করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





কবি এবং পাঞ্জাবি
ছেলেবেলায় আম্মার হাতে তৈরি পাঞ্জাবি পরতাম। আমি কি একা? কে না পরেছে শৈশবে মায়ের হাতে তৈরি পাঞ্জাবি। ফুলতোলা, নকশা বোনা। এখনকার মায়েদের কষ্ট লাঘব হয়ে গেছে। বাজারে চলে এসেছে প্রচুর পাঞ্জাবি। কতই না বাহারি। কত বিচিত্র বর্ণিল, কাপড়েও ব্যতিক্রম। কী ঈদে কী নববর্ষবরণের উৎসবে এখন রীতিমতো পাঞ্জাবির হাট বসে যায়। যার সামর্থ সামান্য, তারও চাই একখানা পাঞ্জাবি। অন্তত একটা। অথচ একটা পাঞ্জাবিতে মন ভরার কোনো সুযোগই নেই আজকাল। এখনকার বাচ্চারা ইন্টারনেট থেকে নিজের পছন্দের পাঞ্জাবিটা খুলে মেলে মাকে সরাসরি ‘অর্ডার’ দিচ্ছে মোরুমে গিয়ে কিনে আনার। অনেক মা আবার এক কদম এগুনো। তক্কে তক্কে থাকেন। সুযোগ পেলেই ছেলেটিকে পাঞ্জাবির ফ্যাশন মডেল বানিয়ে ফেলেন। ফ্যাশন হাউসের যদি এক মডেলে না হয় তবে নিকটাত্মীয় কিংবা বান্ধবীর শরণাপন্ন হন তিনি। আমার স্কুলপড়–য়া ছেলেটি এভাবে একদিন পাঞ্জাবির মডেল হয়ে গেল। সেই ছবি রীতিমতো ছাপা হয়ে গেল নামী পত্রিকায়। বাচ্চারা এটাকে ‘ফান’ হিসেবেই নিল। কিন্তু মায়েরা? তারা সিরিয়াস। তাদের গল্প আর গৌরব যেন ফুরোতেই চায় না। আমি ভাবি আমাদের ছেলেবেলার কথা। মা কিংবা আমি কেউ কি এসবের কিছু বুঝতাম? তবে বড় হয়ে একবার মডেল হয়েছিলাম পাঞ্জাবির। কবি শামীম আজাদ তখন দেশে ফ্যাশন প্রতিযোগিতার প্রধান পরিকল্পনাকারী। রোজার ঈদের আগে সে কী হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। ঠিক হলো সেবার মডেল আর অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি কয়েকজন কবিকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে ফ্যাশন মডেল হিসেবে। কবি শামসুর রাহমান তো আগে থেকেই ছিলেন সেলিব্রিটি। ফ্যাশন আইকনও বলা যাবে তাঁকে পাঞ্জাবিপরা দুয়েকটা ছবি ছাপা হওয়ার পর। সে যাক। বরং ছেলেবেলার কথা এরকটু বলে নেয়া যাক।
পাঞ্জাবি যে একটা পোশাকের নাম সেটা প্রথম শুনি আম্মার হাতে পাঞ্জাবির মাপ দেয়ার সময়। করাচিতে আমি বাংলা স্কুলে পড়লেও দুয়েকজন খেলার সাথী জুটে গেছে পাঞ্জাবিভাষী। আমরা বাংলা বলি, ওরা পাঞ্জাবি বলে। ছোটবেলায় এটুকু বুঝতাম। পরে বড় হয়ে জেনেছি এটি ভারতের পাঞ্জাব অঙ্গরাজ্যের প্রায় ৩ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। পশ্চিম পাঞ্জাবি বা লান্দা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের প্রায় ৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। কানাডায় আড়াই লক্ষেরও বেশি লোক পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন; ফলে এটি কানাডার ৬ষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্থান-মাহাত্ম্য। আবার একই পোশাকের নাম বদলে যায় স্থানভেদে। যেমন বাঙালির পাঞ্জাবি উত্তর-পশ্চিম ভারতে গিয়ে হয়েছে ‘বাঙালি’। পাঞ্জাবিদের কুর্তা বঙ্গদেশে এসে নাম বদলে হয়েছে পাঞ্জাবি। অবশ্য কেবল নামই নয়, বদলেছে এর আঙ্গিকও।
কবিদের পাঞ্জাবি বিষয়ে ফেরা যাক। কবিমাত্রেই পাঞ্জাবি পরবেন বা পছন্দ করবেন এমন কোনো কথা নেই। তবে পাঞ্জাবি পরলে কবি-কবি ভাব একটু চলে আসে বৈকি। কবিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন দু’ধরনের ব্যক্তিদের ভেতর পালাপার্বনে পাঞ্জাবি পরার প্রবণতা দেখি বেশি। একদল আবৃত্তিকার, আরেকদল আছেন কবি হিসেবে যাদের পরিচিতি গড়ে ওঠেনি অথচ কবিপনা প্রদর্শনের জন্য অস্থির। তাই বলে কি সাচ্চা কবিরা পাঞ্জাবি পরা বাদ দিয়েছেন? না, তা নয়। গ্রীষ্মপ্রধান এই আমাদের দেশে আরামদায়ক পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবি পরার অভ্যেস আছে অনেক কবিরই। তবে পোশাক নিজে পরলেও অন্যদের চোখ তা দেখে পড়ে এবং ভাবমূর্তি তৈরি করে নেয়। একসময় মানুষ অভ্যস্ত ছিলেন কবিদের এই পোশাকে দেখতে। সেটা অবশ্য ষাটের কবি পর্যন্ত বলবৎ ছিল। সত্তরের যাঁরা প্রধান ও পাঠকপ্রিয় কবি তাঁদের কাউকেই নিয়মিতভাবে পাঞ্জাবি পরতে দেখিনি। অনেককে জীবনে একবারের জন্যও ওই পোশাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সত্তরের দু’জন কবি ছিলন বেশ ফ্যাশনদুরস্ত: রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ত্রিদিব দস্তিদার। দু’জনেই অকালপ্রয়াত। এই দুই শ্মশ্রুধারী কবির পোশাকে আশাকে তরুণরা আকৃষ্ট হতো। জিনস-টিশার্ট দু’জনেরই পছন্দের ছিল। কিন্তু পাঞ্জাবি? না, এদের পছন্দের পোশাক ছিল না। তাঁদের এই পাঞ্জাবি-বিমুখতা দেখে মনে হতো সজ্ঞানেই তাঁরা পূর্ববর্তী প্রজন্মের দুই মার্কামারা পাঞ্জাবিঅলা সুপরিচিত কবিদের পোশাক-প্রভাব থেতে বেরিয়ে আসতে চান। ষাটের কোন দু’জন কবির কথা বলছি সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারবেন বহু পাঠক। হ্যাঁ নির্মলেন্দু গুণ ও মহাদেব সাহা। এককালের হরিহর আত্মার দুই বন্ধু পাঞ্জাবির সঙ্গে অবশ্য এক ধরনের পোশাক পরতেন না। নির্মলেন্দু গুণ পাঞ্জাবির সঙ্গে পাজামা ছাড়া কিছু পরেননি গোটা জীবনে, অপরদিকে মহাদেব সাহা পাঞ্জাবির সঙ্গে পায়জামা নয়, প্যান্ট পরতেন। তবে শীতে উভয়েই গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিতেন। বেশি ঠা-ায় অনেকটা হিজাব পরিহিত নারীর মুখের কিয়দংশ ছাড়া যেমন আর কিছুই নজরে আসে না, ঠা-ায় কাবু হলে কবি নির্মলেন্দু গুণ তেমনি মুখের সামান্য অংশ বাইরে রেখে চাদরে পুরোটা ঢাকা পড়েন। ভাঁজ করে পিঠের ওপর চাদর রেখে দেয়ার ব্যাপারটিও আছে তাঁর মধ্যে। লন্ডনে তাঁর সঙ্গে কবিতা উৎসবে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানকার শীতেও পাঞ্জাবি ছাড়া আর কিছু পরেননি। সঙ্গে সেই চাদর। আজকাল আল মাহমুদকে পাওয়া যাচ্ছে কড়া লাল পাঞ্জাবিতে। বইমেলায়, ঢাকা ক্লাবে, টিভি সেন্টারে সেই একই লাল পাঞ্জাবি! বলতেই হবে মানাচ্ছে বেশ। হয়তো কোনো তরুণী প্রশংসা করে থাকবেন, তাই পাঞ্জাবিটি গায়ে সেঁটে বসে গেছে! নানা ধরনের কাপড় কেটে একই ধাঁচের হালি হালি পাঞ্জাবি বানাতে দেখেছি ওমর শামসকে। নিউইয়র্কেও পাঞ্জাবিই তাঁর প্রধান পোশাক। মানতেই হবে পাঞ্জাবির ক্ষেত্রে টেকনিক এবং ম্যাটেরিয়ালের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। নানা পরীক্ষানীরিক্ষা হয়েছে, এককটি অভিনব নতুনত্ব এসে আগের চমৎকারিত্বকে ম্লান করে দিচ্ছে। শাদা ছাড়া যারা পাঞ্জাবি পরতে চান না, তাদের জন্য শাদার ভেতর শাদারই কারুকাজ এসেছে আর বুকের বোতাম লাগানোর ছোট্ট জায়গাটায় চড়া রঙে লম্বালম্বি ডিজাইন যুক্ত হয়েছে। ওইটুকুই রাঙিয়ে দিয়েছে যেন পুরোটাকে।
পাঞ্জাবির সঙ্গে ট্রাউজার- এই বিষয়ে পুরো ক্রেডিট দিতে হবে কবি শামসুর রাহমানকে। আরো একটা ব্যাপারে তিনি কবিদের ভেতর পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন বলতে পারি। সেটি হলো রঙিন কাপড়ে তৈরি ও বর্ণিল নকশাখচিত পাঞ্জাবি পরিধানে উদার হওয়ার জন্য। হালফ্যাশনের পাঞ্জাবি তাঁর গায়ে চড়ত নিয়মিত। তরুণতম পাঞ্জাবি-প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বীও তাঁকে বলতে পারি। শীতে পাঞ্জাবির ওপর হাতকাটা কোট ছাড়াও চাদর পরতেন। তবে তাঁর চাদর পরাররও স্টাইল ছিল, ডান হাতখানা চাদরের বাইরে রাখতেন। পাঞ্জাবি হোক বা অন্য পোশাক- দেখতে ভালো লাগার জাদু হচ্ছে মূলত ফিটিংয়ে এবং ব্যক্তির গায়ের রঙের সঙ্গে মানানসই কিনা সেই বিবেচনা। পাঞ্জাবির আবার কিসের ফিটিং, দু সাইজ বড় হলে আর কী এসে যায়- এমনটা যাঁরা ভাবেন ও পরেন, রুচিবানদের নজরে তাঁরা হয়ে উঠতে পারেন জবরজং। সচেতন ছিলেন বলেই কবি শামসুর রাহমানকে পাঞ্জাবিতে কী দারুণই না লাগত।
বলছিলাম আজকের দিনের কবিদের তেমন পাঞ্জাবিপ্রীতি নেই। কবিতার অনুষ্ঠানে শতকরা কুড়ি ভাগ কবিও পাঞ্জাবি পরে যান না। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে বিটিভিতে কবিতা পড়তে যাওয়া নিয়ে আশির দশকের এক কবি লিখেছেন : ‘যথারীতি টি-শার্ট পরেই গেলাম। যদিও, ‘শাদা বা কালো বাদে অন্য কোনো রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে আসবেন’ এ রকম করেই বিটিভি থেকে ফোনে বলা হয়েছিল। ফলে, আমার টি-শার্ট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করাতে পারিনি। শেষমেশ, রেকর্ডিংয়ের আগে বিটিভির নাট্যশিল্পীদের জন্যে ব্যবহৃত একটা পাঞ্জাবি পরতে হলো আমায়। হলুদ পাঞ্জাবি। ‘হিমুর পাঞ্জাবি’। পাঞ্জাবি পরেছি টি-শার্টের উপরেই...।’ দেখুন অবস্থা! ওই যে বলা হলো হিমুর পাঞ্জাবি, তেমনি গায়ে হলুদ আর বিয়ের পাঞ্জাবিও আছে। পাঞ্জাবির গায়ে একটা সীল মেরে দেয়া আরকি। বসন্ত বিদায় নিতে চলেছে, নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি চলছে। এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলাম কবিতা পাঠের জন্য। আয়োজকরা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে পকেটঅলা পায়জামা। সেটা পরে অনুষ্ঠানস্থলে যেতেই একজন টিপ্পনি কাটলেন, ‘কবির আজ কি গায়ে হলুদ!’ অন্যজন বললেন, ‘না, মনে হচ্ছে বিয়েই হবে।’ আমি তো লাজবাব!
-মারুফ রায়হান