করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





মান্নান সৈয়দ ছিলেন অতি রাগী, অতি প্রেমিক
একান্ত সাক্ষাৎকারে লেখকপত্নী সায়রা সৈয়দ
সায়রা সৈয়দের জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৫৪, ঢাকায়। তিনি শুধুমাত্র আবদুল মান্নান সৈয়দের স্ত্রীই নন, তাঁর লেখালেখি ও শিল্পকর্মের অন্যতম গুণগ্রাহী ও প্রেরণাদাত্রীও। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তিনি মান্নান সৈয়দকে নানাভাবে অবলোকন করেছেন, যাপন করেছেন এবং ধারণ করেছেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক-সমালোচক মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। আলাপনের কেন্দ্রে অবধারিতভাবে আছেন ব্যক্তি ও লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ, মানুষ ও স্বামী মান্নান সৈয়দ তো বটেই। ফলে পাঠক এতে খুঁজে পাবেন চেনা মান্নানের পাশাপাশি একজন অচেনা আবদুল মান্নান সৈয়দকেও।
প্রসঙ্গত আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্ম কলকাতায়, ৩ আগস্ট ১৯৪৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং  কর্মজীবনে পেশা হিসেবে অধ্যাপনাকে বেছে নিলেও তাঁর প্রকৃত জীবন ছিল সর্বসত্তানিমগ্ন সাহিত্যিকের। এ কারণেই হয়তো তিনি ব্যক্তিজীবনকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে রাখতেন। কবিতা-ছোটগল্প-প্রবন্ধ, মৌলিক লেখালেখির পাশাপাশি প্রবন্ধ-গবেষণা-সমালোচনা সাহিত্যে তিনি অতুলনীয় এক ঋতিক, দুই বাংলাতেই। জীবনানন্দ ও নজরুল চর্চায় তাঁর অনুসন্ধিৎসা ও সাফল্য বিস্ময়কর। তাঁর রচনাসম্ভার বিপুল, বহুবর্ণিল ও স্বতন্ত্র। উল্লেখনীয় গ্রন্থ : শুদ্ধতম কবি, কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, করতলে মহাদেশ, সত্যের মতো বদমাশ, দশ দিগন্তের দ্রষ্টা, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি অনন্তের পথে পাড়ি দেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  তরুণ গল্পকার মাসউদ আহমাদ
মাসউদ আহমাদ : লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দের বইপত্র পাঠ সম্পর্কে কিছু বলুন! সাধারণত কী ধরনের বই পড়তে তিনি পছন্দ করতেন, নোট করে রাখতেন?
সায়রা সৈয়দ : উনি পড়তে ভালবাসতেন। মৃত্যুর ৫ মিনিট আগেও তাঁর হাতে ছিল বিটোফেন-এর বই। বিভিন্ন ঘরানার, বিষয়ের বিভিন্নতা তাকে টানতো। ভ্রমণকাহিনী, আত্মজীবনী যেমন পড়তেন, তেমন সিনেমা বিষয়ক, গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে অন্দরশয্যা, শিল্পকলা, নাটক, মেয়েলী ম্যাগাজিনÑ সবই পড়তে ভালোবাসতেন। লেখার জন্য নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, মানিক, ফররুখ, জীবনানন্দ বা যখন যাকে নিয়ে কাজ করেছেন তার বিষয়ে প্রচুর পড়তেন। পড়তেন, দাগাতেন, নোট করতেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমলব্ধ লেখা লিখতেই পছন্দ করতেন এবং একটা লেখার জন্য তাঁর অনেকদিন সময় লাগত। গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি আমূল ঢুকে যেতেন লেখকের লেখা ও জীবনীতে। এটাই তার অভ্যেস ছিল।

লেখালেখি এবং পাঠ-পর্যালোচনার বাইরে আর কোন্দিকে তাঁর বিশেষ অনুরাগ বা অভিনিবেশ আপনি দেখে উঠেছেন?
সায়রা সৈয়দ : লেখালেখি পাঠ-পর্যালোচনা ছাড়াও শিল্পসংস্কৃতির প্রায় সব শাখাই তাকে টানত। অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকতেন। অবিকল স্বেচ করতে পারতেন মানুষের মুখ। কবি আল মাহমুদের হুবহু প্রতিকৃতি এঁকে একসময় চমকে দিয়েছিলেন। আমার নাতিকে সামনে বসিয়ে চমৎকার পোট্রেট করেছেন তার। নৃত্যকলা বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কৈশোরে হতে চেয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী। বাড়িতে বোনদের সাথে নাচতেন। অভিনয় করতে পছন্দ করতেন। মজা করে মেয়েকে নানা ঘটনা হুবহু অভিনয় করে দেখাতেন। পরে তো একটি নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে সর্বমহলে প্রশংসিত হন।

আপনি স্টুডিও জামানের কথা বলছেন? ডলি জহুরের সঙ্গে তিনি যে অভিনয় করেছিলেন এবং সেই নাটকে কবি বেলাল চৌধুরীও ছিলেন...
সায়রা সৈয়দ : হ্যাঁ। আপনি ঠিক ধরেছেন। এবং তিনি ভালোবাসতেন গানÑ রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি বেছে বেছে রেকর্ড করে আনতেন আজিজ সুপার মার্কেট, নিউমার্কেট থেকে। কিশোর কুমার, রুনা লায়লা, শাহীন সামাদ এর গান পছন্দ করতেন।

আপনাদের বিয়ে হয় ১৯৭৩-এ, বিয়ের আগে থেকেই কি তাঁকে জানতেন? কতটুকুÑ
সায়রা সৈয়দ : আমাদের বিয়ে হয় ১৯৭৩-য়ে। বিয়ের আগে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। যদিও উনি আমার চাচাতো ভাই ছিলেন। আমি সাজগোজ করে ঘুরে বেড়ানো এইগুলা পছন্দ করতাম। লেখাপড়ায় বিশেষ আগ্রহ ছিল না। পাত্র কবি শুনে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম।

বিয়ের পর তাঁকে মানুষ হিসেবে কেমন লেগেছিল? আগের চেনা মানুষটির সঙ্গে কোনো পার্থক্য কি পেয়েছিলেন?
সায়রা সৈয়দ : আমার বাবা সরকারি চাকুরীজীবি। আমরা ৬ বোন ২ ভাই। মা মারা যাবার পর বাবা আর ভাইবোনদের ভালোবাসা, আদরেই বেড়ে ওঠা। মধ্যবিত্ত ঘরের সংসারী, সাধারণ (সবাই বলে সুন্দরী, মায়াবতী) মেয়ে আমি। বাবা ছাড়া কেউ কখনও আমাকে তেমন শাসনও করে নি। সেখানে আমার চাচার নিজস্ব মস্ত বড়ো উঠান আর বিশাল আম, কাঁঠাল, ফলসা, বরই, নারকেল আরও সব নাম না জানা গাছ দিয়ে ঘেরা বিশাল দোতলা বাড়ি। লাল রংয়ের টয়োটা গাড়ি, বাড়িতে পোষা কুকুর। ওরা ৬ ভাই ৪ বোন। আমি কখনও কবি সাহেবকে দেখিও নি। একবার উনার ছোটবোনের বিয়েতে আসলাম। চাচাতো বোনোরা আমাকে নানা প্রশ্ন করেছিল। চাচি অনেক বুদ্ধিমতী, আমাকে বেশ আদর করেছিলেন। চাচি তার উঠতি লেখক, একটু উদাসীন, একটু ব্যতিক্রম ছেলের জন্য আমাকেই পছন্দ করলেন। বিয়ের কথা ঠিক হবার পর কবি সাহেব একদিন আসলেন আমাদের বাড়িতে। আমি লুকিয়ে দরজার আড়াল থেকে দেখলাম, ‘আল্লাহ্! এত্ত বড়ো বড়ো দাড়ি, গোঁফ!’ আমার সে কি কান্না। ভাবি পাত্রকে কী সব বুঝিয়ে বললেন।

আপনার তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
সায়রা সৈয়দ : ওমা, পরে একদিন আবার আসলেন। রূপবান, কাান্তিময় দীর্ঘদেহী, স্বল্পবাক একটু লাজুক যুবক। আমার বেশ পছন্দ হলো, একটু লজ্জাও পেলাম! ‘ওমা কেমন লোক! দিব্যি দাড়ি, গোঁফ কেটে আবার এসে হাজির!’ বিয়ে হল আমাদের ১১ নভেম্বর ১৯৭৩। বাসর ঘরে ঢুকে আমি অবাক! মেঝেতে বই, খাটে বই, ঘরভর্তি শুধু বই আর বই। খাটের অনেকখানি জুড়ে বই। কিছু বই সরিয়ে খাটে জায়গা করে বসলাম।

বিয়ের পর, প্রথম দিনগুলি কেমন ছিল, মনে পড়ে?
সায়রা সৈয়দ : আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসা-মায়া-নির্ভরশীলতা সবটুকু মিলে। আমি পুরোপুরিই সমর্পিত একজন নারী, যার জীবনে পতিই পরমেশ্বর। আর উনি আমার সেবা, সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এই পরস্পর নির্ভরশীলতা সাহিত্য বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকা আমাকে বদলে দিয়েছিল। দুজনে পাশাপাশি বই গুছানো, বইয়ের আলমারি সংরক্ষণ, কখন ওনার কী বই লাগবে এই-ই করতাম আমরা। কখনও হাসতে হাসতে কখনও ঝগড়া করতে করতে। উনি আমাকে মাঝে মধ্যে ‘দিদি মনি’ বলে ক্ষ্যাপাতেন। তবে সারাক্ষণ রানু, রানু-ই করতেন। আমার দেবর, ননদ, জা, ভাবিরা আমাকে ক্ষ্যাপাত তা নিয়ে। উনি একটা কবিতা লিখেছিলেন আমাকে উদ্দেশ্য করে...

কেমন ছিল সেই কবিতাটি?
সায়রা সৈয়দ :    আকাশ আঁধার করে নেমে আসে নৈরাশ্য যখন
        ভুবন ভাসিয়ে নেয়, সবই রন্ধ্রহীন অন্ধকার
        তখনো নিশ্চিত জানি, খোলা আছে তোমার দুয়ার।

লেখকদের মধ্যে এক ধরনের সরল উদাসীনতা, বোহেমিয়ান চরিত্র এবং নিমগ্নতার ব্যাপার থাকে। তাঁকে আপনি কীভাবে পেয়েছেন?
সায়রা সৈয়দ : লেখকদের মধ্যে একধরনের সরল উদাসীনতা, নিমগ্নতার ব্যাপার থাকে। তাঁর মধ্যে সেসব যে একেবারে ছিল না তা বলবো না। উনি কিন্তু বেশ আলাদা। এই যেমন ধরুন, মেয়েকে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন। বাজার, মার্কেট, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া এইসব কোনো কিছু বাদ দিতেন না। বেড়িয়ে এসে নিজের লেখালেখিতে মনোযোগ দিতেন। ঘুমাতেন খুব কম। রাতের বেলা আলো জ্বালিয়ে লেখালেখি করতেন। আমরা দুজন একসঙ্গে টিভিতে ওনার পছন্দের নাটক সিনেমা দেখতাম। রুনা লায়লা, কিশোর কুমার, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি শুনতাম একসঙ্গে। মেয়ে ছোট থাকতে আমাদের বাসায় ভিসিয়ার এসেছিল। হিন্দি, ইংলিশ মুভি দেখা হত প্রচুর। তখন আমরা বলাকা সিনেমা হলে গিয়েও সিনেমা দেখতাম। আমাকে ছাড়া ভাত খাবার টেবিলে বসতে পছন্দ করতেন না। একসাথে না খেতে চাইলে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রেগে যেতেন। সে জন্যই আমরা সাধারণত দুপুর ও রাতে একসঙ্গেই খেতাম। কাজের সময় কোনো বই খুঁজে না পেলে, রেগে অস্থির হয়ে যেতেন। চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাথায় করতেন। তারপর, প্রচুর বইয়ের মধ্যে তার আরাধ্য বইটি পাওয়ার পর যখন রাগ পড়ত তখন নিজেই ডাকতেন। রানু রানু করে আমার নাম ধরে ডাকাটা তার স্বভাব ছিল।

স্বামী হিসেবে, কিংবা গৃহীরূপে তাঁর মনোযোগ ও কর্তব্যপরায়ণতা কেমন ছিল? একটি নমুনা দিবেন কি?
সায়রা সৈয়দ : প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আমি যেন ছোট না হই এটা উনি খুব খেয়াল করতেন। রাস্তাঘাটে একা বেরোতে দিতেন না। আমাকে বলতেন, তুমি কী চাও? সেটা আমি যেভাবেই হোক এনে দেবোই। আমার অসুস্থতায় সেবাযতœ থেকে বোঝা যেত উনি আমার প্রতি কতটা দায়িত্বশীল। আমি শৈশবে মাতৃহারা মেয়ে। বাবা-ভাই-বোন সবার আদরের ছিলাম। ওনার কাছে এসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সংসারের খরচ, বাজার কী লাগবে,��েব বসুর বউ প্রতিভা বসুর মতো যদি হতাম তাহলে উনার পরিশ্রম কিছুটা লাঘব হতো। একজন লেখকের স্ত্রী হয়ে যা পাওয়ার ছিল তার থেকে বেশি পেয়েছি। সেই জন্য জীবনটা সুন্দর ও সুখকর তো বটেই। অন্যরকম হলে হয়তো সুখী হতাম না।

আপনার নিজের সাহিত্যানুরাগ ও পঠন-পাঠন সম্পর্কে একটু বলুন?
সায়রা সৈয়দ : আমার নিজের সাহিত্যানুরাগ তেমন ছিল না। উনার সাথে থাকতে থাকতে একধরনের সাহিত্যানুরাগ তৈরি হয়। আমি খুব উপভোগ করতাম উনার টিভিতে নানা বিষয়ের উপর বক্তৃতা, এমনকি নাটক। আর তিনি নিজে যখন অনুশীলন করতেন ঐসব বিষয় ঘরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে, আমার দেখতে খুব ভালো লাগত। আমাকে পড়ে শুনাতেন। আমি আবার অনেক সময় কিছু জায়গা সংশোধন করে দিতাম। উনি সেটা বদলে দিতেন।
আপনার জীবনসঙ্গীর এই যে শিল্পীমন, তাঁর বহুমাত্রিক সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ; কীভাবে আপনি বিবেচনা করেছেন?
সায়রা সৈয়দ : আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের সাহিত্য পরিমণ্ডলের এক অনিবার্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর বহুমাত্রিক সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ আমার জীবনসঙ্গীর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। এটা টাকা পয়সা দিয়ে মূল্যায়ন হয় না। উনি যা করে গেছেন সারাজীবন আপনাদের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবে। এটাই আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া।

তিনি তো চাকরি, লেখালেখি-সংক্রান্ত আড্ডা, টেলিভিশন অনুষ্ঠান, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ ইত্যাদি নিয়ে মগ্ন থাকতে ভালোবাসতেন। এসব আপনার কেমন লাগতো?
সায়রা সৈয়দ : আমার স্বামীর চাকরিসূত্রে একবার ঢাকার বাইরে অনেকদূরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেড়িয়ে দুই তিনদিন বেশ আনন্দে কেটেছিল। আর লেখালেখি সংক্রান্ত আড্ডাতো প্রায়ই বাসায় হতো। তখন চা ও টায়ের আসরে বন্ধুবান্ধব মিলে হৈ চৈ আমার দারুণ লাগতো। কয়েকবার উনার সাথে দেশের বাইরে কলকাতায় গিয়েছি। আর বিয়ের পর থেকেই তো টিভি প্রোগ্রাম প্রায়ই থাকত। আমি ও উনি ঘরে বসে চা-নাস্তা খেতে খেতে দেখতাম।

আপনাদের এই গ্রীণরোডের বাড়িতেও লেখকদের আড্ডা বসতো, এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য?
সায়রা সৈয়দ : উনি খুব আড্ডাপ্রিয় ছিলেন। এটা উনার আম্মার কাছ থেকে পাওয়া। ঐদিনটা বেশ আনন্দেই কাটতো। উনি বাজার করে এনে আমায় বলতেন, আজকে ভালো করে রান্না করো। কয়েকজন আসবে বাসায়। ঘরোয়াভাবে প্রায়ই আড্ডা হতো বাড়িতে। তখন কিন্তু আমি পরিবেশন করতাম না। উনি নিজেই হৈ চৈ করে খাবার টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন। সাহিত্যিক আড্ডা হতো, অনেক রাত পর্যন্ত চলতো। আমি তখন আমার ঘরে বসে আমার পছন্দসই প্রোগ্রাম দেখতাম টিভিতে। আমার বেশ ভালোই লাগতো। তাঁর খুশিতে আমিও খুশি।

আমরা তাঁর লেখায় দেখি, স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তিনি সিনেমা-থিয়েটার দেখতে বেরিয়েছেন। পরে ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় খেয়ে বাসায় ফিরছেন। বাস্তব জীবনে কি এমন ঘটতো?
সায়রা সৈয়দ : উনি খাওয়াতে এবং খেতে খুব পছন্দ করতেন। বাইরে বেরোলে কিছুক্ষণ পরই বলতেন, চল কোথাও গিয়ে কিছু খাই। সিনেমা, থিয়েটার, মার্কেট এমনকি ধানমণ্ডি লেকেও বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে সামনে কোনো রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রচুর খাওয়াদাওয়া করে বাসায় ফিরলাম। হঠাৎ করে হয়তো কোনো ভক্তের সাথে দেখা হলো। তাকে বলল, কালকে আবার বাসায় এসো জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। সেই আড্ডায় চললো খাবার দাবার ও চা। তারপর আবার নতুন কোনো একটা বই বেরোলো সেই উপলক্ষে বাড়ির সবাই মিলে নামকরা চাইনিজে খেতে চলে গেলেন।

লেখকের স্ত্রী হিসেবে ঢাকার বাইরে কিংবা বিদেশেও আপনি বেড়াতে গিয়েছেন! সেসব অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সায়রা সৈয়দ : উনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করার জন্য (বিষয় : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) কলকাতায় গিয়েছিলেন। আমাদের একমাত্র মেয়ে তখন একদম ছোট্ট। তাকে রেখে থাকতে পারবেন না বিধায় প্রথম দফা ফিরে এলেন। তারপর আমরা তিনজন মিলে অনেকদিন কলকাতাতে ছিলাম। শেষে আমার অসুস্থতার জন্য আবার ফিরে আসি। চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গেলাম সেবারও প্রচুর আনন্দ করেছি। এরপর চাকরিসূত্রে আমরা দুজনে কলকাতায় গিয়েছি অনেকবার। খুলনায় আমার খালার বাড়িতে বিয়ের পর প্রায়ই যাওয়া হত। ওনার সঙ্গই আনন্দদায়ক ছিল। উনিতো একজন প্রাণোচ্ছল উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বন্ধুবান্ধব আড্ডা বাইরের সময়টাই খুব উপভোগ্য ছিল।

পৈত্রিক সূত্রেই মান্নান সৈয়দ ঢাকায় বাড়ির মালিক হয়েছেন। কিন্তু তবুও, তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় দেখে উঠি, ভাড়া বাসার কথা এসেছে নানাভাবে। আপনারা কি কখনো ভাড়া বাসায় থাকতেন?
সায়রা সৈয়দ : হ্যাঁ। ১৯৮৬ সালে আমরা মিরপুরে অল্প কিছুদিন (প্রায় ৬/৮ মাস) দোতলা বাসার একতলায় ভাড়া ছিলাম। আমার বৈবাহিক জীবনের বেশির ভাগ সময় শ্বশুরবাড়িতেই কেটেছে। ১৯৮৬ সালের শেষের দিকে উনি সরকারি চাকরিসূত্রে ‘সরকারি আবাসন’ পান। আজিমপুর কলোনীর চারতলার বাসায় আমরা বহুদিন (১৯৮৬-১৯৯১) ছিলাম। যা আমাদের পারিবারিক জীবনের আনন্দঘন সময়ের শ্রেষ্ঠ কাল।

পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এখনও গ্রন্থভুক্ত হয়নি, এমন কিছু লেখার কথা আমার জানা ছিল। এখনও কি কোনো রচনা, ডায়েরি, কবিতা ইত্যাদি অগ্রন্থিত থেকে গেছে?
সায়রা সৈয়দ : এখনও তাঁর বহু রচনা ডায়েরি, কবিতা ইত্যাদি অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত রয়েছে।

আমাদের প্রয়াত একজন খ্যাতিমান লেখকের স্ত্রী বলতেন, সকালে ঘুম ভাঙার পরে যখন তিনি দেখতেন যে তাঁর স্বামী টেবিলে বসে লিখে চলেছেন; তাঁর মনে হতো, একটি পবিত্র দৃশ্য তিনি দেখছেন। আপনার অনুভব কেমন ছিল?
সায়রা সৈয়দ : আমারও অনুভূতি অনেকটা ঐ লেখকের স্ত্রীর মতোই। উনি সাধারণত রাত জেগে লিখতেন। ঘুম ভেঙেও দেখতাম লিখে চলেছেন। এত পরিশ্রম করতে পারতেন! নাস্তা খেতে ডাকলেও লেখা শেষ না করে উঠতেন না। এমন অনিয়মিত খাবার জন্য অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তবু লেখার ঘোরে থাকলে জগৎ ভুলে যেতেন। শুধুমাত্র আমাদের একমাত্র কন্যার কোনোকিছু ভুলতেন না। ও বাসায় থাকলে একদম নিশ্চিত। বাইরে গেলেই খুব দুশ্চিন্তা করতেন। উনার লেখালেখির সময়টা আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মেয়ে খেলতো অথবা পড়তো, উনি লিখতেন। আমি রান্নাবান্না করতাম। আমাদের জীবনের চরমতম সুখের দিন সেইসব। আমৃত্যু তো লেখালেখি করে গেছেন। এবং অসুস্থ অবস্থায়ও লিখলেই ভালো থাকতেন। আমিও স্বস্তি পেতাম যে উনি ভালো আছেন। বিছানায়, কার্পেটে উপুড় হয়ে শুয়ে লিখতেন। টেবিল চেয়ারে বসে লিখতেন। বালিশে হেলান দিয়ে বসে লিখতেন। বাড়ির ছাদে বসেও লিখতেন। শেষের দিকে গাড়িতে বসে লিখতেন।

তিনি লেখার জন্য, একটি কবিতা বা গল্প বা উপন্যাসের জন্য কেমন সময় নিতেন? কিংবা প্রবন্ধের বেলায়? এই ব্যাপারটা আপনি কতটা পর্যবেক্ষণ করে উঠতে পেরেছেন?
সায়রা সৈয়দ : তিনি কবিতা লিখতে বসলে সময়ই লাগত না বলা চলে। গল্প ও উপন্যাস লিখতে এক সপ্তাহ তো বটেই, তার থেকে বেশিও। উনি একটা লেখাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য আ-একার, দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন এইগুলো তো আছেই তারপর প্রধান চরিত্রের উপর নিখুঁত হয়ে যেন সেদিকে লক্ষ্য রেখে কয়েকবার ব্রাশ-আপ করতেন। এইজন্য সময় লেগে যেত। প্রবন্ধ তো কথাই নেই, ১৫-২০ দিন; আর তা না হলে হতোই না। বড় বড় নামকরা লেখকের রেফারেন্স খুঁজে দীর্ঘক্ষণ পড়ে তারপর লিখতে বসতেন। দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যেত। শেষ রাত্রে হয়তো কয়েক পৃষ্ঠা লিখলেন।

তাঁর, এমন কোনো লেখার কথা কি বলবেন, যে লেখাটি তিনি আপনার কথা শুনে কিছুটা পরিবর্তন বা আমূল সংশোধন করেছেন?
সায়রা সৈয়দ : না, তাঁর এমন কোন লেখার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

মান্নান সৈয়দ প্রাচীন অনেক লেখককে নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু সমকালীন লেখকদের মধ্যে কাকে তিনি বেশি পছন্দ করতেন?
সায়রা সৈয়দ : মান্নান সৈয়দ সমকালীন লেখকদের মধ্যে আমার তো এই মুহূর্তে
মনে পড়ছে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বেলাল চৌধুরী, আতাহার খান, শিকদার আমিনুল হক প্রমুখের কথা বলা যায়।

তাঁর ধর্মানুভূতি কেমন ছিল?
সায়রা সৈয়দ : ধর্ম নিয়ে ওনার কোনো গোঁড়ামি ছিল না। ধর্মানুভূতি বলতে উনি সব ধর্মকেই সম্মান করতেন। তিনি নামাজ পড়তে পারতেন না। কিন্তু আমি আমার নামাজ পড়তাম, কোরআন শরীফ পড়তাম। এটাতে উনি গর্ববোধ করতেন। আবার বলতেন, ‘রানু আযান দিয়েছে। যাও, নামাজ পড়ে এসো।’ শবেবরাতের দিন সন্ধ্যের সময় দরুদ শরীফ পড়তেন। ধর্মের উপর তো উনার একটা বই আছে। ‘সকল প্রশংসা তার’। নিজের ধর্মের প্রতি এতটা নিবেদিত না হলে কি এত সুন্দর একটা বই লিখতে পারতেন! সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্যের মান এবং মানুষের ক্ষেত্রে মানবিকতাই ছিল বড়। সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন। বহু হিন্দু লেখককে নিয়ে তো কাজ করেছেন। সবসময় বলতেন, ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না’Ñ এটা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন। নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল বলেই অন্য ধর্ম বা বিধর্মীকেও সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর প্রচুর হিন্দু ভক্ত ও বন্ধু ছিল। ওনার সম্বন্ধে অনেক সমালোচনা থাকলেও সত্যি এটাই যেÑ ওনার ধর্ম বিশ্বাস দৃঢ় ছিল। কিন্তু কখনই কোনো গোড়ামিতে ছিলেন না। এ সম্বন্ধে রাহাত খান উনার মৃত্যুর পর একটা সুন্দর কথা লিখেছিলেন। ওনার বিশ্বাসের সঙ্গে কর্মকে কখনও গুলিয়ে ফেলেন নি। জীবনানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মধুসূধন দত্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তÑ  বহু লেখকের উপর গবেষণা করেছেন। সারাদিন-রাত পরিশ্রম করে তাদের সম্বন্ধে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।

পাঠক হিসেবে তাঁর কোন লেখাগুলি আপনার কাছে প্রিয় বা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে?
সায়রা সৈয়দ : শ্রেষ্ঠ তো প্রায় বেশির ভাগ লেখাই। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলি। তবে আমাকে বলতে হলে আমি বলব, কবিতার বই ‘নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা’, ‘হে বন্ধুর বন্ধু হে প্রিয়তম’; ছোটগল্প ‘সত্যের মতো বদমাশ’, ‘নেকড়ে হায়না আর তিন পরি’; আর উপন্যাস ‘ভাঙ্গা নৌকা’। প্রবন্ধ আমার কাছে খুবই দুর্বোধ্য।

লেখক হিসেবে তিনি যখন পুরস্কারে সম্মানিত হতেন, কেমন লাগতো আপনার?
সায়রা সৈয়দ : পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ বাসায় ঝমঝম করে বয়ে যেত। পুরস্কার মানে মূল্যায়ন, পুরস্কার মানে কাজের স্বীকৃতি। উনি নিজেও বাচ্চাদের মতো খুশী হয়ে উঠতেন। উনি দেশে এবং কলকাতায় যখন যেখান পুরস্কার পেয়েছেন, বাসার সবাইকে নিজে নিয়ে গিয়ে দেখাতেন, সবার প্রথমে দেখাতেন তাঁর আম্মাকে। উনি প্রচণ্ড মাতৃভক্ত ছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার যখন পেয়েছিলেন, আমার মেয়ে ছিল একেবারেই ছোট্ট। লাল ভেলভেট এর বক্স, ক্রেস্ট দেখে মেয়ে খুব মজা পেয়েছিল। পরে বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন পুরস্কার নিতে, অনেক সময় একাই গেছেন। একুশে পদক যখন পেলেন আমি আর নাতনি গিয়েছিলাম সঙ্গে। একবার একটা পুরস্কার পেয়ে আমাকে বাসার জন্য ফ্রিজ কিনে দিয়েছিলেন। এমনিতে পুরস্কার পাওয়ার দিনগুলিতে তিনি দুইহাত ভরে বাজার করতেন, নানারকম খাবার-দাবার আনতেন। বাসায় বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্খীদের ভিড় বেড়ে যেত। আনন্দময় সেসব সময়ের স্মৃতি আমাদের আলমারি ভর্তি পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই চোখ ভিজে আসে।

তিনি কখন লিখতেন? লেখার সময় তাঁকে ডাকলে বা মানুষজন এলে বিরক্ত হতেন?
সায়রা সৈয়দ : তিনি সারাদিনই লেখা অথবা পড়ার মধ্যেই থাকতেন। কোনো বাঁধাধরা সময় ছিল না। এর ফাঁকেই বাজারে যেতেন। এমনকি চাকরিও করতেন লেখালেখির ফাঁকেই। লেখালেখির মাঝখানে একটু হয়তো ঘুমিয়ে নিতেন, পড়তেনও খুব। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তো আপনাদের সবারই জানা। পত্রিকা পড়তেন খুব। সানন্দা, দেশ, ফিল্ম ফেয়ার, স্টারডাস্ট, ভ্রমণ, বিচিত্রাÑ প্রচুর ম্যাগাজিন আমাদের বাড়িতে। একবারতো আমার ছোট নাতনি নানাভাইকে বলেই বসলোÑ  ‘নানাভাই তুমি শুধু বই পড়ো, আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে পারো না?’ লেখার সময় অন্যকিছুতে মনোযোগ দিতে চাইতেন না।

লেখার মধ্যে তিনি যখন খুব নিমগ্ন থাকতেন, মানুষজন এড়িয়ে যেতেন; বলতেন, এখন হবে না, আমি অসুস্থ ইত্যাদি। এটা কতটুকু সত্য? এই বিষয়ে আপনার কাছে শুনতে চাই।
সায়রা সৈয়দ : লেখার মধ্যে নিমগ্ন অবস্থায় আসলেই আমি, মেয়ে, নাতি-নাতনি ছাড়া কারও সাথে তেমন কথা বলতেন না। আবার অনেক সময় আড্ডার মধ্যে বসেও লিখতেন। পাড়ার হোটেলে, আজিজ সুপার মার্কেটে, অলিয়াস ফ্রসেজে, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে বসে যখন লিখতে ইচ্ছে হত, লিখতে থাকতেন। অনেক সময় লেখার চাপ বেশি থাকলে পত্রিকা অফিসে গিয়ে বসে লেখা শেষ করে দিয়ে আসতেন। হ্যাঁ, তবে শেষের দিকে কখনও কখনও কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। শারীরিক কারণেই এত পরিশ্রম সহ্য হত না। আবার যেন তেন করে লেখা শেষ করে দেয়া তাঁর ধাতে ছিল না।

আমরা দেখেছি, ৬০ পেরিয়েও তিনি সুন্দরতম ফ্যাশানেবল তরুণেরও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন! পোষাকে,  ফ্যাশনে ও প্রেমে তিনি ছিলেন প্রায় চিরনতুন। এ নিয়ে আপনার অবলোকন কী?
সায়রা সৈয়দ : সাজগোজ পছন্দ করতেন বরাবরই। শেষের ১০ বছর বৈষয়িক বিষয়ে একটু স্থিতিশীল হবার পরÑ মেয়ের চাকরি, বিয়ে সবকিছুর পরে আমার আর মেয়ের অনুরোধেই সাজসজ্জায় একটু বেশি মনোযোগী হন। টাই, টাইপিন, হ্যাট, ক্যাপ, ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি এসব ব্যবহার করতেন। দামী জুতা, ঘড়ি কিনেছিলেন। শার্ট বানাতেন। সব আবার আমাকেই গুছিয়ে রাখতে হতো। কোনো বিশেষ প্রোগ্রামে আমার ও মেয়ের মতামত নিয়েই কাপড় বাছাই করতেন। দীর্ঘ, সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। যাই পরতেন মানিয়ে যেত। পোশাকে একটা সময় অতটা যতœশীল ছিলেন না, যা আমাকে পীড়া দিত। মনে হতো, আমাদের জন্য এত করেন আর নিজেকে অবহেলা করেন। পরে আমার আর মেয়ের পীড়াপিড়িতে শুরু করলেও নিজেই আরও ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠেন। উনিতো আমার চোখে চিরতরুণই এবং চিরপ্রেমিক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের প্রেম ও ঈর্ষা ছিল। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, উনিতো আমার ভেতরে প্রেমিকস্বামী প্রবলভাবেই থাকবেন। তিনি মানুষটাই ছিলেন আনন্দচ্ছ্বল, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, সুদর্শন এবং প্রবল প্রেমিক। আমি তো বরাবরই নিবেদিত নারীই ছিলাম। আছি, থাকব।

তিনি তো ছবিও আঁকতেন! আলাদা করে ছবি নিয়ে কোনো পরিকল্পনা তাঁর ছিল?
সায়রা সৈয়দ : চিত্রকলার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। শিল্পকলা নামে একটি বইও তো লিখেছেন। প্রচুর আর্টের বই ছিল ওনার। পাবলো পিকাসোকে পছন্দ করতেন। আর্ট কলেজে পড়ার খুবই ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু আমার শ্বশুর রাজী হননি। তাই পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বাংলায় ¯œাতক এবং ¯œাতকোত্তর করেন। ছবি আঁকা তাঁর কাছে নেশার মতো ছিল। ছবি আঁকার জন্য মিস্ত্রি দিয়ে দুটি বিশেষ ধরনের কাঠের টেবিলও বানিয়েছিলেন। পোট্রেট ভালো আঁকতেন। মেয়ে, নাতি-নাতনিকে সামনে বসিয়ে প্রচুর ছবি এঁকেছেন। পরাবাস্তব ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। আবার কোনোকিছু দেখে হুবহু সেটাই আঁকার প্রবণতাও ছিল। আমাদের বেডরুমের বারান্দায় একটা মানিপ্ল্যান্ট গাছ ছিল। নিজেই প্রতি সকালে তাতে পানি দিতেন। সেই মানিপ্ল্যান্ট গাছটিকেও এঁকেছিলেন পরম মমতায়। ডায়েরি, মাতাল গদ্য পাগল কবিতা, আমার সনেটÑ এসব বইতে তার নিজস্ব আঁকা ছবি, অলঙ্করণ, ইলাস্ট্রেশন আছে। তবে আরও বড় পরিসরে নিজস্ব আঁকা ছবি ও লেখা নিয়ে তাঁর আরও বই লেখার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

খাবারে রুচি কেমন ছিল, কী খেতে তিনি ভালোবাসতেন?
সায়রা সৈয়দ : সবরকমের খাবারই পছন্দসই ছিল। মিষ্টি জাতীয় খাবার ওনার বেশি প্রিয় ছিল। নানারকমের হালুয়া পছন্দ করতেন। তার মধ্যে ছিল গাজর, ডিম, ছোলার ডাল, দুধের সেমাই (বাদাম+পোস্তা+মোরব্বা+কিসমিস) দিয়ে তৈরি হতে হবে। নারিকেলের পিঠা, বিদেশি চকলেট ও আলাউদ্দিনের মিষ্টি, বিশেষত বালুশাই ওনার পছন্দের তালিকায় ছিল। এতো গেলো মিষ্টান্ন। এবং ঝালের মধ্যে গরুর মাংস দিয়ে ভাত। ডাল ছাড়া উনি আবার ভাত একদম খেতে পারতেন না। মাছের মধ্যে বিশেষ করে ইলিশ মাছই ভালোবাসতেন। ওনার খাবারের মধ্যে বিশেষ ছিল চা। ফুটপাতের চা থেকে শুরু করে রেডিসন-এর চা দুটোই তার সমান প্রিয় ছিল। আর শীতকালে মটরশুটি সিদ্ধ, কাঁচা টমেটো ও শশা ফালি করে খেতেন।

তাঁর চরিত্রের কোন দিকটা আপনাকে মুগ্ধ করতো, যা এখনও সজীব মমতায় অনুভব করেন?
সায়রা সৈয়দ : তিনি সহজ, সরল মনের মানুষ ছিলেন। এই দিকটাই আমাকে মুগ্ধ করতো। পরিবারের সবাই বাবা, মা, ভাইবোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি, ভাতিজি-ভাতিজা এমনকি সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা, বাড়ির চাকর, ড্রাইভার সবার প্রতি তাঁর প্রচুর ভালোবাসা ছিল। সেভাবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন না কিন্তু সবার খুশীতে খুশী হতেন, দুঃখে সমব্যথী হতেন। কেউ কোনো রুঢ় ব্যবহার করলেও উনি সেটাকে হালকাভাবে নিয়ে আমাকে বুঝাতেন। আসলে তিনি হৃদয়বান, উদার মমতাময় মানুষ ছিলেন। যা আমাকে আজও মুগ্ধ করে।

আর মন্দলাগা কোনো স্বভাব, যা শোধরানোর জন্য বলতেন?
সায়রা সৈয়দ : তিনি একটু রাগী ছিলেন। অনেক সময় সামান্য বিষয়ে অনেক রেগে যেতেন। এটা বদলাতে চাইতাম। আর মেয়ের জন্যে অযথা দুশ্চিন্তা করতেন। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে, অথবা ঢাকার বাইরে গেলে, এমনকি মার্কেটে গেলেও ঘন ঘন মোবাইলে ফোন দিতেন। মেয়ে আমি দুজনাই বোঝাতাম। কিন্তু উনি শুনতেন না। রাগ, দুশ্চিন্তা উনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর তাই তা শোধরানোর জন্য চেষ্টা করতাম। নিজেই বলতেনÑ ‘আমি অতি রাগী, অতি প্রেমিক।’

সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সায়রা সৈয়দ : লেখকের জায়গা এক, আর স্বামীর জায়গা অন্যরকম। এখন মনে হয়, আমার স্বামী যদি একজন অসাধারণ না হয়ে সাধারণ মানুষ হতেন তাহলে হয়তো এখনো বেঁচে থাকতেন। আমি, আমার মেয়ে নাতি-নাতনি একসঙ্গে সবাই মিলে যেমন ছিলাম তেমনি থাকতাম। কিন্তু বড় মাপের লেখক হতে গিয়ে, সব মিডিয়ার দাবী মেটাতে গিয়ে, অতিরিক্ত লেখালেখির চাপেই হয়তো এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। কেননা এত পরিশ্রম শরীর আর সইলো না। আপনারা উনার জন্য দোয়া করবেন।