করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





ভয়জাগানিয়া পুরুষময় পৃথিবীর কলা ও কৌশল
শেলী নাজ
আমি ছুটছি, তখনও আমার শরীরে জাগেনি স্তব্ধ কুর্চিফুলগুলো। স্কুলঘরে ফাঁকা ক্লাশে আমাকে তাড়া করেছিল এক নিপাট কিশোর, মাঠ ভেঙে সবুজফ্রকের মেয়ে দিয়েছিলাম দৌড়। মাকে বলি নাই, গোপন ক্ষতগুলো জমা রাখার জন্য প্রত্যেক মেয়েরই থাকে আজন্মলালিত সোনার সিন্দুক, বুকের খুব গভীরে। সেইখানে জমতে থাকে নারীবিশ্বের কান্না ও হাহাকারগুলি আধুলির মত। অশ্লীল পুরুষের অজস্র কার্তুজে আমার, আমাদের মাংসকুঞ্জ নীল, সবুজ ফ্রক ছেড়ে আমি সেই কবে ধনেখালি শাড়ি পরতে শিখেছি, দেখতে দেখতে আয়নার ভেতরে আমার শরীর সীমাতিক্রমণতার রূপ ও রসে পল্লবিত হয়েছে, মন বলছে, তুমি বড় হয়ে গেছ, অ-নে-ক বড়। ভয় পেয়ো না! কিন্তু না, বড় হয়েছি আর আমার ভযগুলোও বড় হতে শুরু করেছে। আমার গোপন সিন্দুক ক্রমশ ভারী, কাউকে বলতে না পারা যন্ত্রণায়, অপমানে, লাঞ্ছনায়, পরাজিত মাংসখণ্ডের আর্তচিৎকারে। সেই অশেষ বেদনাভাণ্ডের কিছুটা ভার দিতে পারি তেমন পুরুষ কই? তেমন বন্ধু? তোমার হাত পা যোনি জরায়ু নিয়ে তুমি যদি নারী হও আর তারপর কবিতা লেখার মত মহাপাপ করে থাক তবে জেনে রাখ এ শহরের সাহিত্যসমাজে তুমি বিনোদনবালা, তোমার কবিতা, তোমার হাসি, তোমার কণ্ঠ সবকিছু থেকে উৎসারিত হয় যৌনতা। অন্তত বঙ্গপুঙ্গবেরা তাই খোঁজে। তোমার কবিতা খোঁজে না। তবু বুকের ভেতরে ভয় ও সংশয় নিয়ে মাঠ ভেঙে ছুটতে থাকা এক অপাপবিদ্ধ কিশোরীর রক্তক্ষরণ আমি কবিতায় লিখতে চেয়েছি, পুরুষশহরে একজন একা নারীর বেঁচে থাকাও অনেক দৌর্দণ্ডপ্রতাপ ও প্রতিভাহীন পুরুষের কবিতার চেয়ে বর্ণিল ও সুন্দর। কুৎসিত পুরুষের পক্ষে এই সুন্দর হজম করা কঠিন। সহজ কাজ এতে কালিমা লেপন করা। সহজ কাজ নারীকে শয্যায় টেনে নিয়ে যে কোনো ঘটনাকে নারীঘটিত ঘটনা বলে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়া। আর ৩১ ডিসেম্বরের সেই রাতে যা ঘটেনি তাই বললেন ও কালিমা লেপনের চেষ্টা করলেন গল্পকার পারভেজ হোসেন।

ভেবেছিলাম বোবা হয়ে থাকব। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না। অনুষ্ঠানের পর আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার সময়, পথে চঞ্চল আমাকে জানায়, সে পারভেজ হোসেন দ্বারা যে প্রহৃত হয়েছে বিষয়টি ফেবুতে লিখবে। আমি না লেখার জন্য অনুরোধ করি । পরদিন অফিসের কাজের চরম ব্যস্ততার মধ্যে আমাকে পারভেজ হোসেন ফোনে জানালেন চঞ্চলের স্ট্যাটাসের কথা। অনুরোধ করলেন তার হয়ে আমি যেন কিছু লিখি, অন্তত চঞ্চলকে যেন এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করি। রাত দশটার দিকে চঞ্চলের ফোন পাই , সে ভীষণ উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ। ‘সারারাত চোখের ব্যাথায় আমি ঘুমাতে পারিনি’ বলল সে। সারাদিনের কাজের পর ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত আমার কেন যেন এসব শুনতে ভাল লাগছিল না। এখন আমাকে বলতেই হচ্ছে, যদি ঘটনার পূর্বাপর ইতিহাস বলতে যাই তাহলে অনেকের মুখোশ খসে গিয়ে আসল চেহারা বেরিয়ে পড়বে। সেটা আর না করি, শুধু এটুকু বলতে চাই, শহীদুল আলম ও জহির সম্পর্কিত তর্কাতর্কির ঘটনার এক পর্যায়ে পারভেজ হোসেন তার মুখ চেপে ধরে ড্রয়িং রুম থেকে ডাইনিং স্পেসে নিয়ে যান। চঞ্ছল যা লিখেছিল তা সত্যি। এ ঘটনার সাক্ষী সেসময় সেখানে যারা ছিলেন তারা সকলেই । প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব রাজনীতি ও হিসাবনিকাশের সমীকরণ, তাই উপস্থিত অন্য কবি ও লেখকগণ নীরব রয়েছেন। আমি বিষয়টি নিয়ে কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাকে চুপচাপ থাকাই সমীচীন বলে জানান। ভাবতে ঘেন্না হয়, পারভেজ ভাই, যাকে আমি শ্রদ্ধা করি, বড় ভাইতুল্য জ্ঞান করি তিনি কিনা নিজের কুকর্ম ঢাকতে বাংলা সিনেমা স্টাইলে মশলাদার ক্লাইমেক্সের জন্ম দিতে অস্ত্র হিসেবে একজন নারীকেই বেছে নিলেন! যদি নিলেনই তাহলে আরও দুদিন আগে কেন নিলেন না? এই যদি সত্য ঘটনা তাহলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেন কেন আর আমাকে এত অনুনয় বিনয় করলেন কেন বিষযটি মিটিয়ে দেবার জন্য? দুজন মানুষের অবৈধ সম্পর্কের কারণে আপনি এত ভীত ছিলেন? আপনি যে কতবড় গল্পকার তা বোঝা গেল এ হাস্যকর, বিশ্বাসের অযোগ্য কাহিনী পাঠের মধ্য দিয়ে!

মূূলত আমরা এখনও শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ এ বাস করি। এখনও এ সমাজে পুরুষের কাছে নারী মানে যৌনখেলনা, যেন তার দেহভর্তি যৌনাঙ্গ, সে শুধু এটি দ্বারাই তাড়িত হয়। তার যেন আর কোনো বোধ, বুদ্ধি, মেধা ,ক্ষুধা নেই। ছি! এসব পুরুষই আবার আমাদের কবি বন্ধু, লেখকবন্ধ’! আমার দুঃখ নিজের জন্য নয়, দূঃখ এসব পুরুষের জন্য যারা মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ, পশ্চাৎপদ। যারা এখনও নারীকে আক্রমণ করে, পদদলিত করে নিজের পৌরুষ (!) বজায় রাখে। উদ্ভট নিউজটি পড়ার পর আমি পারভেজ হোসেনের সঙ্গে কথা বলি, তিনি এমন কোনো স্টেটমেন্ট কোনো অনলাইন পত্রিকাকে দেননি বলে জানান। আমার কথা হয় সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের সঙ্গে, তিনি বলেন পারভেজ হোসেনই এ বক্তব্য দিয়েছেন। কথা রেকর্ড করা আছে। এরপরও পারভেজ হোসেনের সাথে আমার কথা হয়। তার মিথ্যাচার তখনও থামেনি, ‘শোনেন, এসব লোক টাকা খেয়ে আজেবাজে কথা লিখে’ তিনি সাধু সাজার চেষ্টা করেন।

আজ রাতে আমি ঘুমুতে পারব না। আমি তো বেশি কিছু চাইনি, হৃদয়হীন পুরুষের পৃথিবীতে আমি একা বাঁচতে চেয়েছিলাম, বিশুদ্ধ, পরিপূর্ণ এক্। দরজাখোলা খাঁচার ভেতরে পুরুষহীন, আত্মশাসিত একা। শৈশবের সে দৌড় আজও দৌড়াই আমি স্বপ্নে ও জাগরণে। আজ রাতে আমার দিকে তেড়ে আসছে অসংখ্য অজগর, তাদের বিশাল হা এর মধ্যে আমাকে গিলে ফেলবে বলে। আমি ছুটছি, একটা সবুজ ফ্রক গায়ে, আমি ছুটছি একটা ধনেখালি শাড়ি, আমি ছুটছি সহস্র ভাঙা কাঁচের ওপর দিয়ে, না আর ছুটতেও পারছি না, এসেছি হামাগুড়ি দিয়ে, মা গো, পৃথিবী না নিক তোমার কবোষ্ণ জরায়ুতো আমাকে নেবে, বড্ড ভয় লাগে পুরুষময় পৃথিবী!