অন্তত একদিন সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা এবং খোলা হাওয়ায় গল্পগুজবে মশগুল হওয়া। ভাবীরা বাসা থেকে রান্না করে খাবার-দাবার সরবরাহ করতেন। সেদিনের সুন্দর এবং রঙিন সময় এতদিন পরে আজও স্পষ্ট মনে আছে।
ক্যানবেরার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও লেক বার্লি গ্রিফিন এবং আশেপাশের জায়গায় বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলা এবং চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা আছে। গ্রীষ্মকালে লেকের উপর ক্যানু, পাল তোলা নৌকা এবং প্যাডেল বোট চালানো যায়, এমনকি উইন্ডসার্ফিংও করা যায়। তবে সাঁতার কাটা পুরোপুরি নিষেধ। লেকের নিরাপত্তা রক্ষা ও সার্বিক দেখভাল করার জন্য রয়েছে ওয়াটার পুলিশ। এছাড়া গরম দিনের ভরপুরে একচিলতে ভিজে বাতাসের লোভে অনেকেই লেকের আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় যায়। ব্ল্যাক মাউন্টেন পেনিনস্যুলায় রয়েছে বারবিকিউ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে বৈদ্যুতিক চুলা, খাওয়ার পানি এবং টয়লেট। এসব জায়গায় যে কতবার বারবিকিউ করেছি, তার হিসেব নেই।    
জানি না, পরিকল্পনার কিংবা নকশা করার সময় গ্রিফিন সাহেবের মনে স্বদেশী প্রাবন্ধিক, কবি এবং বাস্তববাদী দার্শনিক হেনরী ডেভিড থরো (১৮১৭-১৮৬২)-র উক্তি উদয় হয়েছিল কি না। থরোর কথাটি ছিল এরকম: ‘হ্রদ হলো প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের সবচেয়ে সুন্দর এবং স্থলভূমির নয়ন; যা অর্থপূর্ণ গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকে নিসর্গের গভীরতা পরিমাপ করে।’ সত্যি বলতে কি, এই কৃত্রিম লেক বার্লি গ্রিফিন নান্দনিক ক্যানবেরা শহরের সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান।  
একটা প্রবাদ দিয়ে লেখা শেষ করবো, ‘পুরুষ নদী হলে নারী হলো হ্রদ।’ কেননা নদীর উন্মাদনা এবং উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে পুরুষের চরিত্রের যেমন মিল পাওয়া যায়, তেমনই লেকের শান্ত-সৌম্য পরিবেশের সঙ্গে নারীর চরিত্রের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। লেক বার্লি গ্রিফিন দেখে আমারও তাই মনে হয়।