করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





নীড় ছোট,ক্ষতি নেই
কেকা অধিকারী
বুকটা আমার ধক্ করে উঠল। তারপর অকষ্মাৎ কষ্টে সমস্ত অন্তরাত্মা কুঁকড়ে গেল - যেন দীঘির জলে খেলে বেড়ানো মাছটি এইমাত্র কোচবিদ্ধ হয়েছে। ঠিক এমনই সুতীব্র যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আজ থেকে বাইশ বছর আগে। কী আশ্চর্য সেদিনের সে সময়টাও ছিল এমনই দ্বিপ্রহর! সেদিনও আমার শরীরটা অবশ হয়ে গিয়েছিল, মাথাটাকে মনে হচ্ছিল একদম ফাঁকা। আচ্ছা, হার্ট অ্যাটাক হলে কি মানুষের এমন লাগে? আজকের দৈনিকের ছোট্ট খবরটি আমাকে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিলে বুকে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করলাম। ‘শোক সংবাদ’-এর নীচের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি আমার সেই দিয়া আপার- জেসমিন চৌধুরী দিয়ার। কার কাছে যেন শুনেছিলাম সব বাধা পেরিয়ে দিয়া আপা আর শিমুলদা ঘর বেঁধেছিলেন। তাহলে শিমুলদা কেমন আছেন এখন? আর ছেলে-মেয়েরা? মৃত্যু-সংবাদটি আমার দেহটাকে অসাড় করে দিলেও মনটা ছুটছে রাখালের দড়ি-ছেঁড়া এঁড়ে বাছুর হয়ে স্মৃতির প্রান্তরে।
নাটকীয় ভাবে এই দিয়া আপাই আমার প্রথম অ্যাটাকের জন্যে দায়ী ছিলেন, যদি তাকে আদৌ অ্যাটাক বলা যায়। আজ এতো বছর পর দ্বিতীয়টির কারণও তিনি। অবশ্য দু’বারই কাজটি তিনি করলেন নিজের অজান্তে - একবার অস্তিত্ব জানান দিয়ে, আরেকবার চিরতরে তা মুছে দিয়ে। অন্তরে ব্যাথাবোধে মিশে আছে বিষ্ময় - আজও তাহলে আমি হৃদয়ের গহীনে প্রথম বারের যন্ত্রণাটা বয়ে বেড়াচ্ছি! তাই কি এতো সহজে সেদিন আর আজকের যন্ত্রণার তুলনা করতে পারলাম?    
বলা বাহুল্য, কোন বিচারেই সেদিন আর আজ এক নয়। সময়ের প্রলেপ ঢেকে দিয়েছে অনেক কিছু, বদলে গেছে জীবনের দৃশ্যপট। দিনটি বর্ষার না বসন্তের ছিল মনে নেই। তখনও আমার পড়াশোনা চলছে। একটি অফিসের গবেষণা কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পার্ট-টাইম চাকরীটির অফার পেয়েছিলাম। সেখানে দোয়েলও ছিল, যে আজও আমার ভালো বন্ধু। বহু বছর আগের হৃদয়-ভাঙা দৃশ্যটি এই দোয়েলই আমাকে দেখিয়েছিল আর আজও বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো ও-ই কাজটি করল।
-আজকের পেপার দেখেছিস?’
-না, এখনো সময় করে উঠতে পারি নি। কেন?
-একটা স্যাড নিউজ আছে। ৫ নম্বর পাতাটা দ্যাখ্।
হাতের কাজ সেরে খবরের কাগজ নিয়ে সোফায় বসলাম। খুঁজতে হলো না। শেষ কলামের মাঝামাঝিতে চোখ আটকে গেল। দিয়া আপার মৃত্যু সংবাদ! এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়ার পর অনুভব করলাম পিপাসায় জিভ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু উঠে গিয়ে পানি খাওয়ার শক্তি নেই। আমার হৃদয় আরেকটি বার রক্তাক্ত হল, তবে দু’দিনের ক্ষরণের প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই প্রথম ঘটনার দিনে অফিসে কি এক জরুরী কাজে কম্পিউটারে ডুবেছিলাম। ‘দ্যাখ্।’ হঠাৎ পাশ থেকে দোয়েলের চাপা গলার ইঙ্গিতে চোখ তুললাম। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন দোদুল ভাই। পেছনে প্রায় তার সমান উচ্চতার শাড়ি পরা এক মেয়ে। দোদুল ভাই আগ্রহ ভরে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবার সাথে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিলেন। সত্যিই আমি বলতে পারবো না মেয়েটি সম্পর্কে তিনি কি বলেছিলেন। সে মূহুর্তের কোন কথা আমার মাথায় ঢোকে নি। সপ্রতিভ মেয়েটি সবার সাথে পরিচিত হচ্ছিল। আমাকে উদ্দেশ্য করেও দোদুল ভাই কিছু বললেন। আমি বোকার মতো তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। পরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলে বুঝলাম মেয়েটি দোদুল ভাইয়ের স্ত্রী বা প্রেমিকা নন, এ অফিসে নতুন জয়েন করা তার সাবঅর্ডিনেট। মনে আছে আমার বিকল মস্তিস্ক সচল হয়ে একটি তাৎক্ষণিক জরিপ চালিয়েছিল। সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য - কি নেই তার? বুকের চিনচিনে ব্যাথা আমাকে নিশ্চিত করলো অফিসের এক নম্বর স্থানটি এখন এ মেয়ের দখলে। মিস্ ওয়ার্ল্ডের পাশে আমি বড় জোর মিস্ ফেয়ার স্কিন। মানে আমার গায়ের রঙটাই শুধু তার চেয়ে একটু উজ্জ্বল। সত্যদর্শী চোখ আমার ইর্ষাকাতর মনকে তৃপ্ত করল- সুন্দর হলেও সে যথেষ্টই কালো। জানলাম মেয়েটি আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র। নাম তার দিয়া। আমি তাকে ‘দিয়া’পা’ বলে ডাকতাম। সে আমায় ডাকতো নাম ধরে। অল্প দিনেই মিশুক মানুষটির সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। আমাদের কথাবার্তা বেশি হত ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে। সুযোগ বুঝে আমি তার রূমেও ঢুঁ মারতাম। শুধু তার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে নয়, অন্য কারণও ছিল। দিয়া’পার কাছে যাওয়ার নাম করে আমি দোদুল ভাইয়ের সাথে একলা হবার সুযোগ খুঁজতাম। সুযোগ মিললে দিনটি হত স্বপ্নে পাখা মেলার। বলতে দ্বিধা নেই আমি দোদুল ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিলাম, মজেছিলাম ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টের’ একাডেমিক রেজাল্ট আর কথার যাদুতে। আর স্পষ্টতঃ তাতে দোদুল ভাইয়ের ইদ্ধন ছিল। অবশ্য একলা সময়ে আমাদের মধ্যে বিশেষ কোন কথা হতো না।
- আপনি আমাকে সবার সামনে শুধু ‘বালিকা’, ‘বালিকা’ করেন কেন?
- কেন তুমি বালিকা নও? দাঁড়াও তো ভালো করে একটু দেখি। দোদুল ভাইয়ের মুখে দুষ্টুমির হাসি।
- না, আমাকে আর ‘বালিকা’ বলবেন না, অসহ্য লাগে। উত্তর না দিয়ে দোদুল ভাই আমার দিকে শুধু চেয়ে রইলেন। একদিন সাদার উপরে লাল কাজ করা তাঁতের শাড়ি পড়ে দোদুল ভাইয়ের রুমে গেলে অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘একদম দেবী সরস্বতীর মতো লাগছে।’ লজ্জা পেলেও উপমাটা আমার মনে ধরেছিল খুব।
প্রায়ই তিনি আমাকে খেপানোর চেষ্টা করতেন। কোন কোন দিন আমি তাকে অফিসের বা ভার্সিটির মজার ঘটনা বলতাম। কিম্বা সদ্য পড়া বইটির কথা। দেখা যেত বেশির ভাগ দিনই নীরবতা আমাদের সময়টুকু শুষে নিত। এক সময় অস্বস্তি এড়াতে আমি উঠে দাঁড়াতাম -‘এখন আমি যাই।’ প্রতিবারই ভাবতাম দোদুল ভাই নিশ্চয় আজ কিছু বলবেন আমায়। নাহ্, আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কোনদিন তিনি কিছু বলেন নি। অবশ্য একদিনের কথায় নিশ্চিত হয়েছিলাম - ভুল মানুষটিকে ভালোবাসিনি আমি। আমাদের অফিসের স্টোরে রবিন নামে একজন কাজ করতেন। লোকটা খ্রিস্টান ছিলেন বলেই হয়তো তাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের আজাদ ভাই, শফি ভাইয়েরা মজা করে আমার সাথে তার সম্পর্ক হতে পারে বলে বুঝিয়েছিলেন। অতি সরল রবিন উঠে পরে লেগেছিলেন সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে। রবিনের মতো কেউ আমাকে নিয়ে ভাবছে - বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারিনি, মনে মনে অপমানিত বোধ করেছিলাম। কথাটি দোদুল ভাইকে বললে তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন -
- ব্যাপারটা এভাবে নিচ্ছ কেন? তোমাকে তার ভালোলেগেছে, তাই সে তোমাকে ভালোবাসতেই পারে। একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে ভালোবাসার অধিকার আছে। ঠিক যেমন তোমার অধিকার আছে তাকে ভালোবাসার কিম্বা না বাসার। লোকটা তোমার যোগ্য না হতে পারে, সে জন্য তার ভালোবাসা কিš‘ ছোট নয়। তুমি তাকে ভালোবাস না, ঠিক আছে, তবে তার ভালোবাসাকে কখনো অসম্মান করো না। এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি অভিভূত না হয়ে পারিনি।  
মনে আছে দোদুল ভাইয়ের প্রথম বইটি বের হলে তার একটি কপি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলেছিলাম ‘অটোগ্রাফ ছাড়া বই তো আমি নেব না।’ আমার হাত থেকে সাদা-কালো প্রচ্ছদের বইটি নিয়ে প্রথম পাতায় তিনি সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখলেন, ‘খুব বেশি একা কেউ/ যদি এই প্রান্তিক আলোয় তোলে ঢেউ/ মনে রেখ তাকে. . . . . ’। হ্যাঁ, আমি তাকে মনে রেখেছি, ভুলি নি ভুলতে পারি নি বলে। যখন-তখন তার রুমে যাওয়ার কারণটি বুদ্ধিমতী দিয়া’পার নজরে পড়লে একদিন দুষ্টুমী করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসো। আমার বসের সাথে তোমার মিটিং এর ব্যবস্থা করে দেব।’ আর একদিন বলেছিলেন,
-জান, তুমি যেদিন ভার্সিটিতে যাও সেদিনই আমার বসকে ‘সরস্বতী’ নামের এক মেয়ে ফোন করে। তা, তোমার ক্লাশ-ট্লাশ হচ্ছে তো ঠিক মতো?
দোয়েল, শুচিদি, বেবী আপার সামনে স্মার্ট দিয়া’পা আমাকে বিব্রত করে মজা পেতেন। ভার্সিটির মেয়েদের কমনরুম থেকে কয়েন দিয়ে ফোন করার ঝক্কির চেয়ে তার দুষ্টুমি সামাল দেয়া আমার জন্যে বেশি কষ্টের ছিল। কিছুদিন যেতে কানাঘুষাতে আমিও জেনেছিলাম দিয়া’পাও আমার মতো শিমুলদার রূমে যাওয়ার সুযোগ খোঁজেন। অবশ্য তাদের দু’জনের সম্পর্ক আমাকে যতোটা না খুশি করেছিল, স্বস্তি দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি - ‘যাক্, তাহলে দোদুল ভাইয়ের সাথে দিয়া’পার প্রেম হবার সম্ভাবনা নেই!’
বই উপহার পেয়ে আমি দোদুল ভাইকে ফিরতি কিছু দেয়ার সুযোগ পেলাম। আমি চাইতাম আমার ভালোবাসা তাকে সারাদিন ছুঁয়ে থাকুক, জড়িয়ে রাখুক। অনেক ভেবে শার্ট দেব স্থির করলাম। হাতে তেমন টাকা ছিল না। নিষ্ঠুরতায় রবিঠাকুরের শ্যামা হলাম, অফিসের রবিনকে বানালাম উত্তীয়। আমেরিকা প্রবাসী এক ভাই ১০ ডলার দিয়েছিলেন। রবিন ডলারটি ভাঙিয়ে এনে দিলে সেই সাড়ে চারশ টাকার সাথে হাতে থাকা টাকা নিয়ে এ্যালিফেন্ট রোডের নতুন ব্র্যান্ড ‘ক্যাট্’স আই’তে গেলাম। একা। দোয়েলকেও কিছু বললাম না। আমার ভালোবাসায় ওর সমর্থন ছিল না। একদিন আমাকে বলেছিল, ‘তুই দোদুল ভাইকে এতো পছন্দ করিস কেন বুঝি না। ওই বাজখাই গলা শুনলে তো আমার হার্টফেল করার দশা হয়।’ তাছাড়া শিরোনামহীন সম্পর্কে সম্পর্কিত একজন মানুষকে শার্ট উপহার দেয়ার পক্ষে কোন যুক্তি ছিল না আমার। বাবা ছাড়া কারো জন্যে শার্ট কেনার অভিজ্ঞতা নেই। অন্যদিকে শঙ্কা ‘যদি কেউ দেখে ফেলে!’ তারপরেও যখন অফ হোয়াইট রঙা শার্টটা কিনলাম তখনও হাতে কিছু টাকা আছে। শীতকাল চলে এসেছিল। ওনার রাফ হাত-মুখের কথা ভেবে নামী বিদেশি বডি লোশন আর ভেজলিন পেট্রোলিয়াম জেলির একটা বড় কৌটা নিলাম। গীতাঞ্জলি থেকে মান্না দে’র প্রিয় গানগুলি ক্যাসেটে রেকর্ড করালাম। অনেক কৌশলে বাসার সবার আর সহকর্মীদের চোখ এড়িয়ে আমি তাকে উপহারগুলি দিতে পেরেছিলাম। ওগুলো পেয়ে আনন্দের বদলে তার চোখে বিস্ময়মিশ্রিত উৎকন্ঠাই যেন দেখেছিলাম।
এরপরে আমিও দোদুল ভাইয়ের কাছ থেকে দু’একটি উপহার পেয়েছিলাম। বিশেষ কিছু বা শুধু আমাকেই দিয়েছিলেন তা নয়। যা কিছু তা দিয়া’পা, দোয়েল এবং আমি- এই তিন জনকেই  দিয়েছেন। অফিসের কাজে বিদেশে গেলে সেখান থেকে টুকটাক এনে দিতেন আমাদের। আমি খুশি হতাম, আবার হতামও না। সবাইকে যা দিলেন আমাকেও তাই! শুধু একবার ব্যাংকক থেকে ফিরে আমাকে যে থাই সিল্কের পার্সটা দিয়েছিলেন সেটা ওদেরটার চেয়ে একটু বেশি সুন্দর ছিল। ঘন বেগুনির উপর গাঢ় ম্যাজেন্টা ফুলের পার্সটি পেয়ে আমার স্বপ্ন দেখার গতি বেড়ে গেল।
আমাদের সম্পর্কের ধরণের কোন কুল কিনারা পেতাম না আমি। তাকে যে আমি ভালোবাসি তা যতো প্রকারে বোঝানো যায়, বোঝাতাম। প্রত্যুত্তর না পেয়ে হতাশা বাড়ত শুধু। মনে মনে আমাদের সম্পর্কের একটা নাম দিয়েছিলাম আমি - ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট লাভ’ যদিও কেউ সে নামের খবর রাখতো না। দিনকে দিন মরিয়া হয়ে উঠা আমি বিষয়টার ফয়সালা করতে দোদুল ভাইয়ের সাথে নিরালায় কথা বলতে চাইলাম। উনি রাজী হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাদের দেখাও হল কয়েকবার। কিন্তু আমার প্রত্যাশিত বাক্য তার মুখ থেকে বের হলো না। বরং আবৃত্তিকারের গলা থেকে গুনগুনিয়ে ভেসে এলো গান, কখনো ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় . . . .’ , কখনো ‘জানি জানি প্রিয়া, এ জীবনে মিটিবে না সাধ . . . ’। তাহলে কি উনি আমাকে তার অপারগতা জানাচ্ছেন? ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। তবুও তার ‘কৃষ্ণকলি’ আবৃত্তি শুনে কৃষ্ণকলি হতে চেয়েছি বারবার, চেয়েছি দিয়া’পার চেয়ে বেশি কালো হতে। আমার পরিবার, অবস্থা, অবস্থান পরিচিত করাতে তাকে বাসায় নিয়ে গেছি। হায়! দেড়টি বছর আমি সংশয়ে দোদুল্যমান মিথ্যা স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। এক সময় দোদুল ভাইকে আমার বড্ড বেশি প্রতারক আর শঠ মনে হতে লাগল। আত্মসম্মান বাঁচাতে তার সাথে দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করলাম। মাস দুই তাকে এড়িয়ে গেলাম। একদিন ফেরার পথে আমাকে রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি নিজেই অফিসের গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা জোর করেই আমার সাথে রিক্সায় চেপে বসলেন,
- চল ভার্সিটিতে গিয়ে আড্ডা দেই।
- নাহ্, আমার কাজ আছে।
- আরে কাজ পরে করো। তাছাড়া আমরা তো আর আজীবন ওখানে থেকে যাচ্ছি না। অল্প একটু সময়।
ওনার হাতটি পেছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরলে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
- আজীবন নয়! অল্প একটু সময়! কেন? কেন আমি আপনার সাথে ‘অল্প একটু সময়’ গল্প করতে যাব? আপনার প্রতি আমার ফিলিংয়ের কথা আপনি জানেন না? তারপরেও কেন এমন ফান করেন? আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করেন?
- জানি সব। তাই তো কথা বলতে চাইছি।
অপরাজেয় বাংলার সামনে বসে সেই প্রথম আমি সরাসরি তাকে আমাদের সম্পর্ক, সম্পর্কের ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। জানালেন পিএইচডি স্কলারশীপের জন্যে চেষ্টা করছেন তিনি। ফ্যামিলি নিতে চাইলে স্কলারশীপ পাওয়া কঠিন। তার স্বপ্ন পূরণে আমি অপেক্ষা করতে রাজি হলাম।
দ্বিধান্বিত দোদুল ভাই এবার যা বললেন তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নামের প্রথমাংশে অত্যধিক জোর দিয়ে তিনি বললেন,
- জান তো আমি মীর্জা হুমায়ুন কবীর, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বংশ ও পরিবারের অমর্যাদা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভালোবাসা বাঁচাতে আমি জানতে চাইলাম-
- তাহলে?
- তুমি যদি অপেক্ষা করতে পার। আর  . . .
- আমি পারবো। কিন্তু আর কি?
- তোমাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে। পেপারে ডিক্লেয়ার করতে হবে। তাছাড়া আমাদের পরিবারের মেয়ে-বউয়েরা চাকরী করে না, পর্দা করে। ধর্মপরায়ণ ছিলাম না কোন কালে, তবু তার শর্তে আমি রাজি হতে পারলাম না। চোখের জলে চারিদিক অন্ধকার হল। কেমন করে ঘরে ফিরেছিলাম জানি না। আমি ভেবেছিলাম আবৃত্তি করা উদার মনের মানুষদের বুঝি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস থাকে, ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের কোন সমস্যা হয় না। বার বার মনে হচ্ছিল আমি প্রতারিত হলাম যদিও আমাকে তিনি ‘ভালোবাসি’ বলেননি কখনো, ‘বিয়ে করবো’ এমন প্রতিশ্র“তিও দেননি। আবার তাকে এড়িয়ে দেড় মাস গেল। উনি আবার আমাকে দেখা করার অনুরোধ করলে প্রতিজ্ঞা ভেঙে দেখা করলাম। ফল হল না কোন। শর্তের বাধা রয়েই গেল। পরের দিনগুলি কতোটা যাতনাময় ছিল সে গল্পে না হয় নাই গেলাম।
একদিন দিয়া’পা আমাকে তার রুমে ডাকলেন।
-তুমি না বললেও তোমার আমি অবস্থা বুঝি। আমার মনে হয় তুমি ভুল করছো। নিজের ক্ষতি করছ, পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছে। জীবনের এমন ক্রুসিয়াল সময়ে তোমার ভুল করা চলবে না। তুমি বরং মন দিয়ে পড়াটা শেষ করো। এমন চাকরী ভবিষ্যতে অনেক পাবে। কাছে থাকলে তুমি স্বাভাবিক হতে পারবে না। একদিন দেখবে সব কষ্ট সামলে নিয়েছো। তখন তুমি আমার বাসায় চলে এসো। বুঝেছো অন্য কারো জন্যে নয়, শুধু আমার সাথে কথা বলতেই এস। আমরা জমিয়ে আড্ডা দেবো।  
অবশেষে আমি চাকরীটা ছাড়লাম। আর কোনদিন দোদুল ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়নি যদিও উনি দেখা করতে আরও একবার খবর পাঠিয়েছিলেন। আমি দেখা করিনি, আরও বেশি কষ্ট পেতে চাই নি তাই। অনেক পরে একদিন দূর থেকে পান্থপথের রাস্তায় আমি তাকে দেখেছিলাম, রিক্সায়। কর্মজীবনে সফল দোদুল ভাইকে আজকাল খবরের কাগজে, টিভিতে প্রায়ই দেখি। তেমন বদলান নি, আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে কপালের সামনের পাতলা সিল্কি চুলগুলো তার এখনো আছে। মিথ্যা বলবো না, ওনাকে দেখলে প্রতিবার আমার হৃদয়ের অতল থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস লুকাতে হয়। তখন কেন যেন কানে বাজে সেই গান যা আমি ভুলতে চাই সব সময়, ‘নীড় ছোট ক্ষতি কি? ... ’ দীর্ঘশ্বাস লুকাই বটে তবে দোদুল ভাইয়ের জন্যে কষ্টে আমার আত্মা কুঁকুড়ে যায় না, যেমনটা হলো আজ দিয়া’পার মৃত্যু সংবাদে। খেয়ালই করিনি দুপুর গড়িয়েছে সেই কখন। জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়াতেই চোখ গেল গোধূলীর আকাশে। কতো দিন আমি আকাশ দেখি নি পাছে বর্তমান জীবনে অতীতের ছায়া পড়ে! আজ কেন যেন বিশাল এই নীলশূন্যকে আবারও ভালো লাগছে! অবাক ব্যাপার বহু বছর পর আমি গাইছি - ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় . . .।’ সাদা মেঘের ’পরে ছোট্ট একটি ঘর বাধতে বড্ড সাধ হ”েছ। সে হবে আমার একান্ত আপন ঘর যেখানে দিয়া’পা আমার প্রতিবেশী। অনন্ত অসীমে অন্য কোন দোদুল ভাইয়ের মিলন- প্রত্যাশায় নয়, আমি শুধু আমার প্রতিবেশী দিয়া’পার সাথে কথা বলতেই তার বাড়ি যাব। চোখের জলে আজ উপলব্ধি করলাম আমাকে ভালোবাসার অধিকার যেমন মানুষের আছে, তেমনি আছে ভালো না বাসারও। কেউ আমায় ভালোবাসেনি বলে প্রতারক হয়ে যায়নি।
হঠাৎ মনে এল দিয়া’পার দাফন হয়েছে চট্টগ্রামে। আর আমার শ্বশুরবাড়িও চট্টগ্রাম। একটা সহজ সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। আজই স্বামী ও ছেলেদেরকে জানিয়ে দেবো যেন মারা গেলে পর আমার কবর চট্টগ্রামেই হয়। জানি এমন ইচ্ছা সাধারণত অপূর্ণ থাকে না। একই শহরে কাছাকাছি হবে আমার আর দিয়া’পার কবর। ছোট নীড়, স্থায়ী ঠিকানা। সিদ্ধান্তটি নিতেই সারা দিন বুকে চেপে থাকা কষ্টটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বড় আকাশের শূন্যে নয়, পাতালের মাটির ঘরেই হবে আমার আর দিয়া’পার কাঙ্খিত সেই আড্ডা।

* গল্পের সঙ্গে শিল্পী কিবরিয়ার শিল্পকর্ম ব্যবহৃত হয়েছে