করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





হোমারের জন্য প্রশস্তিগাথা
মাসরুর আরেফিন
যে সাহিত্যকে আমরা ‘পশ্চিমা’ সাহিত্য বলে জানি, তার শুরু এক দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়ে। সেই কবিতায় এখনকার গ্রিস নামের দেশ থেকে আসা যোদ্ধা বীরেরা বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম উপকূলে ট্রয় নামের প্রাচীনকালের এক বিখ্যাত শহর দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। অবশ্য খ্রিস্টপূর্ব সেই বারোশ শতকে—যখন ঘটে এই অবরোধের ঘটনা—‘পশ্চিম’ বা ‘পুব’-এর সংস্কৃতি বলতে কোনো আলাদা ধারণারই জন্ম হয়নি, তেমনই ‘গ্রিস’, ‘তুরস্ক’ এসব জাতি-রাষ্ট্রের নামেরও  কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইলিয়াড যখন গাথা হয়—প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসের খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ থেকে ৫৬৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে—তখন ভূমধ্যসাগরের পুব ও পশ্চিমের জাতিগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজনকেন্দ্রিক কোনো চেতনারই সূচনা ঘটেনি। ভূমধ্যসাগরের ডানে ও বাঁয়ে তখন মানুষ, গল্পকাহিনী, সঙ্গীত, বাণিজ্যিক পণ্য, ছবি আঁকার প্রকরণ—এ সবই পাশবদল করছে সহজে, এর সঙ্গে ও গিয়ে মিশে যাচ্ছে অবারিতভাবেই। এরই মধ্যে একদিন দক্ষিণ থেকে গ্রিকরা এসে হাজির হলো ভূমধ্যসাগরের পুব দিকে, ইলিয়াম (ট্রয়ের প্রাচীন নাম) নামের বিখ্যাত নগরটির কাছের সমুদ্র উপকূলে। সৃষ্টি হলো ‘ইলিয়ামকে নিয়ে গান’ বা ইলিয়াড শীর্ষক এক গীতিকাহিনীর—বেদনাদীর্ণ, জীবন্ত আর সোজাসাপটা বলা এক ট্র্যাজিক আখ্যানের। আজও ইলিয়াড, তিন হাজার বছর পরেও, জ্বলজ্বল করছে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যকর্মের তালিকার একদম ওপরের দিকে, প্রায়শই প্রথম স্থানে।
ইলিয়াড-এর এই সাফল্য আসলেই বিস্ময়কর, কারণ এই দীর্ঘ কবিতা (যাকে বলা হয় এপিক বা মহাকাব্য) না পাঠ করা সহজ, না এর কাহিনী কোনো মজাদার কিছু। প্রাচীনকালেও শ্রোতাদের সংগ্রাম করতে হতো স্রেফ এর ভাষা বুঝতে গিয়ে, আর দীর্ঘ পাঠসন্ধ্যার মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়তো অনেকে। কিন্তু ইলিয়াড-এর শব্দচয়ন ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কিত ‘সমস্যা’ তারপরও অকিঞ্চিৎকর থেকে গেছে আমাদের হৃদয় ও মনে এই কাহিনী ও এর বুনন যে ঝংকার তোলে, তার সাপেক্ষে। এই মহাকাব্য কোনো প্রাক্কথন, কোনো ভান-ভনিতা ছাড়াই আমাদের—এক ক্ষমাহীন স্বচ্ছতায়—ধুম করে দাঁড় করিয়ে দেয় এমন সব বিষয়ের মুখোমুখি যেগুলো আমরা বরং ভুলে থাকতে পারলেই খুশি হতাম: নেতৃত্বের ব্যর্থতা, সৌন্দর্যের বিধ্বংসী শক্তি, যুদ্ধের নির্মম-নৃশংস চেহারা, মানুষের ‘সর্বসেরা’ হওয়ার প্রতিযোগিতা—এবং সর্বোপরি—মৃত্যু নামের আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি। ইলিয়াড যে আজও এতো বিশাল জনপ্রিয় (নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত রবার্ট ফ্যাগলস্-এর ইংরেজি ইলিয়াড বিক্রি হয়েছিল ৩ মিলিয়ন কপি; আর শুধু ইংরেজিতেই ইলিয়াড-এর অনুবাদ আছে প্রায় ৩১৫টি) এক সাহিত্যকর্ম, সেটাই সাক্ষ্য দেয় এর অসীম শক্তির।

ইলিয়াড ইউরোপিয়ান সাহিত্যের শুধুমাত্র প্রথম কীর্তিই নয়, এর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিরও যোগ্য দাবিদার।১ ইলিয়াড-এর প্রভাব শুধুমাত্র পরবর্তীকালের গ্রিক সাহিত্য, চিন্তা, শিল্পকলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেইসঙ্গে যা কিছু ইউরোপিয়ান ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় বিষয়, তার সবকিছুতেই গিয়ে পড়েছে—এতোটাই যে, ইলিয়াডকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায় পুরো পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর।২
একইরকম কথা বলেন হ্যারল্ড ব্লুম, যিনি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্য বিশ্লেষক ও বোদ্ধাদের প্রথম কাতারের একজন। ব্লুম বলেন: ‘বাইবেল ও ইলিয়াড-এর মধ্যেই আছে পশ্চিমা সাহিত্য, চিন্তা ও আধ্যাত্মিকতার—আরও বৃহৎ অর্থে বললে পুরো পশ্চিমা সংস্কৃতিরই—ভিত্তি’।৩ সেই সঙ্গে ইলিয়াড-এর প্রধান চরিত্র অ্যাকিলিস সম্বন্ধে ব্লুমের মন্তব্য: ‘আর কোনো পুরোপুরি সাহিত্যিক চরিত্রই এতখানি বীরত্বব্যঞ্জক নয়, নান্দনিক বিচারে অ্যাকিলিসের মতো এতোটা সন্তোষজনক নয়।’৪
আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল, যিনি সবসময়েই কোনোকিছু মজা করে লিখতে সিদ্ধহস্ত, খুশি যে, ‘যে দুটো বই (হোমারের ইলিয়াড ও অডিসি) অন্য যে কোনো বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদের কল্পনা-ক্ষুধা মিটিয়ে গেছে আজ আড়াই হাজার বছর যাবত, সে দুই বইয়ের যে কোনো স্পষ্ট শুরুর ইতিহাস ও কোনো পরিষ্কার স্রষ্টা থাকবে না, তা-ই তো স্বাভাবিক’।৫
এখানেই ম্যাঙ্গুয়েল উসকে দিয়েছেন ইলিয়াড-এর স্রষ্টা ও এর রচনার ইতিহাস সম্পর্কিত বিরাট প্রশ্নটিকে, যার নাম ‘Homeric Questions’: ট্রোজান যুদ্ধ আসলেই কি ঘটেছিল, হোমার নামের কেউ কি সত্যিই এ দুই মহাকাব্যের স্রষ্টা? ইত্যাদি। হোমারের আগেও যে হোমার ছিলেন, সেসব প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব এই ‘ভূমিকা’ অংশেই। এখানে শুধু খ্যাতিমান ফরাসি ঔপন্যাসিক, কবি রেঁম কুইনোর (Raymond Queneau; ১৯০৩-১৯৭৬) এক বিখ্যাত উক্তির উল্লেখ করছি, যা আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল ব্যবহার করেছেন তার বইটির একদম শুরুতে। গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের মৃত্যু-উত্তর প্রকাশিত ব্যঙ্গধর্মী অসম্পূর্ণ উপন্যাস Bouvard et Pecuchet -এর (‘বুভা এ পেকুশে’, ১৮৮১) মুখবন্ধে কুইনো লিখেছিলেন: ‘যে কোনো মহান সাহিত্যকর্মই হয় ইলিয়াড, না হয় অডিসি।’৬ কুইনো-র ভাষ্য ছিল অনেকটা এরকম: ইলিয়াড-এর কেন্দ্রে আছে মানুষের নশ্বরতার বোধ এবং মানব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, রক্তপাত ও যুদ্ধ; আর অডিসির কেন্দ্রে মানুষের ঘরে ফেরার আকাঙ্খা। একটির মূল কথা ‘জীবন এক যুদ্ধের নাম’, আরেকটির ‘জীবন এক সফরের নাম’। আর এ দুটি বিষয়ই যেহেতু মানবজীবনের সবচেয়ে আদি ও অকৃত্রিম দুই মেটাফর (রূপক অর্থে), তাই আশ্চর্য কী যে, যে কোনো ভালো সাহিত্যকর্মই হয় হবে ইলিয়াড, না হয় অডিসি?
এরপরেই আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল দাবি করে বসলেন, পৃথিবীর খ্যাতিমান বা ভালো প্রত্যেক লেখকই ইলিয়াড এবং অডিসি দিয়ে অনুপ্রাণিত; অন্য কথায়: ‘ইলিয়াড ও অডিসি পড়া ব্যতীত কেউ ভালো লেখক, কবি হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়।’ ম্যাঙ্গুয়েলের কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে অবশ্যই, কারণ এ-কথা বলার সময়ে পৃথিবী বা বিশ্বসাহিত্য তার কাছে যতটা বড় বলে মনে হয়েছিল, তার থেকে বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি বড় বটে। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুগে যুগে ইলিয়াড প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে গেছে বিশ্বসাহিত্যের সেরা সব লেখক-কবিকে। আগেই বলেছি, ইলিয়াড-এর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে এ-পর্যন্ত প্রায় ৩১৫টি, যার শুরু সেই ১৫৯৮ সালে, জর্জ চ্যাপম্যানের হাতে। চ্যাপম্যানের ইলিয়াড নিয়েই পরে ১৮১৭ সালে কবি জন কিটস্ (১৭৯৫-১৮২১) লিখলেন তার অমর কবিতা ‘On First Looking into Chapman’s Homer’, যার প্রথম চার পঙ্ক্তি আমাদের অনেকেরই মুখস্থ হয়ে আছে:

‘Much have I travell’d in the realms of gold,
And many goodly states & kingdoms seen:
Round many western islands have I been
Which bards in fealty to Apollo hold.’

আর এর পরের বছরেই আরেক বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলী (১৭৯২-১৮২২) অনুবাদ করলেন Homeric Hymns (‘হোমেরিক স্তোত্রগীত’)। এর একশ বছর আগে আলেকজান্ডার পোপ ইংরেজিতে ইলিয়াড (১৭১৫) ও অডিসি-র (১৭২৬) অনুবাদ করে তো ইংরেজি কবিতার মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, এতটাই যে, আজও শ্রেষ্ঠতম ইংরেজি কবিতার যে কোনো সংকলনে দেখা মেলে বিশেষত পোপের ইলিয়াড-এর অনবদ্য কিছু অংশের।

কে হাত দেয়নি ইলিয়াডে? শেকস্পিয়ারের ট্রয়লাস ও ক্রেসিডা নাটকটি ইলিয়াড-এর কিছু চরিত্রেরই ছায়ায় গড়া। গবেষকেরা বলেন, তিনি লাতিনে ওভিদ পাঠ করে ইলিয়াড-এর কথা জেনেছিলেন, কিংবা তিনি চ্যাপম্যানের ইলিয়াড পড়েছিলেন। তার ট্রয়লাস ও ক্রেসিডা-র সৃষ্টি হয় ১৬০২ সালে, অর্থাৎ চ্যাপম্যানের ইলিয়াড প্রকাশের চার বছর পরে। কবি জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০) তো ইলিয়াড-এর বেশ কয়েকটি পর্বের জনপ্রিয় অনুবাদই বের করেছিলেন মৃত্যুর কিছুদিন আগে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিখ্যাত কবি, লেখকদের মধ্যে ইলিয়াড ও অডিসি নিয়ে কাজ করেছেন এমন আরও কিছু উজ্জ্বল তারকার নাম: দার্শনিক টমাস হবস্ (ট্রাভেলস্ অব ইউলিসিস, ১৬৭৩; এবং পরে ‘হোমার সমগ্র’); উইলিয়াম কুপার (১৭৩১-১৮০০; যিনি আলেকজান্ডার পোপের অপার সৃজনশীল ইলিয়াড-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন: ‘I have omitted nothing; I have invented nothing’—যে উক্তি আজও উচ্চারিত হয় সাহিত্যে ‘অনুবাদ’ বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায়); চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪; অডিসি-র সংক্ষেপিত অনুবাদ); আলফ্রেড লর্ড টেনিসন (১৮০৯-১৮৯২; যার The Lotos-Eaters এবং Ulysses আমাদের সাহিত্য পাঠে হোমার-অভিজ্ঞতার শীর্ষবিন্দুর কাছাকাছি অবস্থান করছে আজও); ম্যাথু আরনল্ড (১৮২২-১৮৮৮; নিজেও হোমার অনুবাদক এবং একইসঙ্গে হোমার অনুবাদ বিষয়ক সবচেয়ে বিখ্যাত বিধিমালার প্রবক্তা); রবার্ট ব্রাউনিং (১৮১২-১৮৮৯); স্যামুয়েল বাটলার (১৮৩৫-১৯০২); এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২); ডি. এইচ. লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০); টি. ই. শ বা ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ (১৮৮৮-১৯৩৫; যার অনুবাদে অডিসি আজও পাঠকের হাতে হাতে ঘোরে); ডব্লু. এইচ. অডেন (১৯০৭-১৯৭৩; যার ১৯৫২ সনে লেখা কবিতা ‘ঞযব The Shield of Achilles’ আজও মহত্তম ইংরেজি কবিতারই একটি); এবং রবার্ট গ্রেভস্ (১৮৯৫-১৯৮৬; যার ইলিয়াড অনেক খ্যাতি অর্জন করে প্রথমবারের মতো এই মহাকাব্যের সার্বিক আনন্দের দিকটিতে জোর দেবার জন্য)।
এ-তো গেল নামকরা ইংরেজি ভাষার ক্লাসিক্যাল যুগপর্বের কবি-লেখকদের তালিকা, যারা হোমার নিয়ে কাজ করেছেন, হোমারে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এই নামগুলোরই একদম উপরের দিকে বসবে আরও দুটি নাম—একটি জেমস্ জয়েসের, অন্যটি ডেরেক ওয়ালকটের। জয়েসের উপন্যাস ইউলিসিস (১৯২২) স্বীকৃত হয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস হিসেবে। তার এই ইউলিসিস-এর সর্বত্রই—প্রায় প্রতিটি পাতাতেই, প্রতিটি অধ্যায়ের নামেই—আছেন হোমার। প্রসঙ্গত, ইউলিসিস হোমারের ইলিয়াড-এর অন্যতম নায়ক, এবং অডিসি-র প্রধান নায়ক বীর অডিসিয়ুসেরই লাতিন নাম। আর ডেরেক ওয়ালকট ১৯৯০ সালে প্রকাশ করলেন তার আধুনিক মহাকাব্য ওমেরস (যা হোমারের গ্রিক নাম; গ্রিকরা হোমারকে বানান করে Homeros, আর উচ্চারণ করে ওমেরস)। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা ওয়ালকটের এই অ্যাকিলিস-হেক্টর-হেলেনের উত্তরাধুনিক মহাকাব্য তাকে দুবছর পরে, ১৯৯২ সালে, এনে দিল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
এর বাইরে বিশ শতকের অন্যতম প্রধান গ্রিক ঔপন্যাসিক, জোরবা দি গ্রিক-এর লেখক নিকোস কাজানৎজাকিস ১৯৩৮ সালে প্রকাশ করলেন তার সুদীর্ঘ মহাকাব্য, দৈর্ঘ্যে যা হোমারের অডিসির প্রায় তিনগুণ, ‘দি অডিসি—এ মডার্ন সিক্যুয়েল’। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা কীর্তিটি নতুন যুগে, নতুনভাবে সামনে এলো পাঠকের, হোমারেরই স্বদেশী আরেক গ্রিকের হাত ধরে।
আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে হোমার বিষয়ক বা হোমারে অনুপ্রাণিত লেখা লিখেছেন আরও অনেকেই (নামগুলি এখানে দেওয়া হলো কোনো জন্মসাল বা বড়-ছোট ইত্যাদি ধারাক্রম না মেনে): যেমন গ্রিক কবি সি. পি. কাভাফি (তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘ইথাকা’, যার পেছনে আছে অডিসিয়ুসের ঘরে ফেরার সংগ্রামমুখর বিষয়টি); ফরাসি লেখিকা মারগারেট ইয়োরসেনার; ভার্জিনিয়া উলফ (তার ১৯২০ সালের প্রবন্ধ ‘The Intellectual Status of Women’ অডিসি-র স্রষ্টা যে হোমার নন বরং কোনো নারী কবি, এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেয়); এইচ. জি. ওয়েলস; ইতালো কালভিনো; এমিলি জোলা; জর্জ বার্নার্ড শ; ওয়ালেস স্টিভেনস; মিগেল দি উনামুনো; মারিও বার্গাস ঝোসা; হোরহে লুইস বোরহেস (যার গল্প ‘The Immortal’-এর মূল নায়ক হোমার নিজে); এডগার অ্যালান পো; ফ্রানৎস কাফকা (যার একটি বিখ্যাত অণুগল্প আছে ‘The Silence of the Sirens’ নামে; সাইরেনরা হোমারের অডিসি-র জলপরী); লিও টলস্টয়; গেয়র্গ লুকাচ (তার প্রবন্ধ ‘To Narrate or Describe?’ হোমার বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য); রুডইয়ার্ড কিপলিং; ইসমাইল কাদারে; আন্দ্রে মালরো; ভøাদিমির নবোকভ; ফ্রেডেরিখ নিট্শে; মার্গারেট অ্যাটউড (পেনোলপিয়াড-এর লেখিকা, যার পেনেলোপি আমাদেরকে স্বামী অডিসিয়ুসের বিশ বছর ধরে ঘরে না থাকার ভাষ্য শোনায় স্ত্রীর জবানিতে); আলেসান্দ্রো বারিক্কো (সিল্ক উপন্যাসের বিখ্যাত এ-লেখক নতুন করে লেখেন ইলিয়াড, কাহিনীটি এর চরিত্রগুলির ভাষ্য দিয়ে ঢেলে সাজিয়ে, ২০০৪ সালে); জাঁ জিরাদু; গ্যেয়টে; ডরিস লেসিং; জোসেফ ব্রডস্কি; পল ভেরলেইন প্রমুখ। স্থানের অভাবে যেহেতু এই লেখক-কবি-দার্শনিকদের হোমার বিষয়ক লেখালেখি-গবেষণা-উক্তিগুলোর এখানে কোনো বিবরণ দেওয়া হচ্ছে না, তাই এ-তালিকা দীর্ঘ করারও আর প্রয়োজন দেখি না। এই তালিকায় গ্যেয়টে থেকে শুরু করে জর্জ বার্নার্ড শ, বোরহেস থেকে নিয়ে গেয়র্গ লুকাচ—এদের সবার উপস্থিতি কিছুটা হলেও সাক্ষ্য দেয় যে আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েলের দাবিটির মধ্যে (ইলিয়াড ও অডিসি না পড়ে কেউ ভালো লেখক, কবি হতে পারেননি) সামান্য হলেও সত্যতা আছে। মাত্র চব্বিশ-পঁচিশজনের নাম এখানে তুলে ধরলাম আমি, ম্যাঙ্গুয়েলের দেওয়া একশ-র অধিক নামের বিপরীতে।
এ-তো গেল আধুনিকদের কথা। প্রাচীনকালের দিকে যদি তাকান, তবে দেখবেন হোমার প্রসঙ্গে কথা বলেছেন হেরোডোটাস থেকে শুরু করে সাধু লন্জাইনেস (Longinus) পর্যন্ত বিদগ্ধ, বিখ্যাত সবাই। প্লেটো বলেছিলেন: ‘হোমার অ্যাকিলিসকে চেয়েছিলেন ট্রয়ে আসা মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাহসী করে দেখাতে, আর নেস্টরকে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান এবং অডিসিয়ুসকে সবচেয়ে ধূর্তবুদ্ধির’।৭ প্লেটো অবশ্য তার রিপাবলিক গ্রন্থে সাহিত্য বিষয়টিকে (আর প্লেটোর কাছে হোমারই ছিলেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতিভূ) গালমন্দ করেছেন যেহেতু তা ‘অন্যের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে বেশি ভাবাভাবি করে,’ এবং প্রশংসা করে ও দয়া দেখায় এমন কাউকে যে কিনা ‘নিজেকে দাবি করে ভালো মানুষ হিসাবে, কিন্তু আবার দুঃখশোক প্রকাশের বেলায় নিজেকে ছেড়ে দেয় বাড়াবাড়ির হাতে।’ প্লেটো বলেন, ‘আমাদের ভেতরকার এই দিকটাই কবিরা তৃপ্ত করে, এটার চর্চাতেই কবিদের আনন্দ,’ এবং একে এড়ানোর স্বার্থেই আমাদের উচিত ‘কবিতাকে পুরোপুরি ঘৃণা করা’। এই প্লেটোই আবার হোমারকে পছন্দ করতেন বললে কম বলা হবে, তিনি রীতিমতো পূজো করতেন হোমারের। প্লেটোর সংলাপে (Dialogue) মোট ৩৩১ বার রেফারেন্স আছে হোমার ও তার দুই মহাকাব্যের। এরই একটিতে আমরা দেখি এক শিষ্য সক্রেটিসকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘সক্রেটিস, আপনি নিজে কি কবিতার জাদুকে অনুভব করেন না, বিশেষ করে যদি হোমার হন কাব্যদেবীর বাহন?’ সক্রেটিসের উত্তর: ‘বিরাটভাবে করি।’ প্লেটোর সংলাপের মধ্যেই আছে হোমারকে নিয়ে এ-যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রশস্তিসূচক বাক্যটি। প্লেটোর ভাষ্যমতে কথাটা বলেছিলেন সক্রেটিস; তিনি বলেছিলেন, হোমার হচ্ছেন, ‘সবার থেকে সেরা এবং সবচেয়ে স্বর্গীয়।’
হোমারকে একইভাবে ‘স্বর্গীয়’ এবং হোমার পাঠকে ‘ঐশ্বরিক অনুভূতি’ বলেছেন শ্রেষ্ঠতম জার্মান কবি গ্যেয়টেও। ১৭৯৯ সালে গ্যেয়টে শুরু করলেন তার অসম্পূর্ণ কবিতা ‘অ্যাকিলিস’ লেখা, উদ্দেশ্য ছিল মহাকাব্য লেখার জন্য ‘আইডিয়ার সন্ধান’ করা। গ্যেয়টে লিখলেন: ‘ইদানীং আমি সবকিছু থেকে দূরে আছি ইলিয়াড অধ্যয়ন করবো বলে; এটুকু দেখতে যে ইলিয়াড ও অডিসি-র মাঝখানে কোনো মহাকাব্যিক গল্প লুকিয়ে আছে কি-না। তবে আমি শুধু ট্র্যাজিক বিষয়-আশয়ই দেখতে পাচ্ছি।...অ্যাকিলিসের জীবন যেভাবে শেষ হলো আর সে জীবনের যে পশ্চাৎপট, তা ফুটিয়ে তোলার জন্য মহাকাব্যিক ভঙ্গিমারই আশ্রয় নিতে হবে।’৮ গ্যেয়টের কাছে হোমার ছিলেন ‘কবি’-দের আদিমতম ও পরমতম সত্য এক রূপ, যে কবি প্রথমে বুকে ধারণ করেন তার জনগণের সত্যকে এবং তারপরে পাঠকের বা শ্রোতার সামনে ফুটিয়ে তোলেন সুদূর এক ভবিষ্যৎকালের মানব-মানবীদের জীবনের সত্যগুলো। হোমারের মতো শিল্পীরা, গ্যেয়টে বিশ্বাস করতেন—তা তারা রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে থাকুন আর একটি জাতির চেতনার অন্তর্গত কাব্যিক শক্তির রূপকই হয়ে থাকুন—বাস করেন সময়ের নিয়মের ও রীতির বাইরে, কারণ তারা স্বর্গীয় বা ঐশ্বরিক সত্তা, মানুষ ও দেবতাদের মধ্যেকার কথাবার্তার অনুবাদক ও বাহক।৯ গ্যেয়টের হিসাবে, এই স্বর্গীয় হোমার প্রত্যেক প্রজন্মের জন্য সাংস্কৃতিক মুক্তির আস্বাদ পাবার সম্ভাবনা রাখে, ঠিক যেমন গ্যেয়টে নিজে হতে চাইতেন জার্মান জাতির জন্য। এ দুই কবির মধ্যেকার সম্পর্কের কথা বলতে গিয়েই সাহিত্যের ইতিহাসবিদ আরনস্ট রবার্ট কার্টিয়াস পরে ঘোষণা করলেন: ‘ইউরোপিয়ান সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা নায়কের নাম হোমার। আর এর শেষ সর্বজনীন লেখকটির নাম গ্যেয়টে।’১০

অ্যারিস্টোটল বলেছিলেন: ‘মহাকাব্যকে হতে হবে...সহজ বা জটিল, চরিত্রের বিশিষ্টতার বা মানুষের দুর্দশার গল্প।... শেষে, এর ভেতরের চিন্তা ও শব্দচয়ন হতে হবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর। এই সব উপাদানই প্রথম দেখা যায় হোমারে; তিনি এগুলোর কার্যকর ব্যবহারও করেছেন বটে। তার দুটি কাব্য...ইলিয়াড সরল ও এর গল্পটি মানুষের দুর্গতির; এবং অডিসি জটিল, আর এটা চারিত্রিক বিশিষ্টতারই এক কাহিনী। এ দুটি আসলে এর চেয়েও বেশি কিছু, যেহেতু শব্দচয়ন ও চিন্তার বিচারেও তারা অন্য সব কাব্যকে ছাড়িয়ে যায়।’১১
আর সাধু লন্জাইনেস তার আনুমানিক প্রথম খ্রিস্টাব্দে লেখা প্রবন্ধ ‘On the Sublime’-এ বলেছিলেন: ‘ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাস একাই কি হোমারের এরকম বিমুগ্ধ অনুকরণকারী ছিলেন? না। তার আগে স্টেসিকোরাস, আরকিলোকাস ও সর্বোপরি প্লেটো—এরা সবাই অনুকরণ করতেন হোমারকে। প্লেটো হোমারের মহান উৎসমুখ থেকে নিজের দিকে টেনে নেন অগণন জলপ্রবাহকে।’১২
আর কে না জানে যে ভার্জিল তার মহাকাব্য ঈনিদ (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৩০-১৯ সন) লিখেছিলেন সরাসরি হোমারেরই অনুকরণে? ভার্জিলকে বলা হয় ‘হোমারের সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র’। পুরো লাতিন সাহিত্যের ওপরে হোমারের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী ও নিরঙ্কুুশ। তার ইলিয়াড-এর ট্রোজান বীর ঈনিয়াস ট্রয় যুদ্ধের শেষে ট্রয় থেকে পালিয়ে চলে গেল ইতালি, প্রতিষ্ঠা করল রোমান সাম্রাজ্যের, জুলিয়ান বংশের প্রথম পুরুষ হলো সে, আর ইতালীয়রা পেয়ে গেল তাদের ন্যাশনাল এপিক—ভার্জিলের ঈনিদ-এর (‘ঈনিয়াসের গান’) মধ্যে।
 হোমার অনুপ্রাণিত হয়ে পরে দান্তে লিখলেন তার মহাকাব্য ডিভাইন কমেডি, যেখানে আমরা দেখা পাবো ইলিয়াড-এর বেশ কিছু চরিত্রের; তারা এখন দান্তের নরকের বাসিন্দা। দান্তে তার এই অমর কীর্তিটি লেখেন ট্রোজান যুদ্ধের আড়াই হাজার বছর পরে, ১৩০৮ সালের দিকে, আর আমরা দেখে অবাক হয়ে যাই দান্তের এই মধ্যযুগীয় পৃথিবীতে মৃত্যুর পরের যে জীবনের গল্প বলা হয়েছে সেটা থেকে হোমারের বলা মৃত্যুদেব হেডিসের জগতের ফারাক কতোটা কম, তা লক্ষ্য করে। কথিত আছে, আলেকজান্ডার দি গ্রেট (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬-৩২৩ সাল) যেমন তার পারস্য ও ভারতবর্ষ অভিমুখী দীর্ঘ সামরিক অভিযানগুলোতে হোমারের ইলিয়াড-এর কপি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন এবং প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পাঠ করতেন, তেমন দান্তে গ্রিক না জানা থাকার ফলে হোমার পড়তে পারেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি যেহেতু জানতেন যে ভার্জিলের ঈনিদ হোমার অনুপ্রাণিত এবং ঈনিদ-এর মধ্যে পুরোপুরি হাজির আছেন হোমার, তাই তিনি ঈনিদ-এর কপি নাকের সামনে ধরে শুঁকতেন হোমারের স্বাদ গন্ধ নেবার জন্য।১৩
অন্য গবেষকদের অভিমত, দান্তে ও তার সমকালীন কবিরা এই দীর্ঘ শতাব্দীর বিশ্বাসকে মেনে নিয়েছিলেন যে হোমারই ‘সর্বকালের সেরা কবি’। তারা সম্ভবত লাতিন অনুবাদে হোমার পড়েছিলেন জনপ্রিয় Ilias Latina পাঠ করার মধ্য দিয়ে, যার লেখক (অনুবাদক) ছিলেন অজ্ঞাত, এবং যা লাতিনে ভাষান্তর হয়েছিল ১ম খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে।১৪ পেত্রার্ক পূজো করার মতো করে হোমারের ইলিয়াড-এর গ্রিক পা-ুলিপিটি পাশে রাখতেন সবসময়, কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি গ্রিক জানতেন না। কনস্টান্টিনোপল থেকে তার যে বন্ধু তাকে এই গ্রিক ইলিয়াড পাঠায়, তাকে পেত্রার্ক উত্তরে লেখেন: ‘তোমার হোমার আমার পাশে বোবা হয়ে শুয়ে আছে, আর আমি শোওয়া তার পাশে বধির হয়ে। প্রায়ই আমি বইটাকে চুমু খাই আর বলি: “হে মহান লেখক, আহা আমি যদি তোমার কথাগুলো একটু শুনতে পেতাম”’।১৫ পরে পেত্রার্কের উপদেশ মোতাবেক এবং বোক্কাচিও-র সহায়তা নিয়ে তাদের দুজনের বন্ধু লিওনসিও পিলাতো লাতিনে প্রথম ইলিয়াড ও অডিসি-র অনুবাদ করেন, যা মানের দিক থেকে ছিল যথেষ্ট নিম্নস্তরের।১৬
শুধু মধ্যযুগের দান্তেই নন, পরে সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি জন মিলটন (১৬০৮-১৬৭৪) লিখলেন তার অমর মহাকাব্য Paradise Lost । ১৬৬৬ সালে প্রকাশ হওয়া এই বারো পর্বের দীর্ঘ কাব্যটি শুরুই হয় হোমারের ইলিয়াড-এর শুরুর মতো স্মৃতি ও কাব্যের দেবী মিউজের প্রতি আবাহন রেখে। বাইবেল অনুসারে মানুষের স্বর্গ থেকে পতনের এই অনবদ্য কাব্যের পরতে পরতে বিদগ্ধ পাঠক খুঁজে পান হোমার ও ভার্জিলের ছায়া।

চলবে...